ভূতের টাকায় ধনী হয়ে গেল সেরালি
প্রচন্ড লোভী ও কৃপণ সেরালি তার ছেলেকে দিয়ে অল্প দিনেই প্রচুর টাকা ও সোনাদানার মালিক হয়ে গেল। রাত হলেই সেরালি ও তার স্ত্রী গোপনে টাকা ও সোনাদানা গণে। স্ত্রী গণে সোনার জিনিস আর সেরালি গণে টাকা আর টাকা। তারা পরের দিন সকাল হতে সন্ধ্যা অবধি আর কত টাকা ও সোনাদানা ঘরে উঠবে, তারা তার আগাম হিসেব করে বসে থাকে। টাকা ও সোনার বস্তাটা আর কোথাও রাখতে ভরসা পায় না সেরালি। সে ও তার স্ত্রীর মাঝখানে রাখে টাকার বস্তা, তার উপর বেড় দিয়ে রাখে দু’জনের হাত। এভাবে টাকার বস্তার দু’পাশে দু’জন ঘুমায়। একজন একটু নড়াচড়া করলে অন্যজন লাফিয়ে উঠে বস্তাটা খাবলে ধরে ঘাপটি মেরে থাকে। সেরালির ঘরে টাকার সাথে যতটা সুখ আসেÑততটা স্বস্তি আসে না।
দেখতে দেখতে সেরালি মেলা অর্থ-বিত্তের মালিক হয়ে সমাজে গণ্য ব্যক্তি হয়ে উঠেছে। সেই সাথে তার চলন-বলন, আচার-ব্যবহারেও বিস্তর পরিবর্তন এসেছে।
কিন্তু হঠাৎ করেই ছন্দপতন ঘটল। সেরালির ছেলেটি অসুস্থ হয়ে পড়ল। সে ঝিমধরে বসে থাকে। কথায় কথায় রাগ দেখায়। কেমন জানি খিটিমিটি ভাব। সে সেরালিকে নিষেধ করে দিয়েছে, তার ধারে-কাছে যেন কোনো লোক না পাঠায়।
সেরালির ওফর-ফাঁপর অবস্থা। আয়-রোজগার কমে গেল। এতে লোভী সেরালির আঁতে টান পড়ল। ছেলের প্রতি সেরালির আগের মত মন নেই। সে কামাই করা অর্থ-স¤পদ গণে গণে সারাদিন ব্যস্ত সময় কাটায়। অযতœ-অবহেলায় সেরালির ছেলে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল।
একদিন সকালে সেরালি ছেলেকে খুঁজে পাচ্ছে না। দেখে, ছেলের জায়গায় একটি কাক মরে পড়ে আছে।
সেরালি হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। যে ছেলে কামাই করতে পারবে না, তার বেঁচে থাকার চেয়ে মরে ‘কাউয়া’ হয়ে যাওয়া ঢের ভালো।
ভূতের খপ্পরে ডাকাত দল
এক রাতে সেরালির ঘরে ডাকাত পড়ল। ডাকাত দল সেরালি ও তার স্ত্রীকে খাটের পায়ার সাথে টাইড করে বেধে সোনাদানা ও টাকার বস্তা নিয়ে উধাও হয়ে গেল। সেরালি ও তার স্ত্রী কপাল চাপড়ে প্রলাপে-বিলাপে কেঁদে-কেটে শেষ। ‘আমার এতগুলো জলজ্যান্ত ভয়ংকর সন্তান থাকতে আজ এই দশা? কইরে আমার সন্তানসকল, তোরা কই? তাড়াতাড়ি আয়, দেখে যা, কত বড় সর্বনাশ হয়ে গেছে। আমি যে পথের ভিখারি হয়ে গেলাম রে। কই, তোরা কই?
