প্রিয় বর্ষা,
তোমাকে........না, বরং বলা যায় কোন মেয়েকে এমনভাবে চিঠি লিখবো কোনদিন ভাবিনি। এতোদিন জেনে এসেছি প্রেম-ভালোবাসা আমার জন্য না; আসলে আমি বোঝাতে চাইছি, আমার পক্ষে কোন মেয়েকে প্রপোজ করা সম্ভব না। অন্ততঃ এমনটাই নিজের সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল। কারন, একটু ছন্নছাড়া, অনেকটা বোহেমিয়ান টাইপ বলতে যা বোঝায় তেমন ধরনেরই মানুষ আমি!
তুমি সম্ভবতঃ জানো যে, তোমার বান্ধবী শীলা আমার কাজিন। শীলা আমাকে প্রায়ই বলতো, তুই যদি আমার বান্ধবী বর্ষাকে দেখিস, তাহলে প্রপোজ না করে পারবি না। তো, ওর যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ত্যক্ত-বিরক্ত হয়েই একদিন গেলাম তোমাদের ডিপার্টমেন্টে। তোমাকে দেখলাম। তারপর থেকে তোমাকেই শুধু দেখছি সবসময়, সব জায়গায়! গভীর ঘুমে - স্বপ্নে, যখন একা থাকি - কল্পনায়, তোমাদের ডিপার্টমেন্টে গিয়ে - চোরের মতো লুকিয়ে! শীলাকে অনেকবার অনুরোধ করেছি, তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্যে। কিন্তু ও শুধু মুচকি হাসে আর বলে, নিজের ম্যাও এখন নিজেই সামলাও! বুঝতে পারলাম ওর কাছ থেকে সাহায্যের কোন আশা নেই। এদিকে আবার সামনা-সামনি প্রপোজ করাও আমার পক্ষে সম্ভব না। কারন, প্রত্যাখ্যান আমার কাছে আসলেই খুব ভীতিকর একটা ব্যাপার। তাই এই চিঠি লিখতে বাধ্য হওয়া।
বর্ষা, আমি কোনদিন কাউকে ভালোবাসিনি, ভালো কিভাবে বাসতে হয় তাও জানিনা। শেখাবে আমাকে? যদি সত্যিই তোমার হাত ধরার সুযোগ দাও, ভালোবাসতে শেখাও; তাহলে কথা দিচ্ছি, কোনদিন কোন পরিস্থিতিতেই এই হাত আমি ছাড়বো না। ধরে থাকবো আমৃত্যু।
শীলা তোমাকে আমার সম্পর্কে কতোটুকু কি বলেছে জানিনা, তবু নিজের সম্পর্কে একটু বলি। আমি গান শুনতে ভালোবাসি, কিন্তু ইদানীং একা একা গান শুনতে ভালো লাগে না। আমি একা একা হাটতে পছন্দ করি। কিন্তু আজকাল মনে হয়, কেউ যদি পাশে থেকে হাতটা একটু ধরতো, বদলে যেতো চারপাশটা। বন্ধু, আত্মীয়-পরিজনরা বলে আমার রাগ খুব বেশী। কিন্তু এখন প্রতিমূহুর্তেই ভাবি, আমার রাগকে বিরাগে পরিনত করার জন্য কাউকে আমার প্রয়োজন, খুব বেশী প্রয়োজন!
আজ এ পর্যন্তই। দিন বদলের দিন যদি সামনে আসে তাহলে আরো অনেক কিছুই জানতে পারবে। তোমার উত্তর যদি 'না' হয়, তাহলেও তোমার জন্য রইলো অনেক অনেক শুভ কামনা। মনে রাখবে, এই পৃথিবীতে অন্ততঃ একজন মানুষ আছে যে প্রতিনিয়ত তোমার মঙ্গল কামনা করে।
আকাশ।।
...........................
আকাশ,
প্রিয় বলছি না, কারন আমি এখনও জানিনা তুমি আসলেই আমার কতোটা প্রিয় হতে পারবে। শীলা আমাকে তোমার সম্পর্কে অনেক কিছুই বলেছে। তুমি আমাকে দেখতে ডিপার্টমেন্টে আসতে! কই কোনদিন দেখিনি তো! আসলে দেখবোই বা কিভাবে, তুমি তো আসতে লুকিয়ে। তবে প্রতি মূহুর্তেই আমার মনে হতো কেউ একজন আমাকে দেখছে। কিভাবে? জানোই তো, পন্চইন্দ্রিয়ের বাইরে মেয়েদের আরেকটা ইন্দ্রিয় থাকে!!
