১.
বাংলা জীবনমুখী গানে বোর্ডিং ফেরত গায়ক এবং ভারতীয় উপমহাদেশের বোহেমিয়ান রকস্টার হিসেবে খ্যাত একজনই, যিনি নিজেকে একজন সফল গায়কের পাশাপাশি সফল গীতিকার, সুরকার, সফল অভিনেতা এবং সফল চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে পর্দায় হাজির করেছেন। শুধু পর্দায়ই নয়, তিনি নিজের অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব দিয়ে, নিজের মোহনীয় আর্কষণ ক্ষমতা দিয়ে সবাইকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করে রেখেছেন। বলছিলাম অঞ্জন দত্তের কথা।
অঞ্জন দত্তের চরিত্রের সবচেয়ে বড় গুণ হল নিজের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের স্বতন্ত্রতা। এই স্বতন্ত্রতা সবার মধ্যে থাকে না। এইটা শুধু অঞ্জন দত্তের মধ্যেই আছে। এবং অঞ্জন দত্ত একজনই যিনি এই স্বতন্ত্রতা ধারণ করেন। কে কি মনে করল, কে কিভাবে তাঁকে গ্রহণ করল তাতে তাঁর কিসসু যায় না। এই ভাবনাটা যার মধ্যে বিদ্যমান বা যিনি এইভাবে নিজেকে ভাবতে পারেন তিনি কতটা উদার এবং একরৈখিক তা আর কেউ জানুক না জানুক অন্তত তাঁর ভক্ত, শুভানুধ্যায়ীরা খুব ভালো করেই জানেন।
বিষয়টা আরো সহজ করে বলি, একজন জনপ্রিয় লোক বা ব্যক্তিত্ব অনেকভাবে নিজেকে পরিশুদ্ধ করেন, অনেকভাবে নিজের ভালো গুণ যেমন সবাইকে জানিয়ে বেড়ান একইভাবে খারাপ গুণগুলোকে চাপা দিতে থাকেন এইক্ষেত্রে অঞ্জন দত্ত একদমই ভিন্ন। তিনি সবসময় নিজের ভালোলাগাকে, নিজের সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। নিজের স্বতন্ত্র চারিত্রিক বৈশিষ্টই সবাইকে দেখিয়েছেন। আলাদা করে মেকি কিছু কাউকে দেখাননি। এতে করে মাঝে মাঝে তাঁর নিজের গণ্ডির লোকজনের সাথে তাঁর সম্পর্ক খারাপ হলেও তিনি পরবর্তীতে তা নিজের বিচক্ষণতা দিয়ে সামলে নিয়েছেন।
২.
জীবনমুখী গানের গায়ক হিসেবে অঞ্জন দত্তের সঙ্গীতে আত্মপ্রকাশ। নব্বইয়ের দশকে ‘বেলা বোস’, ‘রঞ্জনা’, ‘আমি বৃষ্টি দেখেছি’, ‘আলীবাবা’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘আকাশভরা সূর্যতারা’ এই গানগুলো পশ্চিমবঙ্গে যেমন জনপ্রিয় তেমন জনপ্রিয় বাংলাদেশেও। শুধু তাই নয় ‘২৪৪১১৩৯’ এই নম্বরটা সবার মনে এমন গভীরভাবে গেঁথে গিয়েছিল যে অসংখ্য মানুষ এই নম্বরে ফোন দিয়ে বেলা বোসের খোঁজ করতো। তারা বেলা বোসকে খুঁজে অঞ্জন দত্তের দুঃখের কথা বলতে চাইতো। কেউ কেউ আবার নিজেদের প্রেমিকার মধ্যে বেলা বোসকে খুঁজে বেড়াতো। কিংবা পাড়ার অত্যাচারী বড়ভাই অথবা দাদাদের কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য রঞ্জনাকে খুঁজেনি এমন তরুণের সংখ্যাও কম নয়। এইসব গান শুধু গানই ছিল না, ছিল এক একটা বিশাল গল্পের সমাহারের ডালা। এইসব গান শুনলে তখন তো বটেই এখনো নিজের মধ্যে কেমন অনুরণন ঘটে।
অঞ্জন দত্ত সবসময় নিজের কাজের প্রতি শতভাগ সৎ ছিলেন। সৎ ছিলেন বলে প্রতি বছরে একের পর গানের অ্যালবাম করেননি। ১৯৯৪ সালের ‘শুনতে কি চাও?’ একক অ্যালবাম দিয়ে শুরু করলেও তার ধারাবাহিকতায় ২০০১ সালে ‘রং পেন্সিল’ একক অ্যালবাম করার পর দীর্ঘ বিরতি দিয়ে দেন। কারণ তখন তাঁর মাথায় ভালো কোনো গান আসছিল না, ভালো কোনো গানের সুর তিনি পাচ্ছিলেন না তাই নতুন গান তৈরি করে বন্ধ করে পুরানো গানগুলোই প্রতিনিয়ত গেয়ে যাচ্ছিলেন। পরবর্তীতে দীর্ঘ বিরতির পরে ২০১৪ সালে ‘ঊনসাট’ একক অ্যালবামটি করেন। যার গানের প্রতি এতো নিষ্ঠা, এতো সততা তাঁর গান দর্শক মনে রাখবে না তো কার গান মনে রাখবে।
সততার সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত অঞ্জন দত্ত রাখেন তাঁর জীবনে। নিজের মতো করে বাঁচতে চেয়েছিলেন, একজন পূর্ণাঙ্গ শিল্পী হতে চেয়েছিলেন তাই তো তিনি কর্পোরেট চাকরি, কর্পোরেট লাইফ ছেড়ে দিয়েছিলেন। এতে তাঁর অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। পরিবারে আয়ের জন্য মায়ের বুনে দেওয়া সোয়েটার নিয়ে বিক্রি করতে হয়েছিল। কোনো ধরনের আপোষে তিনি যাননি, নিজের জীবনকে বিকিয়ে দেননি।
৩.
