০২/০৬/১৬, রাত ১টার দিকে।
টিভি তে গুলশানে সন্ত্রাসী হামলার Live টেলেকাস্ট দেখায় ব্যস্ত লামিয়া।
ইকটু এই চ্যানেল, ইকটু ঐ চ্যানেল, কিছুক্ষণ টিভি আবার কিছুক্ষণ ফেসবুক। Multi-Mediatic হয়ে যেখান থেকে যা খবর পাচ্ছে, গিলে খাচ্ছে। ব্যাপারটা যেমন অনাকাংক্ষিত তেমনই দু্ঃখ ও আতংকজনক। এমন ঘটনার স্বীকার এর আগে কখনো দেশ বাসীকে হতে হয়েছিলো বলে মনে পরেনা। উদ্বেগ ও আতংকে সারা শহর কাবু।
ইতমধ্যে টিভি তে জানানো হচ্চিলো যে বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত ও.সি এবং ডি.এম.পি'র ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের এ.সি গুলিবিদ্ধ হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। বড়ই কষ্টের ব্যাপার।
বেশ অনেকক্ষণ এই চ্যানেল,ঐ চ্যানেল গুতাগুতি করে অবশেষে হতাশ হয়ে লামিয়া ঘুমাতে চলে গেলো। এখন ফেবু তে 'বিশিষ্ট জনদের' মতামত দর্শনের সময়। News feeds ঘাটতে ঘাটতে লামিয়ার নজরে পরলো এক ভয়াবহ খবর। তারই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী এবং তার সাথে তার কিছু বান্ধুবীরা নাকি ঐ আক্রমণের স্বীকার হয়ে আটকা পরে আছে ঐ রেস্টুরেন্টের মধ্যে।
কি ভয়াবহ ব্যাপার!!!! ছেলে হলেও হ্য়তো এতটা ঘাবরাত না, কিন্তু সকলঐ 'মেয়ে' ছিলো শুনে লামিয়ার উদ্বেগের স্বীমা রইলোনা।
'কি করছে তারা? কি অবস্থায় আছে মেয়েগুলো? ওদের উদ্ধার করা যাবে তো? কখন উদ্ধার অভিযান শুরু হবে?' এইসব চিন্তা তখন লামিয়ার মাথায় ঘুর-পাক করতে থাকলো।
অনেকটাই হতাশ ও উদ্বিগ্ন হয়ে লামিয়া ফেবুতে তার ভার্সিটির এক পেইজে একটা পোস্ট দিলো: সে ভাবলো হয়ত মানুষ 'অতংকের সুরে কিছু আশার এবং স্বান্তনার গান' গাইবে। কিন্তু সে ভুলেই গিয়েছিলো যে পেইজটিতে কিছু 'অতি বিজ্ঞ, মহা পুরুষ' আছে, যারা কিনা তাদের 'উচ্চ বিচার' মূলোক কিছু কমেন্ট না দিলেই নেই। ব্যাস! শুরুতেই এমন এক Lame কমেন্টে পুরা মনটাই ভেঙে গেলো লামিয়ার। হতাশ হয়ে কিচ্ছুক্ষণ ভাবলো, এমন একটা নাজুক পরিস্থিতিতে এমন নির্বুদ্ধিতার প্রমাণ কিছু মানুষের কি না দিলেই নয়? >_<
দুঃখ ভারাক্রাণ্ত মনে শেষ-মেশ সেই পোস্টাও ডিলিট করে দিলো সে।
এখন সে ভাবছে। 'আজ পবিত্র শবে ক্বদরের রাত, হাজার মাসের ফজিলতের রাত, কিন্তু কিছু মানুষের কি দুর্ভাগ্য! এই রাতের এত কাছে এসেও শেষ বারের মত মাফ চেয়ে নিতে পারলোনা তারা। তারা কি জানতো যে গত বছরের ক্বদরের রাতটাই তাদের জীবনের শেষ ক্বদরের রাত ছিলো? কিছুদিন পর আসছে ইদ।ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের বৃহত্তম উৎসব, কে জানত যে তাদের নসিবে, এইবার তাদের পরিবার-পরিজনদের সাথে ইদ করাটা আর হবে না। তাদের পরিবারের সকলের এখন কেমন লাগছে? কিভাবে কাতরাচ্ছে তারা প্রিয় মানুষটির মৃত্যুর সংবাদ শুনে?আর কেমন আছে সেই বাবাটি যাকে তার মেয়ে আটকা থাকা অবস্থায় তাকে উদ্ধার করার জন্য, বাঁচানোর জন্য মেসেজ দিয়েছিলো। কতটা অসহায় বোধ করছিলো সেই বাবাটি যে কিনা তার মেয়েকে সকল বিপদ থেকে রক্ষা করার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। আজ সেই বাবাটি কিছুই করতে পারছেনা।'
