somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমি সেদিন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম ...

২৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৪:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বেশ কিছু বছর আগেকার কথা। কর্মসূত্রে আমি তখন তিন মাসের জন্য জার্মানী প্রবাসী। জার্মানীর হামবুর্গ শহর। ছবির মত সুন্দর শহর এবং শহরতলি। হামবুর্গের পাবলিক ট্রান্সপোর্ট অসাধারণ। রেল ,আন্ডারগ্রাউন্ড রেল , বাস ,ফেরী --কি নেই। সিঙ্গেল ,ডেইলি ,উইকলি --যার যেমন প্রয়োজন সব ধরণের টিকিট। ডেইলি টিকিট কিনলে সারা দিনের জন্য যে কোন পরিবহনে যত খুশি চড়া -নামা যায়।

এক উইকএন্ডের দুপুরবেলায় আমি চলেছি হামবুর্গের শহরতলিতে এক সর্দারের বাড়িতে। হামবুর্গ থেকে প্রায় ২৫-৩০ কিলোমিটার দূরে। সময়টা ছিল ডিসেম্বরের শেষ দিক। ভারতের পাগড়িবাঁধা শিখ ধর্মাবলম্বীদের সর্দার বলা হয়।শিখদের সর্দার বলা মানে তাদের প্রতি বেশ সম্মান প্রদর্শন করা হয় ,সর্দারজী বলে ডাকলে তেনারা যথেষ্ট খুশী হন।

পূর্ব পরিচয়ের সূত্রধরে সর্দারজির বাসায় আমার নিমন্ত্রণ ছিল লাঞ্চের।অন্যান্য নানান আইটেমের মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে লোভনীয় খাবার ছিল "সর্ষ দা শাগ আউর মাক্কাই দি রোটি "

আপনারা কেউ খেয়েছেন সর্ষে শাক দিয়ে তৈরী সর্ষ কা শাগ ? সর্ষে শাকএর পেস্ট বানিয়ে তার সাথে বিভিন্ন মশলা এবং পেঁয়াজ ,রসুন ইত্যাদি সহযোগে তৈরী হয় পাঞ্জাব প্রদেশের এই বিখ্যাত খাবার। সাথে গরমা -গরম মাক্কাইয়ের রুটি। মাক্কাই হচ্ছে ভুট্টা। ভুট্টার আটা থেকে তৈরী রুটি। শীতকালে অসাধারণ খেতে লাগে এই খাবার। আগ্রহীরা ইউটিউবে রেসিপি দেখতে পারেন।


সর্দারজীর বাসায় চব্য-চোষ্য খাওয়া এবং তারপর ঘন্টা খানেক গল্পগুজবের পর আমার বিদায় নেবার পালা। তাদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি উঠে পড়লাম সেই দেশের অসাধারণ পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সিস্টেমের এক অসাধারণ পাবলিক বাসে।

বাসে চড়ার পর আশেপাশে চোখমেলে দেখলাম সহযাত্রীরা প্রায় সবাই জার্মান। আমার জার্মান ভাষাজ্ঞান প্রায় শুন্যের কাছাকাছি। বার্লিনে ইংরাজি বেশ চলে কিন্তু জার্মানির অন্যান্য ছোট শহর /শহরতলি গুলোতে তাদের ভাষা না জানলে ভীষণ অসুবিধা। কারোর সাথে আলাপ জমানোর সুবিধা নেই দেখে আমি এয়ারকন্ডিশনড বাসের জানালার ধরে সিট দখল করে বাইরের অপরূপ প্রকৃতি দেখতে শুরু করলাম। বিকেলের দিক , শুনশান রাস্তা ,বাসটি তীব্র গতিতে ছুটে চলেছে। বাইরের আকাশ মেঘে ঢাকা। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি নেমেছে ,বোঝাযাচ্ছে বাইরে তীব্র হাওয়া , তাপমাত্রা প্রায় হিমাঙ্কের কাছাকাছি।

সর্দারজীর বাসায় অতিরিক্ত আহার অথবা বাসের ভিতরে উষ্ণতার জন্য--কারণ ঠিক জানিনা ... আমার বোধহয় একটু ঝিমুনি এসে ছিল। হটাত করে খেয়াল হলো বাসটি মধ্যরাস্তায় আচমকা ব্রেক মেরে থেমে গেল। ইংরাজিতে যাকে বলে একেবারে screeching halt .

