somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শারদীয় দুর্গোৎসবঃ আচার-আনুষ্ঠানিকতার ইতিবৃত্ত

০৮ ই অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৫:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :





বাংলার সনাতন সম্প্রদায়ের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব, শারদীয় দুর্গোৎসব। পুরাণ কিংবা ইতিহাসের পাতা ছেড়ে দিলেও নিকট অতীতে ১৬১০ সালে সপরিবারে দুর্গা পূজার প্রচলন করেন কলকাতার জমিদার সাবর্ণ রায় চৌধুরী। সেই প্রচলিত ধারায় ব্রিটিশ শাসকদের বৃত্তিভোগী জমিদারদের হাত ধরে দুর্গা পূজা সার্বজনীনতা লাভ করে। চলুন জেনে নেওয়া যাক পূজারম্ভ এবং পূজার প্রতিদিনের তাৎপর্য, এক নজরে:

মহালয়া
শারদীয় দুর্গোৎসবের তিন পর্ব; মহালয়া, বোধন, আর সন্ধিপূজা। মহালয়ায় পিতৃপক্ষ সাঙ্গ করে দেবীপক্ষের দিকে যাত্রা শুরু হয়। এদিন মণ্ডপে মণ্ডপে অধিষ্ঠান করেন মা মহামায়া।
চণ্ডী পাঠের মধ্য দিয়ে দেবীকে মর্ত্যলোকে আহবান জানানো হয়। শারদীয় দুর্গাপূজার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ এই মহালয়া। মহালয়ার পর মহাষষ্ঠী বা বোধনের মধ্য দিয়ে মূল দুর্গোৎসবের শুরু হয়।
মানবের কল্যাণ প্রতিষ্ঠায় মহাশক্তির প্রতীক দেবী দুর্গা। ভক্তের জীবনে মায়ের মতোই তাঁর আবির্ভাব ও ভূমিকা। এ জন্যই তিনি সকলের মা দুর্গা। প্রতি বছর শরৎকালে হিমালয়ের কৈলাসে নিজের সংসার ছেড়ে দেবী মর্ত্যে আসেন। ভক্তদের কল্যাণ সাধন করে শত্রুর বিনাশ ও সৃষ্টিকে পালন করতে। সঙ্গে থাকেন সব ছেলেমেয়ে; জ্ঞানের দেবী সরস্বতী, ঐশ্বর্যের দেবী লক্ষ্মী, সিদ্ধিদাতা গণেশ এবং বলবীর্য ও পৌরুষের প্রতীক দেব-সেনাপতি কার্তিক। এবারে দেবী এসেছেন নৌকায় এবং ফিরবেন ঘোড়ায় চড়ে।

বোধন বা ষষ্ঠী পূজা
শরৎকাল সূর্যের দক্ষিণায়ণের সময়। পুরাণমতে দেবতাদের রাত্রিকাল। তাই শরৎকাল পূজার্চনার উপযুক্ত সময় নয়। অকালে দেবতার পূজা করতে হলে তাঁকে জাগরিত করতে হয়। জাগরণের এই প্রক্রিয়াটিকেই বলা হয় ‘বোধন’।
মহাশক্তির মহাপূজার সূচনা হয় বোধনের মধ্য দিয়ে। দেবীপক্ষের শুক্লাষষ্ঠী তিথিতে দেবীকে উদবোধিত করে দেবী দুর্গার বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাসের মধ্য দিয়ে শুরু হয় পাঁচ দিনব্যাপী আনুষ্ঠানিকতা।
মূল প্রতিমায় দেবীর রূপ কল্পনা করে আট উপাচারের মাধ্যমে ষষ্ঠী পূজায় ভক্তরা দেবীবন্দনা শুরু করেন। যদিও প্রচলিত বিশ্বাস এই যে, দেবী পূজার শ্রেষ্ঠ সময় বসন্তকাল। চৈত্রমাসের শুক্লাষষ্ঠী থেকে নবমী পর্যন্ত দেবীর বাসন্তী পূজার রীতিও বাংলায় প্রচলিত আছে।

মহা সপ্তমী পূজা
মহাসপ্তমীতে ষোড়শাচারে অর্থাৎ ষোলটি উপাদানে দেবীর পূজা হয়। উৎসবের এই দিন সকালে ত্রিনয়নী দেবী দুর্গার চক্ষুদান করা হয়। সকালে দেবীকে আসন, বস্ত্র, নৈবেদ্য, স্নানীয়, পুষ্পমাল্য, চন্দন, ধূপ ও দীপ দিয়ে ভক্তরা অর্চণা করেন।
সপ্তমীর উপকরণে কিছুটা ভিন্নতা থাকলেও সকল পূজার অনুরূপ সব ধরণের উপঢৌকন প্রয়োজন হয়। একশো আট প্রকার দ্রব্য ও নব পত্রিকা স্নানান্তে দেবীকে আসনে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। স্থাপন ও সপ্তাদি কল্পারম্ভ, দেবীর পায়ে ভক্তদের অঞ্জলি প্রদানসহ নানা আয়োজনে মহাসপ্তমী পূজা উদযাপিত হয়।