যাইহোক, তোমাকে আমি দেখেছি। কোথায়? পরেই না হয় শুনো। তোমার চিঠি পেয়ে আমি অনেক চিন্তা করেছি। হ্যা, একটা সুযোগ তোমাকে দেয়া যায়........সেই সাথে নিজেকেও! জীবন যদি প্রতারণা না করে তাহলে আমরা একসাথে একদিন জ্যোৎস্না দেখবো। নিশ্চয়ই দেখবো কোন একদিন।
ভালো থেকো। আশাকরি খুব শীঘ্রই দেখা হবে।
বর্ষা।
পুনশ্চঃ চিঠি তো দেখছি ভালোই লিখতে পারো! পছন্দ হয়েছে আমার।
....................
পরবর্তী তিনটা বছর কিভাবে চলে গেল বর্ষা বা আকাশ, কেউই জানেনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে সবার চোখে ওরা ছিল একটা আদর্শ জুটি। কোনদিন কেউ ওদের মধ্যে বিন্দুমাত্র কোন ঝগড়া বা মনোমালিন্য দেখেনি। ইতোমধ্যে বর্ষা অনার্স পাশ করলো। আকাশ মাস্টার্স পাশ করে বের হয়ে একটা চাকুরীও জুটিয়ে ফেললো। দু’জনেই একমত যে, এখন বাসায় ওদের সম্পর্কের কথাটা বলা যায়। এমনি সময়ে একদিন সকালে বর্ষার চাচাতো বোন রুপার ফোনকলে আকাশের মাথায় যেন সম্পূর্ণ আকাশটাই ভেঙ্গে পড়লো।
রুপা জানালো, সিড়ি থেকে পড়ে গিয়ে বর্ষা মাথায় আঘাত পেয়ে একটা ক্লিনিকে ভর্তি হয়েছে। ঠিকানা নিয়ে তখনই বর্ষার কাছে গেল আকাশ। মাথায় ব্যান্ডেজ বাধা, ধবধবে সাদা বিছানায় শুয়ে আছে বর্ষা, নিথর। রুপা এক তরুন ডাক্তারের সাথে কথা বলছিল। আকাশকে দেখে বললো, আপুর এখনও জ্ঞান ফিরেনি। ডাক্তার বলছে দু’দিনের আগে কিছু বলা যাবে না।
এই দু’দিন যখনই পেরেছে ক্লিনিকের আশপাশেই থাকার চেষ্টা করেছে আকাশ। অপেক্ষা করেছে কখন জ্ঞান ফেরে বর্ষার। দু’দিন পর বর্ষার জ্ঞান ফিরে এলো, তবে ওর সাথে দেখা করার আগেই সেই ডাক্তার আকাশকে নিয়ে গেল তার রুমে।
- আকাশ সাহেব, আপনাকে একটা কথা বলা দরকার। সরাসরিই বলি। আপনার বান্ধবীর হেড ইন্জুরী টা ভয়াবহ। আমাদের ব্রেইনে 'ব্রোকা এ্যাফাসিয়া' নামে একটা অংশ আছে, যেটা আমাদের কথা বলার সক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে। উনার আঘাতটা সেখানেই। আর সে কারনেই সোজা কথায়, উনি এখন কথা বলতে পারছেন না।
- বর্ষা কি আর কোনদিন কথা বলতে পারবে না? ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞেস করলো আকাশ।
- ভবিষ্যতে কবে পারবেন বা আদৌ পারবেন কিনা তারও কোন ঠিক নাই। তবে এখন আপনাকে দেখলে উনি কথা বলার চেষ্টা করবেন। আর তাতে করে ব্রেইনের উপর আরো চাপ পড়বে, যা পেশেন্টকে আরো ভয়াবহ অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে পারে। আমার সাজেশান হচ্ছে, আপনি বাসায় চলে যান। উনাকে কন্ডিশন্ড হওয়ার সুযোগ দিন। তারপর অন্ততঃ এক সপ্তাহ পরে এসে দেখা করেন।
