গত সপ্তাহের শেষ দিকে বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্তে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকায় বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি ও মায়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির মধ্যে হঠাৎ উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এবং ফলস্বরূপ ব্যাপক গোলাগুলির অবতারণা ঘটে। এতে বাংলাদেশের একজন বিজিবি সদস্য ল্যান্স নায়েক মিজানুর রহমান নিহত হন। নিহত মিজানুর রহমানের মরদেহ বিজিপি সদস্যরা তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। পরবর্তীতে তার মরদেহ ফিরিয়ে আনার জন্য বিজিবির পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে প্রথমে তারা কোন ধরনের কর্ণপাতই করেনি। পরে গত শুক্রবার তার মরদেহ ফিরিয়ে দিতে স্বীকার করলে যখন বিজিবি সদস্যরা সাদা পতাকা উড়িয়ে লাশ আনতে যায়, তখন আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন লঙ্ঘন করে বিজিপি বিজিবির উপর এলোপাথাড়ি ব্যাপক গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এতে বিজিবিও পাল্টা গুলিবর্ষণ করতে শুরু করে। ফলে উভয় বাহিনীর মধ্যে সৃষ্ট প্রচণ্ড গোলাগুলির কারণে উক্ত এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং আশপাশের বসবাসকারীরা তাদের গৃহ ত্যাগ করে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান গ্রহণ করে। টানা গোলাগুলির পর উভয় পক্ষই রণমূর্তিতে আবির্ভূত হয়।
ব্যাপক ভারী অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে তারা সীমান্তে শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে। মায়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর আগ্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে নিযুক্ত মায়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এর কারণ জানতে চাওয়া হয় এবং একই সাথে কড়া হুঁশিয়ারিও উচ্চারণ করা হয়। পরবর্তীতে নিহত মিজানের লাশ উদ্ধার করা সম্ভব হলেও সীমান্তের উত্তেজনা এখনো নির্মূল হয় নি। বাংলাদেশকে ভয় দেখাতে বঙ্গোপসাগরে মায়ানমার তিনটি যুদ্ধ জাহাজ অবস্থান নেয় বলে দেশীয় সংবাপত্র ও অনলাইন ম্যাগাজিনগুলোতে খবর ছড়িয়ে পড়ে। ফলে সর্বত্র একটি উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়। অনেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে সর্বাত্মক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করার জন্যও আহ্বান করতে থাকে। অবশ্য বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সীমান্ত সমস্যাকে দুই দেশের বাহিনীর মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি আখ্যা দিয়ে তা সমাধান হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন।
কিন্তু এদিকে ‘বার্মা টাইমস’ নামের একটি অনলাইন সংবাদপত্র (যা পরে ভুয়া বলে প্রমাণিত হয়েছে) ব্যাপক উত্তেজনামূলক কথা-বার্তা ছড়াতে থাকে। তারা ফলাও করে প্রচার করতে থাকে যে, শুক্রবারের গোলাগুলিতে বিজিবির নিক্ষিপ্ত শেলের আঘাতে ৪ বিজিপি সেনা নিহত হয়েছে। এর প্রতিশোধ হিসেবে বিজিপি বাংলাদেশের সীমান্ত অতিক্রম করে পার্বত্য অঞ্চল দখল করে নেবে। হতে পারে এই খবরের উৎসটি ভূয়া এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কিন্তু মায়ানমার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রেস বিজ্ঞপ্তির বরাত দিয়ে চীনা সংবাদ সংস্থা সিনহুয়া জানিয়েছে নিহত বিজিবি সদস্য পেট্রল টিমের সাথে সংযুক্ত ছিলেন না, বরং নিহত মিজানুর এবং আরেক জন অস্ত্রধারী অবৈধভাবে মিয়ানমার সীমান্তে প্রবেশ করার চেষ্টা করছিলেন। তাই তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালায় মিয়ানমার সীমান্ত বাহিনী। এছাড়া মিয়ানমার সরকার হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে তারা কোনোভাবেই মিয়ানামারের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিষয়ে ছাড় দেবে না।