ব্যাপার কি ? সামনের রাস্তা ফাঁকা ---সবার নজর ড্রাইভারের দিকে। ড্রাইভার মহোদয় তাঁর সিটে বিদ্যমান অবস্থায় উদ্বেগ সহকারে একবার বামদিকের অন্যবার ডানদিকের রিয়ার ভিউ মিররে অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে কি যেন দেখার চেষ্টা করছে। তার দেখা যেন আর শেষ হয় না। এরপর হটাৎ করে বাসের ইঞ্জিন বন্ধ করে দিয়ে বাসের পাবলিক এড্রেস মাইক্রোফোনে যাত্রীদের উদ্দেশ্যে কি যেন ঘোষণা করতে থাকলো। আমি বিন্দুবিসর্গ কিছু বুঝলাম না।

হটাৎ করে দেখলাম বাসের পিছন দিকে বসে থাকা ৩-৪ জন জার্মান যুবক প্রায় দৌড়োতে দৌড়োতে সামনে গিয়ে ড্রাইভারকে ঘিরে ধরলো। আমিও কৌতূহলবসত যুবকগণের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম ব্যাপারটা কি তা অনুমান করার জন্য।ড্রাইভার যুবকদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে তাদের কি যেন বলেই চলছে আর তারা হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষন মাথা নাড়া নাড়ির পর ড্রাইভার, যুবকগণ বাসের দরজা খুলে হুদ্দার করে নেমে গেল। আমি ভাবছি কি করবো ----এদের পিছন পিছন গিয়ে দেখবো ঘটনাটা কি --না বাসেই বসে থাকবো। অন্য যাত্রীরা বাসেই বসে আছে। অধিকাংশই বয়স্ক যাত্রী। আমি ভেবে দেখলাম ড্রাইভার যখন নেমেই গেছে তখন বাস ছেড়ে চলে যাওয়ার সম্ভবনা নেই। নিচে নামলাম। ঠান্ডা ঝোড়ো হাওয়া যেন হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিলো। দেখলাম ড্রাইভার এবং যুবকগণ বাসের পিছন দিকে মানে যেদিক থেকে বাসটি আসছে সেই দিকে হন্তদন্ত হয়ে দৌড়োতে দৌড়োতে যাচ্ছে। আমিও তাদের অনুসরণ করলাম।

প্রায় ৫০০ মিটার যাওয়ার পর দেখলাম রাস্তার ধারে ,ফুটপাতের ওপরে এক বৃদ্ধা মহিলা দু-দুটো বিশাল লাগেজ নিয়ে কোনরকমে যেন দাঁড়িয়ে আছে।চোখে মুখে উদ্বেগ এবং অসহায়তার চিহ্ন স্পষ্ট। দেখে মনে হলো বেশ অসুস্থও বটে। টিপ্ টিপ্ বৃষ্টি এবং ঠাণ্ডা ঝোড়ো হাওয়ার মধ্যে জনমানবহীন সেই রাস্তায় তেনার অবস্থা সঙ্গিন। ড্রাইভার এবং যুবকগণ সেখানে পৌঁছে শোরগোল তুলে দিলো --তাদের হাজারো প্রশ্ন। আমি যতটা বুঝলাম --বৃদ্ধা জার্মান নন , মনে হল পোলিশ অথবা ইতালিয়ান , আগের কোন একটা বাসে তিনি তাঁর গন্তব্যে যাচ্ছিলেন ,ড্রাইভারের সাথে ভাষাগত ভুলবোঝাবুঝির কারণে ভুল স্টপে নেমে পড়েন এবং দীর্ঘ সময় বৃষ্টিভেজা দুযোগপূর্ণ আবহাওয়ায় একাকী দাঁড়িয়ে আছেন।
আমি দেখলাম যুবকগণ বৃদ্ধাকে প্রায় ধরাধরি করে কোলে তুলে বাসের দিকে দৌড় লাগালো আর ড্রাইভার মহোদয় ওই বিশাল দুটো লাগেজকে অবলীলাক্রমে ঘাড়ে তুলে দৌড়াতে থাকলো।আমি ভাবভঙ্গিতে তাকে বোঝাতে চাইলাম সে যেন একটা লাগেজ আমাকে বহন করতে দেয়। কিন্তু সাড়ে ছয় ফিটের ওপর লম্বা -তাগড়া জার্মান ড্রাইভার আমার মত দুর্বল কাঠামোর বঙ্গসন্তানের প্রতি যেন করুণার চোখে চাইলো , কিছু বললো না , স্মিত হেসে আরেকটু জোরে দৌড়াতে লাগলো। তার পিছন পিছন দৌড়োতে দৌড়োতে আমার ছোটবেলায় পড়া একটা বাংলা কবিতার দুটোলাইন নিজের সম্পর্কে প্রযোজ্য হতে পারে মনে হলো : "......তৈল-ঢালা স্নিগ্ধ তনু
নিদ্রারসে ভরা,মাথায় ছোটো বহরে বড়ো বাঙালি সন্তান......!"