একেবারে বিধ্বস্ত অবস্থাতেই ডাক্তারের রুম থেকে বের হয়ে এলো আকাশ। রুপা বাইরেই অপেক্ষা করছিল। বললো, আকাশভাই, আপুর এই অবস্থার কথা কাউকে বলা হয়নি। এটা ডাক্তারের নির্দেশ। জানলে সবাই এসে ভিড় করবে যেটা আপুর জন্য ভয়ংকর হতে পারে। এমনকি শীলাপু-ও কিছু জানেনা। আপনি আমার নাম্বারটা রাখেন। বেশী খারাপ লাগলে ফোন করবেন, আর বেশী চিন্তা করে আবার নিজের শরীর খারাপ করবেন না, প্লিজ। কেন এসব বলছি আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। কোনভাবে মাথা দুলিয়ে সায় দিয়ে একরকম টলতে টলতেই ক্লিনিক থেকে বের হয়ে এলো আকাশ।
পরের পাচ’টা দিন কিভাবে পার করলো আকাশ জানেনা। ছয়দিনের মাথায় আর পারলো না, ফোন করলো বর্ষাকে। নাম্বার বন্ধ। হঠাৎ মনে পড়লো রুপা ওর নাম্বারটা দিয়েছিল। নাম্বার খুজে ফোন করলো ওকে।
- আকাশভাই, কেমন আছেন? আমি আপনাকে ফোন করবো করবো ভাবছিলাম। ভালোই হলো, আপনি করলেন।
- তোমার আপুর কি অবস্থা, রুপা?
- আছে কোনরকম, লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো রুপা। কথা বলতে না পারায় আপুর এখন মানসিক সমস্যাও দেখা দিচ্ছে আকাশভাই।
- ডাক্তার কি বলছে?
- ওই একই কথা। ব্রেইনের সমস্যা। কবে কথা বলতে পারবে বা আদৌ পারবে কিনা তার কোন নিশ্চয়তা নাই। অপেক্ষা করা আর মানসিক সাপোর্ট দেয়া ছাড়া এ’মূহুর্তে এর কোন চিকিৎসাও নাই। একটা কথা আপনাকে বলি আকাশভাই। আপুর যে ধরনের মানসিক সাপোর্ট দরকার এখন, এটা আপনি ছাড়া আর কেউ দিতে পারবে না। আমার মতে, আপনারা বিয়ে করে ফেলেন।
- কিন্তু ওর এই অবস্থায় এখন বিয়ে করা কি ঠিক হবে? তাছাড়া বাসায়ও তো কথা বলতে হবে। আকাশ বললো।
- আমাদের এদিকে তো সবাই জানে। আমি কোন সমস্যা তো দেখছি না। আপনি বাসায় কথা বলেন। তবে যা করার দ্রুত করতে হবে ভাইয়া। আপুর অবস্থা কিন্তু দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। এই মূহুর্তে আপনাকে আপুর ভীষণ দরকার।
- ঠিক আছে, দেখি। আমি তোমাকে জানাবো যতো দ্রুত সম্ভব।
ফোন ছেড়ে দু’হাতে মাথা চেপে ধরে বসে থাকলো আকাশ। যন্ত্রণায় মাথাটা যেন ছিড়ে যাচ্ছে। এর ঠিক চার দিন পরে একটা চিঠি পেলো বর্ষা।
..................
বর্ষা,
কি পাপ করেছিলাম জানিনা যে জন্যে আজ আমাদের এমন শাস্তি পেতে হচ্ছে! রুপার সাথে আমার বিস্তারিত কথা হয়েছে। ধরে নিচ্ছি তুমি সবই জানো। গত চারদিন ধরে আমি অনেক ভেবেছি, ক্রমাগত ভেবেছি। ভেবে ভেবে একটা কথা আমি বুঝতে পারছি, আজ তোমার-আমার অবস্থা যেখানে এসে দাড়িয়েছে, তাতে এ বিয়ে আমার বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন কেউই মেনে নেবে না। তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে, আশাকরি বুঝতে পারছো আমি কি বোঝাতে চাইছি!
