somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

বিএম বরকতউল্লাহ
পড়াশোনা করি। লেখালেখি করি। চাকরি করি। লেখালেখি করে পেয়েছি ৩টি পুরস্কার। জাতিসংঘের (ইউনিসেফ) মীনা মিডিয়া এ্যাওয়ার্ড ২০১১ ও ২০১৬ প্রথম পুরস্কার। জাদুর ঘুড়ি ও আকাশ ছোঁয়ার গল্পগ্রন্থের জন্য অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ শিশুসাহিত্য পুরস্কার ২০১৬।

মুক্তিযোদ্ধা ও এক কিশোরীর গল্প

১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ সকাল ১০:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বারো বছরের মেয়ে অপরাজিতা। তার মনে একটা দুঃখ বারবার জেগে ওঠে, সেটা হলো, সে এখনও কোন মুক্তিযোদ্ধাকে দেখেনি। সে তার বাবার কাছে আফছুছ করে প্রায়ই তার এই দুঃখের কথাটা বলে।

একদিন তার বাবা তাকে বললেন, ‘আমি তোমাকে মুক্তিযোদ্ধা দেখাব মা।’ পরেরদিন অপরাজিতার বাবা তাকে তার স্কুলের গেটে নিয়ে গেলেন। তার বাবা সেখানে যবুথবু দাঁড়িয়ে থাকা এক ভিক্ষুককে দেখিয়ে বললেন, ‘ইনি একজন মুক্তিযোদ্ধা।’ অপরাজিতা থ হয়ে গেল। সে তার বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘কী বলো তুমি! ইনি তো ভিক্ষুক। ভিক্ষুক আবার মুক্তিযোদ্ধা হয় কীভাবে?’

বাবা বললেন, ‘কোন ভিক্ষুক মুক্তিযোদ্ধা হয়েছিল কি না জানি না, তবে অনেক মুক্তিযোদ্ধা ভিক্ষুক হয়ে গেছেন। আমাদের দেশে এমন অনেকেই আছেন যারা নানা কষ্ট করে জীবন সংগ্রামে পরাজিত হয়ে মারা গেছেন। আমরা তাঁদের জন্যে তেমন কিছুই করতে পারিনি। আমরা অনেক বড় অকৃতজ্ঞ।’

সে কৌতূহলী দৃষ্টিতে ভিক্ষুকটার দিকে তাকিয়ে রইল। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি কীভাবে শক্রুর দৃষ্টি এড়িয়ে শক্রুদের হত্যা করেছিলেন এসব ঘটনা অপরাজিতার মনে খেলা করতে লাগল। এখন এ মুক্তিযোদ্ধার প্রতি কেন জানি তার অসম্ভব দরদ আর শ্রদ্ধা জেগে ওঠেছে।

অপরাজিতা তার বাবাকে আবদার করে বলল, ‘বাবা আমি এখন এই মুক্তিযোদ্ধাকে পা ছুঁয়ে সেলাম করব।’ বাবা তাকে একটা হ্যাঁচকা টানে সরিয়ে নিয়ে চাপা গলায় বললেন, ‘মাথা খারাপ হয়েছে তোমার? ভিক্ষুকের পা ছুঁয়ে সেলাম করবে তুমি? লোকজন দেখলে কী বলবে, শুনি?’ এ কথা বলেই তার বাবা আর বিলম্ব না করে অপরাজিতাকে টেনে নিয়ে সোজা বাসায় চলে গেলেন।

অপরাজিতা চিৎকার করে বলছে, ‘তুমি না বললে, ইনি মুক্তিযোদ্ধা! তাহলে আমাকে এভাবে টেনে নিয়ে এলে কেন?’ বাবা বললেন,‘ তিনি মুক্তিযোদ্ধা তা ঠিক আছে। কিন্তু যিনি ভিক্ষা করেন তার আর কোনো পরিচয় থাকে না, সব মুছে যায়। এ পেশার মানুষকে কেউ মানুষ বলেই তো স্বীকার করে না; সেলাম করবে কোন সাহসে!’

পরের দিন স্কুলে গেল অপরাজিতা। স্কুল গেটে ছাত্র ছাত্রী আর অভিভাবকদের ভিড়। সে কতক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে সোজা ভিক্ষুকের পায়ের ওপর আছাড়খেয়ে পড়ে সেলাম করতে লাগল। ভিক্ষুক বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে কৃতজ্ঞতার হাত বুলিয়ে দিল। এ অপূর্ব দৃশ্য দেখে মুহূর্তে ভিড় জমে গেল। সবাই হতবাক! ‘মেয়েটি এমন করল কেন? কী হয়েছে তার? ভিক্ষুকের পায়ে পড়ে সেলাম! মাথা ঠিক আছে তো মেয়েটির!’