বাসে ওই বৃদ্ধাকে যত্ন সহকারে সিটের ওপরে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে , যাত্রীদের কেউ একজন ব্লাঙ্কেট দিয়ে তাঁর শরীর ঢাকা দিয়েছে এবং ড্রাইভার দেখি কাউকে ফোন করছে। তার মুখে পোলজেরি ,পোলজেরি শব্দ শুনে বুঝলাম সে পুলিশে ফোন দিয়েছে। কয়েকমিনিটের মধ্যে এমবুলেন্স সহ পুলিশের গাড়ী হাজির। বৃদ্ধাকে আবার অতি যত্ন সহকারে এমবুলেন্সএ ওঠানো হলো , লাগেজগুলো ওঠানো হলো পুলিশের গাড়িতে। এমবুলেন্স ছেড়ে গেলো ,পিছন পিছন গেলো পুলিশের গাড়ি।

কিন্তু এই সব কান্ডকারখানায় প্রায় ২০-২৫ মিনিট দেরী হয়ে গেছে। বাসটির ইঞ্জিন স্টার্ট করে ড্রাইভার আবার পাবলিক এড্রেস সিস্টেমে কিছু বলতে শুরু করলো। আমি আন্দাজে যতটা বুঝলাম --সে দেরীর জন্য যাত্রীদের কাছে ক্ষমা চাইলো। তার বলা শেষ হলে আমি দেখলাম বাসের যাত্রীরা করতালি দিয়ে ড্রাইভার এবং যুবকদের অভিনন্দন জানালো। বাসটি আবার তীব্র গতিতে চলতে শুরু করলো। আমি একশো শতাংশ নিশ্চিত ছিলাম ওই এম্বুলেন্স এবং পুলিশ কর্মীরা ওই বৃদ্ধাকে যথাযথ সুস্থ করে তোলার পর তার সঠিক গন্তব্যে পৌছে দেবে।

সমস্ত ঘটনাটা সমাপ্ত হওয়ার পর আমার মগজে কিছু ভাবনার উদয় হলো :
এই মধ্য বয়সী জার্মান ড্রাইভার নিশ্চয়ই এক বেতনভূক কর্মচারী। ওই যুবকরা নিতান্তই তরুণ ২০-২২ বছরের মধ্যে হবে। এক শীতের বিকেলে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় বাস থেকে নেমে এক অসহায় ভিনদেশী বৃদ্ধাকে সাহায্য করা ,তার ভারী দুটো লাগেজ কে ঘাড়ে করে বয়ে আনা , এম্বুলেন্স , পুলিশের সাহায্য প্রার্থনা করা এবং এতো কিছুর পরে বাসযাত্রীদের কাছে দেরি হওয়ার জন্য আন্তরিক ভাবে ক্ষমা চাওয়া নিশ্চয় তার জব ডেসক্রিপশনের মধ্যে পড়ে না।আর ওই যাত্রী যুবকরা যে ভাবে ড্রাইভারের কথা মেনে বাসের কমফোর্ট ছেড়ে ওই বৃদ্ধা কে কোলে তুলে নিয়ে এলো --আমি স্তব্ধ হয়ে ভাবছিলাম .....
আমার মনে হয়েছিল মানবিকতাই মানুষের সবচেয়ে বড় গুন এবং ধর্ম হওয়া উচিত ..... মানবিকতাই মনুষত্ব বিচারের একমাত্র মানদণ্ড হওয়া উচিত।
আমার মনে হয়েছিল মানুষের স্রষ্টা যদি কেউ থেকেও থাকেন তাহলে তাঁর মনোনীত ধর্ম হলো মানবিকতা .....এর কিছুটা ঝলক আমি কিছুক্ষণ আগে দেখেছিলাম । এই ধর্মে মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নেই ,দেশ কালের সীমা নেই , আমরা -তোমরা নেই ,স্রষ্টা কে খুশী করে কোন পুরস্কারের প্রত্যাশা নেই।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৫:৩৪
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষায় বসতে না পারার কষ্টটা সমালোচনার কোন বিষয়বস্তু নয়

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৩৬

গতকালের একটি ভাইরাল খবর হচ্ছে কয়েক মিনিটের জন্য বিসিএস পরীক্ষা দেয়া হলো না ২০ প্রার্থীর !! অনেক প্রার্থীর কান্নাকাটির ভিডিও ভাইরাল হয়েছে।এ বিষয়ে পিএসসি চেয়ারম্যান এর নিয়ামানুবর্তিতার জ্ঞান বিতরনের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বারবাজারে মাটির নিচ থেকে উঠে আসা মসজিদ

লিখেছেন কামরুল ইসলাম মান্না, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪০

ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজার ইউনিয়নে মাটির নিচ থেকে মসজিদ পাওয়া গেছে। এরকম গল্প অনেকের কাছেই শুনেছিলাম। তারপর মনে হলো একদিন যেয়ে দেখি কি ঘটনা। চলে গেলাম বারবাজার। জানলাম আসল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরিবর্তন অপরিহার্য গত দেড়যুগের যন্ত্রণা জাতির ঘাড়ে,ব্যবসায়ীরা কোথায় কোথায় অসহায় জানেন কি?

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:৫৭


রমজানে বেশিরভাগ ব্যবসায়ীকে বেপরোয়া হতে দেখা যায়। সবাই গালমন্দ ব্যবসায়ীকেই করেন। আপনি জানেন কি তাতে কোন ব্যবসায়ীই আপনার মুখের দিকেও তাকায় না? বরং মনে মনে একটা চরম গালিই দেয়! আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×