এসব চিন্তা করতে করতে লামিয়ার চোখে ঘুম নেমে এলো।
সেহরীর সময় উঠে মা কে ঘটনা গুলো বলল। খাওয়া দাওয়া শেষ করে আবারও টিভি সামনে বসে পরলো লামিয়া। কিন্তু তখনো সেই একই খবর, উ্দ্ধার অভিযান তখনো শুরুই হয়নি।তাই টিভি বন্ধ করে একেবারে ঘুমাতে চলে গেলো সে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে টিভি ছেড়ে জানতে পারে হতাহতদের খবর।যাদের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে তারা সবাই হলো বিদেশী। বাংলাদেশীদের হতাহতদের সংখ্যা ওমন একটা না। যাক!!! আল্লাহ তাদের উপোর রহম করেছেন। যদিও লামিয়া মৃতদের সংবাদ পেয়ে অনেকটাই কষ্ট পেয়েছে।
সকাল পেরিয়ে রাতে শবে ক্বদরের নামাজ। অনেকদিন ধরেই লামিয়া মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল যে এইবার সে তার মায়ের সাথে স্থানীয় মসজিদে যেয়ে জামাতে সেই নামাজ আদায় করবে। নিজের, নিজের পরিবারের, নিজের আত্যিয়- স্বজনদের জন্য দোওয়া করবে। কিন্তু তার মনে এখন চলছে অন্য চিন্তা, নিজের অস্তিত্বের জন্য তার মনে জন্মালো মহান আল্লাহ তা'আলার প্রতি এক প্রবল কৃতজ্ঞতা।
********
ইফতার সেরে লামিয়া রৌনা হল মসজিদে তার মাকে নিয়ে। মনের ভিতরটা যেন কেমন ব্যাকুল হয়ে আছে কিছু একটা পাও্য়ার আশায়। যেন আল্লাহর কাছে কিছু একটা বলার আছে, কিছু একটা চাওয়ার আছে যা আজ না চাইলে নয়।
অবশেষে সেই শুভক্ষণ আসলো। খৎমে-তারাবী শেষে মুয়াজ্জিন আকুল আবেদনের স্বরে মোনাজাত তুললেন।
'হে আল্লাহ...তুমি আমাদের ডাকে সারা দাও।'
দেখতে দেখতেই লামিয়ার দুচোখ হতে অঝর ধারে অশ্রু ঝরতে লাগলো। তার চোখে ভেসে আসলো সকালে দেখা ঐ রেস্টুরেন্টের ভিতরে লাশদের ছবি। মুয়াজ্জিনের কথা তার কানে এখন অস্পষ্ট। কি চাইবে লামিয়া সে সব ভুলে গিয়েছে। সে নিজের মনে মনে আরেক মোনাজাত ধরলো-
" হে আল্লাহ, তোমার লাখ শুকরিয়া করলেও তো কম হবে। আমি তোমার কাছে কত আবদার করি, কিন্তু কখনও তোমার শুকরিয়া আদায় করিনি আমাকে জীবনের অনেক বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য। আজ ঐ মেয়েটির জায়গায় আমিও থাকতে পারতাম, হ্য়ত তোমার অসীম কৃপা্য মেয়েতি প্রাণে রক্ষা পেয়েছি, কিন্তু তুমি চাইলে সেই জায়গায় আমিও থাকতে পারতাম। তুমি চাইলে কোনো এক ফাঁকা গুলির অন্য পাশে আমি থাকতে পারতাম। হয়ত আজ আমি তোমার সামনে নাও দাড়াতে পারতাম। হয়তো তোমার কাছে আমার গুনাহ মাফের শেষ সুযোগটা নাও পেতে পারতাম। কিন্তু প্রভু, তুমি অসীম ক্ষমাশীল। তোমার কৃপায় আজ আমি তোমার দরবারের সামনে হাজির হতে পেরেছি। হে প্রভু আমায় তুমি ক্ষমা করো, হে প্রভু তুমি আমার মা-বাবা, পরিবার পরিজনদের ক্ষমা করো। আমাদের এই জীবন তোমার আর আজ আমি শুধুই তোমার শুকরিয়া আদায় করতে চাই আমাকে রক্ষা করার জন্য, আমাকে সুযোগ দেয়ার জন্য যে আমি আরো একবার তোমার কাছে হাত তুলে আমার গুনাহ মাফের জন্য দোয়া করতে পারছি।"