মোরগ ডাকা ভোর।বাড়ির সবাই বিছানায় হয়ত ঘুম ভেঙ্গেছে কিন্তু তন্দ্রাচ্ছন্ন। ইতিমধ্যে বিছানা ছেড়ে দাত ব্রাস ও অন্যান্য কাজ সেরে পড়ার টেবিলে একজন। বাড়ির একমাত্র মেয়ে জেমি। একটু মোটা হওয়ার দরুন খেলাধুলা ও কাজকর্মে আলসেমি লক্ষনীয় হলেও পড়ালেখায় অত্যন্ত মনোযোগী সেই সাথে মেধাবীও।
ষষ্ঠ শ্রেনির নতুন ছাত্রী জেমি।কয়েক ঘন্টা পরই প্রথম ক্লাসে যোগ দিবে অবশ্য বইগুলো গতকালই পেয়েছে জেমি। তাই আজকের পড়ার বিষয়বস্তু একটু আলাদা। সবকটি বইয়ের নতুন প্রচ্ছদ আর ভেতরের চিত্রাঙ্কন দেখে দেখে মজা নেওয়া এবং প্রতিটি বইয়ে কোনো না কোনো জায়গায় নিজের নামটি সুন্দর করে লেখা।লম্বা সময় ধরে বইগুলো উলট-পালট করে অনুধাবন শেষে জেমির মাথায় এল নাম লেখার কথা।
সেই প্রাইমারী সমাপনী পরীক্ষার শেষের দিনের পর বেশ কয়েকদিন যাবৎ জেমির কলম ধরা হয়না।সাধারনত এই সময়ে সবাই আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যায় সেও গিয়েছিল।যাহোক কলমদানিটা চোখে পড়ছে না। এদিক সেদিক চোখ বুলানোর পর দৃষ্টির কাছে ধরা দিল।
আলগা ধুলোগুলো ফু দিয়ে পরিষ্কার করে কলম নিতে উদ্বুত হল কোন কলমটি ভালো হবে সেই চিন্তাটি মাথায় আসলেও মনের চেয়ে হাতের জোরটকে বেশি কাজে লাগিয়ে একটি কলম তুলে নিল।কলমটি তুলতেই চোখ দুটো ছোট হয়ে গেল সেই সাথে কপালেও ভাজ পড়ল। কলমটি আগের জায়গায় রেখে দিয়ে আরেকটি কলম তুলল জেমি।একি এটার ও যে একই অবস্থা যে কালি নিব দিয়ে বের হবার কথা সেই কালি পিছনের ছিদ্র দিয়ে বেরিয়ে লেপ্টে আছে।কলমের এমন দশা এর আগে জেমির দৃষ্টিগোচর হয়নি।একসাথে সব কয়টি কলম তুলে আনল সে। একই অবস্থা এবং কি হাতের নাড়াচাড়ায় কালি এদিক সেদিক ছড়িয়ে যাচ্ছে। দেখতে একদম ভালো দেখাচ্ছে না। মনটা খারাপ হয়ে গেল। ফর্সা মুখটা লালচে আকার ধারন করল। এই কলম গুলোর সাথে কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত কত যতœ আর আগ্রহ নিয়ে কলমগুলি জমানো হয়েছে। জেমির চোখে জল ছলছল। কলমদানিটাও নষ্ট হয়ে গেল।
যেদিন প্রথম জেমি প্রথম শ্রেনির ক্লাসে যাচ্ছিল সেদিন তার নরম গালে আদর করে দাদা হাতে একটি কলম দিয়ে বলেছিল- এই নাও তোমার নতুন কলম,এতদিন পেন্সিল দিয়ে লিখেছ আজ থেকে কলম দিয়ে লিখবা সেই থেকে জেমি কলম দিয়ে লিখে। একটি কালিশূন্য হওয়ার পূর্বেই আরেকটি পেয়ে যায়।কালিশূন্য কলম সে কখনো ফেলে দেয়নি। আম্মুর দেয়া কলমদানিতে সাজিয়ে রাখত। কেন রাখত সে নিজেও জানত না। তবে কলম ফেলে দিতে ইচ্ছে হত না। নিজের অজান্তেই জেমি সংগ্রাহক হয়ে যায়। আর এভাবেই পাঁচ বছরে নানা রঙয়ের অনেক কলম জমা হয় তার কলমদানিতে।