হুড়মুড়িয়ে চলে এল তার আজব সন্তানেরা। তারা করজোড়ে বলল, প্রাণ প্রিয় মা ও বাবা, আপনাদের কী হয়েছে? এভাবে কান্নাকাটি করছেন কেন? খুলে বলুন।
সন্তানদের দেখে তাদের কান্নার জোর বেড়ে গেল। কথা বলতে গিয়ে বলতে পারে না, কান্নার জোয়ারে কথা ভেসে যায়।
সন্তানেরা বাবা-মার শক্ত বান খুলে দিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, কী হয়েছে, এবার বলুন।
তারা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, ঘরে ডাকাত এসে আমাদের সব কিছু নিয়ে গেছে। আমরা কিছুই করতে পারলাম না। পথের ফকির হয়ে গেলাম। তোরা থাকতে আজ আমার এত দুর্গতি? তোরা কোথায় ছিলি?
সন্তানেরা বলল, আপনারা যদি আমাদের তখন ডাক দিয়ে নির্দেশ করতেন তাহলে দেখতেন, আমরা কী করি। আপনারা কি জানেন না যে, আমরা নির্দেশ ব্যতীত কিছুই করতে পারি না! সে ক্ষমতা আমাদের নেই।
সেরালি চোখ মুছে বলল, এখন বললে পারবি?
আলবত পারব বাবা, আদেশ করুন।
যা, তোরা এখনই যা। আমাদের মালামালসহ ডাকাতদের ধরে নিয়ে আয়। যা।
সন্তানেরা কোনো জবাব না দিয়ে লাটিমের মত ঘুরতে ঘুরতে উধাও হয়ে গেল।
ডাকাতদল পাশের এক জঙ্গলে ঢুকে নিরাপদ জায়গায় গিয়ে গোল হয়ে বসল। তারা বস্তার মুখ খুলে সবার সামনে রাখল। ওরেব্বাস! এত সোনাদানা! এত টাকা! ডাকাতসর্দার বলল, ‘বেটা সেরালি, তোর অদ্ভুত ছেলে-মেয়েরা দশ জনের কাছ থেকে কামাই করবে, তুই জমাবি আর আমরা তোর জমানো টাকার বস্তা তুলে নিয়ে আসব। তুই আর লীলাখেলা দেখাবি কী, সব লীলা তো আমাদের কাছে! আমাদের ধনী হতে আর কয় দিন? হোঃ হোঃ হোঃ হাঃ হাঃ হাঃ করে সবাই একচোট হেসে নিল।
ডাকাতসর্দার জগুরাম মনের আনন্দে তার দলের লোকদের মাঝে সোনাদানা ও টাকা বিতরণ করতে লাগল। আনন্দ আর ধরে না।
সেরালির সন্তানেরা ডাকাতদলের সন্ধান পেয়ে গেল। তারা পরামর্শ করে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
ডাকাতদলটি যে গাছটির তলায় বসে মালামাল ভাগ করছে, হঠাৎ সে গাছটি দোল খেতে লাগল। ডাকাতেরা মনে করছে কোনো ঝোড়ো হাওয়া বইছে হয়তো।
কিঁরেঁ জঁগুরাম, এঁত ট্যাঁকা আঁর সোঁনা দাঁনাঁ পাঁইলি কঁই? গাছের ওপরে বসে কে যেন ন্যাঁকো স্বরে বলল।
কে? কে? এখানে কথা কয় কে? ডাকাতসর্দার জগু গর্জে উঠল। আমাদের কাছে ট্যাকা চায় কে? ট্যাকা কি গাছের গোটা চাইলেই পাওয়া যায়? বহু কষ্টে কামাই করতে হয়।
একটু পরে একটা শিয়াল জগুর পাছায় খামছি মেরে দিল ভোঁ দৌড়।
জগু লাফিয়ে উঠে কোঁচর থেকে চাকু বের করে বলল, শিয়ালের কত সাহস দেখছস? এই যে, পাছায় খাবলা মেরেছে, দেখ!