তার চারপাশে কৌতূহলী লোকের ভিড় জমে গেল। সবাই অবাক হয়ে তাকে দেখছে। ছাত্র ছাত্রী ও অভিভাবকদের অজস্র প্রশ্নবাণে জর্জরিত অপরাজিতা কার প্রশ্নের কী জবাব দিবে এর কিছু বুঝে উঠতে না পেরে সে চোখ বন্ধ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।

কে একজন ফোন করে অপরাজিতার বাবাকে বলছে, ‘হ্যালো, আপনি কি অপরাজিতার বাবা বলছেন? আপনার মেয়ে স্কুল গেটে এ্যাবনরমাল আচরণ করছে, তাড়াতাড়ি চলে আসুন।‘

অপরাজিতার কান্না থামছে না। তার পিতা-মাতা তাকে নিয়ে সোজা বাসায় চলে গেল। অপরাজিতার বাবা আদর করে বললেন, ‘এমন নিসপিস করছ কেন, মা। খারাপ লাগছে তোমার?’
অপরাজিতা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘খুবই খারাপ লাগছে বাবা। আমি এখন কাঁদব। মন খুলে কাঁদব। কাঁদলে আমার ভালো লাগবে। তোমরা এখন রুম থেকে বেরিয়ে যাও, প্লিজ।’

কিছুদিন পরে অপরাজিতা স্কুলে যাওয়া শুরু করে দিল। স্কুলগেটে গিয়েই তার বুকটা ধক্ করে উঠল। সেই ভিক্ষুকটি আর সেখানে নেই। তার বুক ভেঙ্গে কান্না আসে।

অপরাজিতা একদিন এক মহিলা ভিক্ষুককে বলে, ‘আপনি কি দয়া করে বলবেন, এখানে দাঁড়িয়ে যে লোকটি ভিক্ষা করতেন তিনি এখন কোথায়?’ মহিলাটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অভিমানের সুরে বলল, ’কোথায় আবার, গত পরশু না হেয় মারা গেছে। বড় বালা মানুষ আছিল গো, অভাবের তাড়নায় তার বউ-পোলা-মাইয়ারা হেরে ছাইড়া কই জানি চইলা গেছে। দেশের জন্যি যুদ্ধ করিছে বেটায়, গুল্লি খাইয়া তার এক পাও এক হাত অচল অইয়া গেছে। এহন হের কোনো দাম নাই। হেয় খাইছে বিক্কা কইরা। আমি হেরে কইছিলাম, তুমি না মুক্তিযোদ্ধা। সরহার ট্যাহা দেয়, যাওনা ক্যান?’ হেয় কয় কি, ‘আমি যখন সব হারাইয়া পথের ভিক্ষুক অইয়া গেছি এহন আর কাউকে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিমু না।‘ একটানে কথাগুলো বলে মহিলাটি আঁচলে চোখ মুছতে লাগল। অপরাজিতার সারাটা শরীর মায়ায় ভরে গেছে।

অপরাজিতা মহিলাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘ওনাকে কবর দিয়েছে কোথায়?’ মহিলাটি বলল, ‘ফহিরগো আবার কব্বর। হেরে ওই সেতুডাঙ্গার ঢালে কোনোমতে কব্বর দিয়া সাইনবোট লাগাইয়া দিছে।’
অপরাজিতা মহিলাকে নিয়ে গেল কবরের পাশে।

সেতুডাঙ্গার ঢালুতে একটি মাত্র কবর। চারকোণে চারটা খেজুরের ডালা কোপানো। কবরের শিথানে কাঠিতে ঝুলানো আছে এ্যাবরো-থ্যাবরো টিনপ্লেট। প্লেটে আনাড়ী হাতের লেখা। এতে আছে- ‘মৃতের শেষ ইচছায় লেখা- ”কেউ আমাকে না চিনলেও সেদিন স্কুলগেটে একটি ছোট্ট মেয়ে আমাকে চিনেছিল। যেদিন সে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় আমার পা ছুঁয়ে সেলাম করেছিল সেদিনই আমি আমার স্বীকৃতি পেয়ে গেছি। কেউ না জানুক, অন্ততঃ সেই মেয়েটি আমাকে জেনেছে। আমি মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত আমার সমস্ত কৃতিত্ব ও অহংকার সেই ছোট্ট মেয়েটিকে উৎসর্গ করলাম!“
লেখাটি পড়ে অপরাজিতার চোখ বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রƒ গড়িয়ে পড়ল কবরে। সে দু‘হাত তুলে মোনাজাত করছে- ”হে প্রভূ, একজন বীরমুক্তিযোদ্ধা তাঁর সমস্ত কৃতিত্ব ও অহংকার আমাকে উৎসর্গ করে গেলেন, আমাকে তার পূর্ণ মর্যাদা রক্ষা করার শক্তি দাও। আমরা তাঁর কোনো মর্যাদা দিতে পারিনি। তুমি তাঁর উপযুক্ত মর্যাদা দিও। এতদিন তিনি যা গোপনে লালন করেছিলেন, আমি যেন তার চেতনা সবলে প্রকাশ করতে পারি।” মহিলা ভিক্ষুকটি ‘আমিন!’ ‘আমিন!!’ বলে চিঁ চিঁ করে কেঁদে উঠল।

অপরাজিতা চোখ মুছে কবরটা সামনে রেখে স্থির হয়ে শক্তপায়ে দাঁড়াল এবং সে সামরিক কায়দায় সেল্যুট করল। অতঃপর অপরাজিতা বীরমুক্তিযোদ্ধার সমস্ত কৃতিত্ব আর চেতনা বুকে ধারণ করে সগর্বে চলে গেল বাসায়। সামনে তার অনেক কাজ!

৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মামুনুলের মুক্তির খবরে কাল বৃষ্টি নেমেছিল

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৯


হেফাজত নেতা মামুনুল হক কারামুক্ত হওয়ায় তার অনুসারীদের মধ্যে খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ তো বলল, তার মুক্তির খবরে কাল রাতে বৃষ্টি নেমেছিল। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ায় আজ গাজীপুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×