এদিকে মায়ানমার বাহিনীর আগ্রাসী ভূমিকাকে আমলে নিয়ে বিজিবি’র চট্রগ্রাম কমান্ডারও মিয়ানমার সীমান্ত বাহিনীকে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তিনি বিবিসির কাছে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, মায়ানমারের বিজিপি অতন্ত আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। সেই তুলনায় বিজিবি ছিলো আত্মরক্ষামূলক ভূমিকায়। তবে ভবিষ্যতে যদি মিয়ানমার সীমান্ত বাহিনী এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চায় তবে তা কঠোর হস্তে দমন করা হবে।
এদিকে দুই দেশের মধ্যে সৃষ্ট উত্তেজনা আপাতত প্রশমিত হলেও বিজিপির গুলিতে বিজিবি সদস্য মিজানুর রহমান নিহত হওয়ার ঘটনায় কোন বিচার পাওয়া যাবে না বলেই মনে হয়। এমনকি ভবিষ্যতে বিজিপি যদি অনুরূপ ঘটনা ঘটায় তাহলে সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান কি হবে তাও পরিষ্কার নয়। হয়তো এবারের মতই সামান্য উচ্চ-বাচ্যের মধ্যে সীমিত থাকবে তাদের কর্মকাণ্ড।
এমনিতেই বাংলাদেশের তিন দিক দিয়ে ঘিরে থাকা পার্শ্ববর্তী বৃহৎ রাষ্ট্র ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ এর হাতে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশি নিরস্ত্র, নিরীহ মানুষ নিহত হচ্ছে। আজও ঝিনাইদহের মহেষপুর সীমান্তে রিপন হোসেন নামে এক যুবককে হত্যা করেছে বিএসএফ। এসবের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিজিবির কর্মকাণ্ড শুধু লাশ উদ্ধারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। এর বেশি কিছু বলা যায়না, কারণ তারা ঐক্যবদ্ধ এবং আমাদের চেয়ে শক্তিশালী। বাড়াবাড়ি করলে তারা আমাদের টুটি চেপেও ধরতে পারে। দখলও করে নিতে পারে আমাদের দেশ।
স্বাধীনতার ৪২ বছর পার হয়ে গেছে। এক নদী রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এদেশের স্বাধীনতা। অথচ আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব আজ প্রতিবেশীদের হাতে হুমকির মুখে পড়েছে। তাদের সাথে নতজানু হয়ে মেনে নিতে হচ্ছে স্বাধীন দেশের নিরীহ মানুষ হত্যার ঘটনাকে। মূলত আমাদের জাতীয় ঐক্যহীনতা, দলাদলি, হানাহানি কারণে দুর্বল হয়ে পড়ায়ই আমাদের এই দুরাবস্থার প্রকৃত কারণ।
এটা প্রাকৃতিক নিয়ম যে, দশজন ঐক্যবদ্ধ লোক একশত জন ঐক্যহীন লোকের বিরুদ্ধে বিজয়ী হবে। উন্নতি, প্রগতি ও সমৃদ্ধির পূর্ব শর্ত হচ্ছে একটি জাতির ঐক্য। পশ্চিমাদের শেখানো রাজনীতি এবং এদেশের ধর্মব্যবসায়ীদের ছড়িয়ে দেওয়া বিভেদের কারণেই জাতি আজ নানা ভাগে, নানা মতে বিভক্ত হয়ে আছে। এ কারণে একদিকে আমরা ঐক্যহীন হয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছি, অন্যদিকে নিজেরা নিজেরা মারামারি, হানাহানি, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, গুম, খুন, অপহরণ ইত্যাদিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছি। কেউই আজ নিজেদেরকে নিরাপদ ভাবতে পারছি না। সবার মনেই মৃত্যুর আতঙ্ক। কে কখন কার শিকারে পরিণত হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। অথচ এরই মধ্যে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদরা দেশের সম্পদ অবৈধভাবে পাচার করে বাড়ি-গাড়ি কিনছে বিদেশে। উপর তলার অধিকাংশ মানুষই সময় হলে যেনো বিদেশে পালিয়ে যাওয়া যায় সে জন্য অগ্রীম টিকেট কেটে রেখেছেন। আমাদের এই দুর্বলতার সুযোগে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোও আমাদের ভাগ-বাটোয়ারা