somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমাদের বড়পা (একটা ছোট গল্প)

২৫ শে জুন, ২০১৮ দুপুর ২:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




শপিং-এ এসেছি, শুক্রাবাদের মেট্রো শপিং মলে।

আমি একটু সামনে ছিলাম, আমার বড় দুই বোন একটু পিছনে। হঠাৎ পিছনে তাকিয়ে দেখি বড়পার সামনে কাছ ঘেষে একলোক দাড়িয়ে কিছু বলছে, আর আমার দুইবোন জড়োসড়ো হয়ে দাড়িয়ে আছে। আমি পিছিয়ে এসে লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম, 'কি ব্যাপার?' লোকটা আমার দিকে একঝলক তাকিয়ে 'না, কিছু না' বলে চলে গেল।

দুজনেরই চেহারা দেখলাম ফ্যাকাশে।
বড়পা বললো, 'সিমি চল, বাসায় চলে যাই। এখন আর কেনাকাটা করবো না।'
ছোড়পা-ও বললো, 'হ্যা, চল।'
আমি কিছুই বুঝলাম না, কি হচ্ছে। ওদের দু’জনকেই বললাম, 'ঘটনা কি, তা তো বলবি, হঠাৎ চলে যাচ্ছিস যে?'
ছোড়পা আমার প্রশ্ন সম্পূর্ন উপেক্ষা করে বললো, 'আমরা বাসায় যাচ্ছি। তোর কি না কি জরুরী কাজ আছে বলেছিলি? যা সেরে আয়।' এটুকু বলেই ওরা দু’জন হাটা দিল। সকালে বাসা থেকে বেরুচ্ছিলাম, দু’জন আমাকে জোর করে মার্কেটে নিয়ে এসেছে। জরুরী কাজ আছে বলার পরও কাজ হয়নি, আর এখন কেনাকাটা না করেই চলে যাচ্ছে! কিছুই না বুঝে উজবুকের মতো হা করে দাড়িয়ে থাকলাম!
বড়পার সাথে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে হঠাৎ ফিরে এসে ছোড়পা বললো, ’জামিল, এই লোকটার সাথেই না বড়পার বিয়ে হয়েছিল।’

আমরা চার ভাইবোন। আমি জামিল, ১৯ বছর বয়স। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বছর ভর্তি হয়েছি তবে তার আগে থেকেই সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পরেছি। 'জিনিস পত্র' নাড়াচাড়ায় বিশেষ দক্ষতা থাকায় বড়ভাইদের বিশেষ সুনজরে আছি। আমার বন্ধুরা বলে আমার রাগ এবং সাহস অত্যন্ত বেশী, বলার অবশ্য বেশকিছু কারনও আছে। তবে এসবের কোন কিছুই আমার বাসার কেউ জানে না।

বড় বোন রিমি, বয়স ২৯ বছর। যাকে আমরা সবাই বড়পা (বড়+আপা, সংক্ষেপে বড়পা) বলি। অল্প বয়সে একবার বিয়ে হয়েছিল, সে ঘটনায় একটু পরে আসছি। আমার ধারনা, আল্লাহ্ ভদ্র এবং শান্ত-শিষ্ট, সেইসঙ্গে মায়া ভরা চেহারার যে অল্প কয়টি মেয়ে বানিয়েছেন; আমাদের বড়পা তাদের মধ্যে একজন। আমাদের অতি প্রিয় বড়পা একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে ছোটখাট চাকুরী করে।

তারপর সিমি, বড়পার থেকে পাচ বছরের ছোট এবং আমাদের ছোট দুই ভাই এর ছোড়পা (বড়পা’র সাথে মিল রেখে ডাকি)। সেও চাকুরী করে এবং যতোদুর জানি তার এক কলীগের সাথে প্রেমও করে। । তারপর আমি। আর সবশেষে রোমেল, অত্যন্ত ব্রিলিয়ান্ট একটি ছেলে।

আমাদের সবার পরিচয় দিলাম। এবার আজকের ঘটনায় ফিরে আসি। ছোড়পার কথায় এক ঝটকায় অনেক বছর আগে ফিরে গেলাম। সেটা ছিল কোন এক অখ্যাত মফস্বল শহরের একটা অতি সাধারন নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের আকস্মিক ঝড়ে লন্ডভন্ড হওয়ার কাহিনী। তখন আমি অনেক ছোট। বলতে গেলে কিছুই আমার মনে নাই, সবটাই বিভিন্ন সময়ে শোনা টুকরা টুকরা কথা জোড়া লাগানো একটা ঘটনার আকৃতি বিশেষ!