মহাষ্টমী পূজা বা কুমারী পূজা
শাস্ত্রমতে, কোলাসুরকে বধ করার মধ্য দিয়ে কুমারী পূজার উদ্ভব। এই কোলাসুর এক সময় স্বর্গ-মর্ত্য অধিকার করায় বিপন্ন দেবগণ মহাকালীর শরণাপন্ন হন। সেসময় দেবতাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে দেবী পুনর্জন্ম নিয়ে কুমারীরূপে কোলাসুরকে বধ করেন। এরপর থেকেই মর্ত্যে কুমারী পূজার প্রচলন।
হিন্দু শাস্ত্রমতে, সাধারণত এক বছর থেকে ১৬ বছরের অজাতপুষ্প সুলক্ষণা কুমারীকে পূজার উল্লেখ রয়েছে। ব্রাহ্মণ, অবিবাহিত কন্যা অথবা অন্য গোত্রের অবিবাহিত কন্যাকেও পূজার বিধান রয়েছে। বয়সভেদে কুমারীর নাম হয় ভিন্ন। অষ্টমী পূজার দিন জবরদস্তি ও অকল্যাণের প্রতীক মহিষাসুর বধের চূড়ান্ত পর্যায়।
সকালে কুমারী পূজা, অঞ্জলি প্রদান ও রাতে সন্ধি পূজার মধ্যে দিয়ে মহাঅষ্টমী পূজা পালিত হয়। সনাতনশাস্ত্রে নারীকে শক্তি আর সমৃদ্ধির প্রতীক বিবেচনা করা হয়। শুদ্ধাত্মা কুমারীতে ভগবতীর বেশি প্রকাশ। পৃথিবীতে সব নারীর মাঝেই মা রূপে বিরাজ করেন দেবী দূর্গা। আর সেই দেবীকে সম্মান জানাতেই অষ্টমীতে আয়োজন করা হয় কুমারী পূজার।
১৬টি উপকরণ দিয়ে পূজার আনুষ্ঠানিকতার সূত্রপাত হয়। শুরুতেই গঙ্গাজল ছিটিয়ে ‘কুমারী মা’কে পরিপূর্ণ শুদ্ধ করে তোলা হয়। এরপর ‘কুমারী মা’র চরণযুগল ধুয়ে তাকে বিশেষ অর্ঘ্য প্রদান করা হয়। অর্ঘ্যের শঙ্খপাত্রকে সাজানো হয় গঙ্গাজল, বেল পাতা, আতপ চাল, চন্দন, পুষ্প ও দূর্বাঘাস দিয়ে। অর্ঘ্য প্রদানের পর দেবীর গলায় পরানো হয় পুষ্পমাল্য। এরপর অগ্নি, জল, বস্ত্র, পুষ্প ও বাতাস- এই পাঁচ উপকরণ দেওয়া হয় ‘কুমারী’ পূজাতে।

মহা নবমী
শাস্ত্রে মতে, নবমী পূজার মাধ্যমে মানবকুলের সম্পদ লাভ হয়। শাপলা-শালুক ও বলিদানের সঙ্গে নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে নবমী পূজা পালিত হয়। শাস্ত্রবিধি মতে, নবমীতেই দেবী বন্দনার সমাপ্তি। তাই ভক্তরা প্রার্থনা করতে থাকেন দেবীর উদ্দেশ্যে। যজ্ঞের মাধ্যমে দেবী দুর্গার কাছে আহুতি দেওয়া হয়। ১০৮টি বেল পাতা, আম কাঠ ও ঘি দিয়ে এই যজ্ঞ করা হয়।
ধর্মের গ্লানি আর অধর্ম রোধ, সাধুদের সেবা, অসুরের বধ আর ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতি বছর দুগর্তিনাশিনী দেবী দুর্গা ভক্তদের মাঝে আবির্ভূত হন।

শুভ বিজয়া বা বিজয়া দশমী
নবমীর উচ্ছ্বাস-আনন্দের পরই বিদায়ের সুর নিয়ে আসে বিজয়া দশমী। বছরের আশ্বিন-কার্তিকের পঞ্চমী থেকে দশমী তিথির পাঁচটি দিবস ‘জগজ্জননী’ দেবী পিতৃগৃহ ঘুরে যান। পাঁচ দিনের শারদ উৎসব শেষ হয় বিজয়া দশমীর মধ্য দিয়ে। বিজয়া দশমীতে বিহিত বিসর্জনাঙ্গ পূজা, বিসর্জন, বিজয়া দশমী কৃত্য ও কুলাচারানুসারে বিসর্জনান্তে অপরাজিতা পূজা হয়। এজন্য দশমী তিথিই বিজয়া দশমী নামে খ্যাত।
প্রথমে দেবীবরণ। তারপর সিঁদুরখেলা, মিষ্টি বিরতণের মধ্য দিয়ে বিদায়পর্বের সূচনা। দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গা মর্ত্যলোক ছেড়ে স্বর্গশিখর কৈলাসে স্বামীগৃহে ফিরে যান। পেছনে ফেলে যান ভক্তদের শ্রদ্ধা ও আনন্দমাখা জল। ভক্তদের কাছে রেখে যান আগামী বছরে ফিরে আসার অঙ্গীকার।


লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছে সেপ্টেম্বর ২০১৭ তে আইস টুডে’র এই লিংকে।
http://icetoday.net/2017/09/sharodio-durga-festival/


বিনয় দত্ত
কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার ও গণমাধ্যমকর্মী
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৫:২৩
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×