করে খাওয়ার জন্য মুখিয়ে আছে। তারা নানা ধরনের ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের এই গোপন ষড়যন্ত্রের বিস্তারিত প্রকাশ না পেলেও তাদের মুখ থেকে ফসকে যেসব কথা মাঝে মধ্যে বেরিয়ে পড়ে তা থেকেই আমরা অনুমান করতে পারি আমাদের নিয়ে তাদের পরিকল্পনা কতদূর। তাদের ঘৃণিত ষড়যন্ত্রের কবলে আমাদের এই সবুজ-শ্যামল শস্যে ভরা দেশ আজ হুমকির মুখে। তাদের কেউ (ভারতের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বিজেপির অন্যতম নেতা স্বামী সুব্রাহ্মমানিয়াম) বলে সিলেট থেকে খুলনা বরাবর দাগ টেনে নিয়ে যাওয়ার কথা, কেউ বলে পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে যাবার কথা। এমনকি প্রায় এক দশক আগে বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলা নিয়ে আলাদা ‘বঙ্গভূমি’ নামে একটি রাষ্ট্র গঠনে আন্দোলনের সূচনাও হয়েছিলো।
স্বাধীন একটি সার্বভৌম দেশ, যা নয় মাসের একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে পৃথিবীকে অবাক করে দিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে, সেই জাতিই আজ স্বাধীনতার ৪৩ বছরে এসে অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়েছে। আমাদের ভূ-খণ্ড দখল করে নেওয়ার মত এই দুঃসাহস এরা পায় কোথায়? আসলে দুঃসাহস আমরাই তাদেরকে যুগিয়ে দিয়েছি। ক্রমাগত নিজেদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করে ষোল কোটি মানুষের বত্রিশ কোটি পরিশ্রমী হাত থাকা সত্ত্বেও আমরা আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের মর্যাদাটুকুও তাদের কাছে পাচ্ছি না। প্রতিনিয়ত আমরা আতঙ্কে থাকি কখন কোন চিল এসে মুরগির বাচ্চার মত আমাদেরকে ছোঁ মেরে নিয়ে যায়, পাখির শিকারের মত আমাদের নাগরিককে হত্যা করা হয়, আমাদের ফেলানীর গুলিবিদ্ধ লাশ ঝুলে থাকে কাঁটাতারের বেড়ায়। আমাদের উপর এ অন্যায় চালাতে তারা বিন্দুমাত্র ভয় পায় না। আমরা যেন তাদের বন্দুকের টার্গেট অবজেক্ট।
দুঃখজনক এই যে, এই যখন আমাদের অবস্থা তখন আমাদের নেতারা ব্যস্ত আছেন ফরমালিন রাজনীতি নিয়ে। ইতিহাসের পূনরাবৃত্তি দেখতে পাচ্ছি এখানেও। রোম নগরী যখন পুড়ে যাচ্ছিলো তখন সম্রাট নিরো নাকি বাঁশি বাজাচ্ছিলেন! আর আমাদের নেতারা কে কাকে ফরমালিন দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছেন তা নিয়ে কৃতিত্ব দাবি করছেন। পুরো জাতিকে ফরমালিনে ডুবিয়ে, বিষাক্ত খাবার খাইয়ে তারা নিশ্চিন্তে রাজধানীতে বসে আছেন।
ওদিকে সীমান্ত প্রহরীদেরকে খুন করে লাশ নিয়ে যাচ্ছে বার্মিজ সীমান্তরক্ষীরা। বিএসএফ গুলি করে মেরে ফেলছে শত শত রিপন হোসেনদের। উলঙ্গ করে পেটানো হচ্ছে হাবিবুর রহমানদের। আবার তা মোবাইল ফোনে ভিডিওও করা হচ্ছে। এদেরকে প্রমাণ করা হয় গরু চোর। এমনটাই হয়। জেরুজালেমের খ্রিস্টান পণ্ডিতরা যখন ঈসা (আঃ) এর প্রস্রাব ও পায়খানা পবিত্র না অপবিত্র তা নিয়ে কনফারেন্স আয়োজন করে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিলো তখন নাকি মুসলিম বাহিনী আক্রমণ করে তাদেরকে পরাজিত করে। আজ আমাদের মধ্যেও এমনি মতভেদ, অনৈক্য, দ্বন্দ্ব-সংঘাত। আর এর ফল পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশীদের এ জাতীয় আচরণ। তারা আমাদেরকে সামান্যতম মূল্যায়নও করে না। তাই আমরা পুরো জাতিসুদ্ধ তাদের হাতে আক্রান্ত হলে কয় মিনিট টিকতে পারবো তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সুতরাং এই মুহূর্তে এ সকল মেরুদণ্ডহীন দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদেরকে বিদায় করে জাতি যদি ঐক্যবদ্ধ না হয় তবে ভবিষ্যতে আমাদের রাষ্ট্র, প্রিয় বাংলাদেশ টিকে মর্যাদা নিয়ে থাকবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।