ডাকাতদলের সবাই দেখে খলখলিয়ে হাসতে লাগল।
একটু পরে কোত্থেকে একটা গেলাকার জিনিস, দেখতে প্রায় ফুটবলের মতো, হরহর-গড়গড় করে এসে ডাকাতদের চারপাশে ঘুরতে লাগল।
ডাকাতেরা ঠিক বুঝতে পারছে না জিনিসটা যে কী! ওরা হাতে চাকু নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
বলটা ক্রমেই দ্রুত গতিতে ঘুরতে লাগল এবং মাঝে মধ্যে ডাকাতদের পায়ের ফাঁক দিয়ে ছোটাছুটি শুরু করে দিল। ডাকাতেরা সহজে ভয় পাওয়ার নয়। তারা বলটাকে ধরার জন্য ওৎ পেতে রইল। ডাতাতসর্দার প্রচন্ড সাহসী লোক। সে বলটাকে লক্ষ করে এক লাফে গিয়ে বলটাকে ঝাপটে ধরল। হায়! হায়! বল তো হাত থেকে সরানো যাচ্ছে না। আঠার মত লেগে আছে। অন্য ডাকাতেরা সর্দারের কাছ থেকে বলটা টেনে যেই আলগা করতে গেল, অমনি সবাই আটকে গেল বলের কঠিন আঠায়।
ডাকাতদলের সাত সদস্য পড়ে গেল মহাফ্যাসাদে। তারা বল থেকে হাত ছুটাবার জন্য শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে টানাটানি করতে করতে কাহিল হয়ে গেল। বল থেকে কারও হাত ফসকাতে পারছে না। বলের আঠা আর ডাকাতের হাত-পায়ে মাখামাখি। ওরা হাঁপাতে হাঁপাতে মাটিতে বসে পড়ল। দেখে মনে হচ্ছে, দক্ষ পুলিশদল সাত ডাকাতকে একটা হ্যান্ডকাপে বেধে রেখেছে।
গাছ থেকে নেমে এল অদ্ভুত এক লোক। ডাকাতেরা লোকটার বিকট চেহারা দেখে ভয়ে থত্থর করে কাঁপতে লাগল।
ডাকাতসর্দার লোকটাকে মিনতি করে বলল বাবা, আপনিই কি আমাদের কাছে ট্যাকা চেয়েছিলেন? আমরা বুঝতে পারিনি। নিন আপনি সব নিয়ে যান, দয়া করে আমাদের মুক্তি দিন।
লোকটি মোটা গলায় বলল, আমি পরের ট্যাকা নিই না। এই বলে সে বস্তাটা ধরে ডাকাতদের মাথায় তুলে দিয়ে বলল, যা, হাঁট। যার ট্যাকা তাকে বুঝিয়ে দিবি।
ডাকাতেরা ভয়ে টাকার বস্তাটা মাথায় নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।
সেরালি স্ত্রীকে নিয়ে অধীর আগ্রহে বসে আছে ঘরে।
সাত ডাকাত টাকার বস্তা নিয়ে সেরালির সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
সেরালি ছোঁ মেরে টাকার বস্তাটা নিয়ে খাটের নিচে লুকিয়ে রেখে একটা বেন্দা টেনে বের করে আনল। সে হাতবন্দি সাত ডাকাতকে লাফিয়ে লাফিয়ে পিটাতে লাগল। বেন্দা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল কিন্তু সেরালির রাগ ভাঙল না।
গ্রাম ভেঙে লোকজন এসে সেরালির সন্তানদের কেরামতি আর শক্তি-সামর্থের প্রশংসা করতে লাগল। সকালে চলে এল পুলিশ। সেরালি গর্ব নিয়ে পুলিশকে বলল, আপনারা তো সহজে চোর-ডাকাত ধরতে পারেন না। এই নেন, গোটা ডাকাতদল ধরে দিলাম। এবার আইন-আদালত করেন গিয়ে।
আইন আদালত হলো সাথে সাথে লোকমুখে রাস্ট্র হয়ে গেল সেরালির রহস্য ছেলেদের দুর্ধর্ষ ডাকাতদল পাকড়াও করার দুঃসাহসিক কাহিনী। চলবে...
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে আগস্ট, ২০২০ রাত ৮:৩৮