somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দত্ত ভার্সেস দত্ত, অঞ্জন দত্ত

০৩ রা এপ্রিল, ২০১৮ সকাল ৯:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




১.
বাংলা জীবনমুখী গানে বোর্ডিং ফেরত গায়ক এবং ভারতীয় উপমহাদেশের বোহেমিয়ান রকস্টার হিসেবে খ্যাত একজনই, যিনি নিজেকে একজন সফল গায়কের পাশাপাশি সফল গীতিকার, সুরকার, সফল অভিনেতা এবং সফল চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে পর্দায় হাজির করেছেন। শুধু পর্দায়ই নয়, তিনি নিজের অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব দিয়ে, নিজের মোহনীয় আর্কষণ ক্ষমতা দিয়ে সবাইকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করে রেখেছেন। বলছিলাম অঞ্জন দত্তের কথা।
অঞ্জন দত্তের চরিত্রের সবচেয়ে বড় গুণ হল নিজের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের স্বতন্ত্রতা। এই স্বতন্ত্রতা সবার মধ্যে থাকে না। এইটা শুধু অঞ্জন দত্তের মধ্যেই আছে। এবং অঞ্জন দত্ত একজনই যিনি এই স্বতন্ত্রতা ধারণ করেন। কে কি মনে করল, কে কিভাবে তাঁকে গ্রহণ করল তাতে তাঁর কিসসু যায় না। এই ভাবনাটা যার মধ্যে বিদ্যমান বা যিনি এইভাবে নিজেকে ভাবতে পারেন তিনি কতটা উদার এবং একরৈখিক তা আর কেউ জানুক না জানুক অন্তত তাঁর ভক্ত, শুভানুধ্যায়ীরা খুব ভালো করেই জানেন।
বিষয়টা আরো সহজ করে বলি, একজন জনপ্রিয় লোক বা ব্যক্তিত্ব অনেকভাবে নিজেকে পরিশুদ্ধ করেন, অনেকভাবে নিজের ভালো গুণ যেমন সবাইকে জানিয়ে বেড়ান একইভাবে খারাপ গুণগুলোকে চাপা দিতে থাকেন এইক্ষেত্রে অঞ্জন দত্ত একদমই ভিন্ন। তিনি সবসময় নিজের ভালোলাগাকে, নিজের সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। নিজের স্বতন্ত্র চারিত্রিক বৈশিষ্টই সবাইকে দেখিয়েছেন। আলাদা করে মেকি কিছু কাউকে দেখাননি। এতে করে মাঝে মাঝে তাঁর নিজের গণ্ডির লোকজনের সাথে তাঁর সম্পর্ক খারাপ হলেও তিনি পরবর্তীতে তা নিজের বিচক্ষণতা দিয়ে সামলে নিয়েছেন।

২.
জীবনমুখী গানের গায়ক হিসেবে অঞ্জন দত্তের সঙ্গীতে আত্মপ্রকাশ। নব্বইয়ের দশকে ‘বেলা বোস’, ‘রঞ্জনা’, ‘আমি বৃষ্টি দেখেছি’, ‘আলীবাবা’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘আকাশভরা সূর্যতারা’ এই গানগুলো পশ্চিমবঙ্গে যেমন জনপ্রিয় তেমন জনপ্রিয় বাংলাদেশেও। শুধু তাই নয় ‘২৪৪১১৩৯’ এই নম্বরটা সবার মনে এমন গভীরভাবে গেঁথে গিয়েছিল যে অসংখ্য মানুষ এই নম্বরে ফোন দিয়ে বেলা বোসের খোঁজ করতো। তারা বেলা বোসকে খুঁজে অঞ্জন দত্তের দুঃখের কথা বলতে চাইতো। কেউ কেউ আবার নিজেদের প্রেমিকার মধ্যে বেলা বোসকে খুঁজে বেড়াতো। কিংবা পাড়ার অত্যাচারী বড়ভাই অথবা দাদাদের কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য রঞ্জনাকে খুঁজেনি এমন তরুণের সংখ্যাও কম নয়। এইসব গান শুধু গানই ছিল না, ছিল এক একটা বিশাল গল্পের সমাহারের ডালা। এইসব গান শুনলে তখন তো বটেই এখনো নিজের মধ্যে কেমন অনুরণন ঘটে।
অঞ্জন দত্ত সবসময় নিজের কাজের প্রতি শতভাগ সৎ ছিলেন। সৎ ছিলেন বলে প্রতি বছরে একের পর গানের অ্যালবাম করেননি। ১৯৯৪ সালের ‘শুনতে কি চাও?’ একক অ্যালবাম দিয়ে শুরু করলেও তার ধারাবাহিকতায় ২০০১ সালে ‘রং পেন্সিল’ একক অ্যালবাম করার পর দীর্ঘ বিরতি দিয়ে দেন। কারণ তখন তাঁর মাথায় ভালো কোনো গান আসছিল না, ভালো কোনো গানের সুর তিনি পাচ্ছিলেন না তাই নতুন গান তৈরি করে বন্ধ করে পুরানো গানগুলোই প্রতিনিয়ত গেয়ে যাচ্ছিলেন। পরবর্তীতে দীর্ঘ বিরতির পরে ২০১৪ সালে ‘ঊনসাট’ একক অ্যালবামটি করেন। যার গানের প্রতি এতো নিষ্ঠা, এতো সততা তাঁর গান দর্শক মনে রাখবে না তো কার গান মনে রাখবে।
সততার সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত অঞ্জন দত্ত রাখেন তাঁর জীবনে। নিজের মতো করে বাঁচতে চেয়েছিলেন, একজন পূর্ণাঙ্গ শিল্পী হতে চেয়েছিলেন তাই তো তিনি কর্পোরেট চাকরি, কর্পোরেট লাইফ ছেড়ে দিয়েছিলেন। এতে তাঁর অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। পরিবারে আয়ের জন্য মায়ের বুনে দেওয়া সোয়েটার নিয়ে বিক্রি করতে হয়েছিল। কোনো ধরনের আপোষে তিনি যাননি, নিজের জীবনকে বিকিয়ে দেননি।