বাবা ছিলেন স্কুল টিচার। এলাকার এক প্রভাবশালীর ছেলের নজর পরে আমার বোনের উপর। বড়পা তখন ক্লাশ টেনের ছাত্রী। এসব ঘটনায় যা হয় আর কি! উত্যক্তের অভিযোগের উপর ভিত্তি করে সালীশ বসে। বখাটে ছেলেটা পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য আমার বাবার কাছে মাফ চায় এবং তার পাচ দিনের মাথায় দিনে-দুপুরে আমার বোনকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যায়। এলাকায় আমাদের পরিবারের একটা ভালো ইমেজ থাকায় আবার সালীশ বসে এবং সালীশের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ছেলের পরিবার বড়পাকে তাদের বাড়ীর বউ হিসাবে তুলে নিতে বাধ্য হয়।

এর ঠিক ছয় মাসের মাথায় বড়পা ওদের বহুমুখী অত্যাচারে টিকতে না পেরে তালাক নিয়ে বাসায় ফিরে আসে। এরপরের ঘটনা আরো খারাপ। বাবা কিছু করতে যাওয়ার আগেই ওরা প্রভাব খাটিয়ে মিথ্যা মামলায় বাবাকে তিন মাসের জেল খাটায়। আরো হুমকি দেয় এবার বাড়াবাড়ি করলে ছোট মেয়ের অবস্থাও বড় মেয়ের মতোই হবে! ওদের সাথে না পেরে শেষ পর্যন্ত বাবা বাড়ী বিক্রি করে ঢাকায় চলে আসেন। কিন্তু জেলে গিয়ে বাবার সেই যে স্বাস্থ্য ভেঙ্গে যায় তা আর ঠিক হয় নি।

ঢাকায় এসে বাবা আদরের মেয়েকে আবার বিয়ে দেয়ার আপ্রান চেষ্টা চালান, কিন্তু বড়পা এবার গো ধরে বসে, কোন কিছু গোপন করে সে বিয়ে করবে না। সব মিলিয়ে স্বাস্থ্যের সাথে সাথে বাবার মনও ভেঙ্গে যায়। শেষ পর্যন্ত শরীর আর এসব টানতে পারে নি। বছর পাচেক আগে বাবা মারা যান। মারা যাওয়ার আগের পাচ-ছয় মাস শুধু বড়পাকে বলতেন, 'মা রে, তোর জন্য আমি কিছুই করতে পারলাম না। আমি একটা অপদার্থ, ব্যর্থ বাবা। আমাকে মাফ করে দিস।'

এসব কথা মনে করে আগে আমি রাতে কতোবার বালিশ ভিজিয়েছি! তবে এখন আমি অনেক শক্ত, কান্নার বিলাসিতা আমার মধ্যে আর নাই। কিন্তু আজ এতোদিন পরে এসব ফের মনে আসাতে মনে হচ্ছে একটু কাদতে পারলে ভালো হতো। চোখ দু’টো কেমন শুকনো, খরখরে লাগছে। বুকের ভিতরে কেমন একটা থম ধরা কষ্ট! নিঃশ্বাস নিতেও যেন কষ্ট হচ্ছে!

লোকটা এখনও মার্কেটের ভিতরেই আছে। একঝলক দেখাতেই জানোয়ারটার চেহারাটা আমার মগজে গেথে গিয়েছে, হাজার মানুষের ভীড়েও ওটাকে আলাদা করা কোন ব্যাপারই না! দুই বন্ধুকে ফোন করলাম, কাছাকাছিই আছে। মটর সাইকেলে পাচ মিনিটেই এসে যাবে। ’জিনিস’ ও ওদের সাথেই আছে। আজ মনে হচ্ছে বুকের ভিতর থেকে একটা বিশাল বোঝা নেমে যাবে।

একটা অন্যরকম প্রশান্তি অনুভব করছি। সিগারেট ধরিয়ে অপেক্ষায় থাকলাম। অপেক্ষার ক্ষণও মাঝে মাঝে এতো মধুর হয়!!!

ছবিঃ গুগল মামার সৌজন্যে
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মে, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৩৬
২৮টি মন্তব্য ২৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×