কলমগুলোর বেহাল দশা দেখে জেমির কান্না থামছে না। এমন সময় দাদা হাসিমুখে হাজির নতুন বছরের গিফট নিয়ে।কিন্তু জেমির কান্না তাকে মলিন করে দিল জেমি তুমি কান্না করছ কেন? কি হয়েছে? দাদা আমার সবগুলো কলম নষ্ট হয়ে গেছে এই দেখ। বলেই দেখাতে লাগল দাদাকে। আচ্ছা পাগলি তুই কান্না থামা আমি দেখতেছি,আচ্ছা বলতো কলমগুলো কিভাবে রেখেছিলি। এইভাবে,বলেই জেমি দেখাতে লাগল। হুম বুঝেছি কলমের নিব নিচের দিকে রাখা উচিত ছিল।
এখন কি হবে দাদা সব কলমতো নষ্ট হয়ে গেল?
কি হবে পরে দেখবি তবে এর থেকে ভালো কিছু হবে তুই যা একটা ম্যাচ আর একটি মোমবাতি নিয়ে আয় আমিও আসতেছি বলেই দাদা প্রস্থান করল।
ম্যাচ আর মোমবাতি আনা হল। দাদাও ফিরে আসল অল্পক্ষন পর। হাতে একটি নষ্ট বাল্ব। জেমি মোমবাতিটি জ্বালিয়ে দাও বলেই দাদা কলমগুলো তিন টুকরো করে কাটতে লাগল। শেষ করে বাল্বটির উপরের অংশটুকু গ্লাস কাটার দিয়ে কেটে নিল। তারপর কলমের কয়েকটি টুকরো বাল্বের ভিতর দিয়ে মোমবাতির উপর ঝুলিয়ে দিল। কলমের টুকরোগুলি গলে যাওযার পর আবার কয়েক টুকরো দিল। এভাবে গোল অংশটুকু বরাট হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কলমের টুকরো দিয়ে তাপ দিতে লাগল। জেমি নির্বাক চিত্তে দেখতে লাগল অপলকভাবে।
কিছুক্ষন পর মোমবাতিটি নিভিয়ে তিরিশ মিনিটের মত বাল্বটি স্থির রাখল। যখন ঠান্ডা হল তখন আস্তে আস্তে বাল্বটি ভেঙ্গে বের করে আনল একটি পেপার ওয়েট।জেমির প্রশ্ন দাদা এটা কি?
এটি পেপার ওয়েট। এটা দিয়ে কি করা যায়, বলল জেমি। খেয়াল কর লেখার সময় খাতা বা পড়ার সময় বইয়ের পৃষ্টা ফ্যানের বাতাসে উল্টে যায় কি না। হ্যা. দাদা যায়তো। হুম আর এটা যদি খাতার বা বইয়ের উপর দিয়ে রাখা যায় তাহলে এমনটা হবে কি? জেমি ভেবে বলল না দাদা হবে না। তাহলে এটা দিয়ে কি করা যায়? বুঝেছি দাদা বলেই পেপার ওয়েটটি হাতে তুলে নিল জেমি। আর দাদার দিকে তাকিয়ে বলল ধন্যবাদ।
ওমা তোমার স্কুলের দেরি হয়ে যাবেতো জলদি তৈরি হয়ে নাও আজ যে স্কুলের প্রথম দিন। এবার দাদা বোনের জন্য আনা গিফট টি হাতে দিল। একটি নতুন কলমদানি।
জেমি আনন্দের সাথে স্কুলের জন্য তৈরি হয়ে রওনা দিল।যাওয়ার সময় পেপার ওয়েটটি ব্যাগে ভরে নিল। নতুন বন্ধুদের দেখাবে বলে।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৫:১২