৩.
অঞ্জন দত্ত সবসময় নিজের স্বাতন্ত্রতা খুঁজে বেড়িয়েছেন। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেনের হাত ধরে তিনি চলচ্চিত্রে পা দেন। প্রথমে অভিনয় দিয়ে শুরু করলেও একসময় তিনি চলচ্চিত্র পরিচালক এবং প্রযোজক হিসেবে সফল দৃষ্টান্ত গড়েন। ১৯৯৮ সালে হিন্দি চলচ্চিত্র ‘বড়দিন’ দিয়ে শুরু করলেও ইংরেজি ভাষার চলচ্চিত্র ‘বো ব্যারাক ফরএভার’ নির্মাণ করেছেন। বাংলা ভাষায় ‘দ্যা বং কানেকশন’, ‘ম্যাডলি বাঙ্গালী’, ‘ব্যোমকেশ বক্সী’, ‘রঞ্জনা আমি আর আসবোনা’, ‘আবার ব্যোমকেশ’, ‘দত্ত ভার্সেস দত্ত’, ‘গণেশ টকিজ’, এবং ‘ব্যোমকেশ ও চিড়িয়াখানা’র মত তুমুল জনপ্রিয় চলচ্চিত্র তিনি দর্শকদের উপহার দেন। এরমধ্যে ‘দত্ত ভার্সেস দত্ত’ চলচ্চিত্রে আমরা ব্যক্তি অঞ্জন দত্তের জীবনকে দেখতে পায় সুন্দর গল্প বলার মধ্যদিয়ে।
চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে অঞ্জন দত্ত যতটা খ্যাতিমান অভিনেতা হিসেবে তাঁর জনপ্রিয়তা ঈর্ষণীয়। উপমহাদেশের বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় এর চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন। এছাড়াও মৃণাল সেন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, অপর্ণা সেন, গৌতম ঘোষ, সৃজিত মুখার্জির মতো বড় বড় চলচ্চিত্র পরিচালকদের চলচ্চিত্রেও তিনি অভিনয় করেছেন।

৪.
একজন স্বতন্ত্র চরিত্র অঞ্জন দত্ত, যিনি জীবনে জনপ্রিয় হতে চেয়েছিলেন এবং হয়েছেনও। তাঁর এই স্বতন্ত্রতা জীবনের শুরু থেকেই ছিল। সঙ্গীত এবং চলচ্চিত্রের দিকে ঝুঁকিছিলেন দেখে তাঁর বাবা ছয় মাস কথা বন্ধ রেখেছিলেন। যেই বিষয়টা যখন ভালো মনে করেছেন তখন তাই-ই করেছেন। কোনো কিছুর সাথে কখনো আপোষ করেননি। দীর্ঘ বিশ বছর ধরে তাঁর গান সকলে গাইছে, তাঁর অভিনয় দেখে সবাই মুগ্ধ হয়েছে, তাঁর চলচ্চিত্রগুলো দর্শক লুফে নিয়েছে। তাঁর বোহেমিয়ান আচার-আচরণ সবাই সহ্য করছেন। কারণ তাঁর স্বতন্ত্রতা তাঁর সৃজনশীল, সৃষ্টিশীল কাজে কোনো প্রভাব ফেলেনি আর প্রভাব ফেলবেও না। এইরকম একজন ‘দত্ত ভার্সেস দত্ত, অঞ্জন দত্ত’ যুগ যুগ আমাদের মাঝে টিকে থাকবে এইটা আমরা সবাই আশা করি।


লেখাটির সংক্ষেপিত ও সংশোধিত রূপ প্রথম ২৩ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে আইস টুডে’এর এই লিংকে প্রকাশিত হয়েছে। এইখানে লেখাটির পূর্ণ রূপ প্রকাশ করা হল।
http://icetoday.net/2018/01/দত্ত-অঞ্জন-দত্ত/



বিনয় দত্ত
সাহিত্যিক, নাট্যকার ও গণমাধ্যমকর্মী
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা এপ্রিল, ২০১৮ সকাল ৯:২৬
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×