অঞ্জন দত্ত সবসময় নিজের স্বাতন্ত্রতা খুঁজে বেড়িয়েছেন। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেনের হাত ধরে তিনি চলচ্চিত্রে পা দেন। প্রথমে অভিনয় দিয়ে শুরু করলেও একসময় তিনি চলচ্চিত্র পরিচালক এবং প্রযোজক হিসেবে সফল দৃষ্টান্ত গড়েন। ১৯৯৮ সালে হিন্দি চলচ্চিত্র ‘বড়দিন’ দিয়ে শুরু করলেও ইংরেজি ভাষার চলচ্চিত্র ‘বো ব্যারাক ফরএভার’ নির্মাণ করেছেন। বাংলা ভাষায় ‘দ্যা বং কানেকশন’, ‘ম্যাডলি বাঙ্গালী’, ‘ব্যোমকেশ বক্সী’, ‘রঞ্জনা আমি আর আসবোনা’, ‘আবার ব্যোমকেশ’, ‘দত্ত ভার্সেস দত্ত’, ‘গণেশ টকিজ’, এবং ‘ব্যোমকেশ ও চিড়িয়াখানা’র মত তুমুল জনপ্রিয় চলচ্চিত্র তিনি দর্শকদের উপহার দেন। এরমধ্যে ‘দত্ত ভার্সেস দত্ত’ চলচ্চিত্রে আমরা ব্যক্তি অঞ্জন দত্তের জীবনকে দেখতে পায় সুন্দর গল্প বলার মধ্যদিয়ে।
চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে অঞ্জন দত্ত যতটা খ্যাতিমান অভিনেতা হিসেবে তাঁর জনপ্রিয়তা ঈর্ষণীয়। উপমহাদেশের বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় এর চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন। এছাড়াও মৃণাল সেন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, অপর্ণা সেন, গৌতম ঘোষ, সৃজিত মুখার্জির মতো বড় বড় চলচ্চিত্র পরিচালকদের চলচ্চিত্রেও তিনি অভিনয় করেছেন।
৪.
একজন স্বতন্ত্র চরিত্র অঞ্জন দত্ত, যিনি জীবনে জনপ্রিয় হতে চেয়েছিলেন এবং হয়েছেনও। তাঁর এই স্বতন্ত্রতা জীবনের শুরু থেকেই ছিল। সঙ্গীত এবং চলচ্চিত্রের দিকে ঝুঁকিছিলেন দেখে তাঁর বাবা ছয় মাস কথা বন্ধ রেখেছিলেন। যেই বিষয়টা যখন ভালো মনে করেছেন তখন তাই-ই করেছেন। কোনো কিছুর সাথে কখনো আপোষ করেননি। দীর্ঘ বিশ বছর ধরে তাঁর গান সকলে গাইছে, তাঁর অভিনয় দেখে সবাই মুগ্ধ হয়েছে, তাঁর চলচ্চিত্রগুলো দর্শক লুফে নিয়েছে। তাঁর বোহেমিয়ান আচার-আচরণ সবাই সহ্য করছেন। কারণ তাঁর স্বতন্ত্রতা তাঁর সৃজনশীল, সৃষ্টিশীল কাজে কোনো প্রভাব ফেলেনি আর প্রভাব ফেলবেও না। এইরকম একজন ‘দত্ত ভার্সেস দত্ত, অঞ্জন দত্ত’ যুগ যুগ আমাদের মাঝে টিকে থাকবে এইটা আমরা সবাই আশা করি।
লেখাটির সংক্ষেপিত ও সংশোধিত রূপ প্রথম ২৩ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে আইস টুডে’এর এই লিংকে প্রকাশিত হয়েছে। এইখানে লেখাটির পূর্ণ রূপ প্রকাশ করা হল।
http://icetoday.net/2018/01/দতà§à¦¤-ঠà¦à§à¦à¦¨-দতà§à¦¤/
বিনয় দত্ত
সাহিত্যিক, নাট্যকার ও গণমাধ্যমকর্মী
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা এপ্রিল, ২০১৮ সকাল ৯:২৬