আমি জানি, তোমাদের পারিবারিক স্বচ্ছলতা অনেক বেশী। চাইলে বিদেশে গিয়েও তুমি চিকিৎসা করাতে পারবে, কিন্তু তুমি তো জানো আমার জন্য এটা কঠিন একটা ব্যাপার। তাই সবচেয়ে ভালো হবে এসব ভুলে গিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করা।
দোয়া করি, আল্লাহ যেন তোমাকে দ্রুত সুস্থ্য করে দেন। আমার অক্ষমতার জন্য আমাকে ক্ষমা কোরো। সবসময় জানবে একজন পরাজিত, অক্ষম মানুষের সাথে তোমার সম্পর্ক ছিল কোন একদিন।
তোমার সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনা করছি।
আকাশ।
দু’মাস পরে আকাশ একটা চিঠি পেলো। প্রেরকঃ বর্ষা। বর্ষা লিখেছেঃ
প্রিয় আকাশ,
প্রিয় লিখলাম, কারন তুমি আমার খুব বড় একটা উপকার করেছো। কি উপকার? সেটাতে পরে আসছি।
তোমার লেখা প্রথম চিঠিটা এই মূহুর্তে আমার সামনে। না, ওটা পড়ে আমার চোখে কোন জল আসছে না। আসলে আমাকে একজন ব্যর্থ প্রেমিকা বলতে পারো তুমি। তুমি বলেছিলে, বর্ষা, আমি কোনদিন কাউকে ভালোবাসিনি, ভালো কিভাবে বাসতে হয় তাও জানিনা। শেখাবে আমাকে? আমি তোমাকে ঠিকমতো শেখাতে পারিনি। ব্যর্থতা তো আমারই, তাই না?
তুমি আরও বলেছিলে, কথা দিচ্ছি, কোনদিন কোন পরিস্থিতিতেই এই হাত আমি ছাড়বো না। ধরে থাকবো আমৃত্যু। অথচ যখন তোমাকে আমার সবচেয়ে প্রয়োজন ছিল, কতো অবলীলায় তুমি আমার হাত ছেড়ে দিলে! আসলে তোমাকে, ছন্নছাড়া আকাশকে, আমি ভালোবাসা শেখাতে না পারলেও সম্ভবতঃ বাস্তবতা ঠিকই শেখাতে পেরেছিলাম। তাই তুমি খুব দ্রুতই বুঝে গিয়েছিলে, আর যাই হোক, একটা বোবা মেয়ের সাথে ঘর-সংসার কখনও করা যায় না।
তবে আমার উপলব্ধি কিন্তু ভিন্ন। জীবনসঙ্গী বলতে আমি ভালো সময় কিংবা খারাপ সময়, সব সময়ের সঙ্গীই বুঝি। যাইহোক, আর কথা বাড়াই না। তোমাকে বরং একটা গল্প বলি, মন দিয়ে শুনো কিন্তু।
এক মেয়ে এক ছেলেকে জীবনের চেয়েও বেশী ভালোবাসতো। দ্রুত বিয়ে করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ওরা। ঠিক এমন সময় মেয়েটির এক বোন ওর মনে সন্দেহ ঢুকিয়ে দিল। বললো, কাউকে ব্লাইন্ডলি ভালোবাসা একধরনের বোকামী। খারাপ সময় না আসলে আসলে বোঝা যায় না, কে কাকে কতোটা ভালোবাসে। সুতরাং ওরা ছেলেটাকে পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিল। সেই বোনের বয়ফ্রেন্ড আবার একজন ডাক্তার, নিজের বাবার ক্লিনিকেই ও ডাক্তার হিসাবে কাজ করে। দু’জন মিলে বুদ্ধি করে মেয়েটিকে বোবা বানিয়ে দিল। পুরাটাই আসলে ছিল একটা নাটকের স্টেজ!!!
বাকী গল্প আর বলতে ইচ্ছে করছে না। তুমি অনুমান করে নাও, প্লিজ!!
আরেকটা কথা বলেই এই চিঠি শেষ করছি। তুমি যখন এই চিঠি পড়ছো, তখন আমি ইংল্যান্ডে, আমার বড়খালার কাছে। না, চিকিৎসার জন্য এখানে আসিনি। সিদ্ধান্ত নিয়েছি, মাস্টার্সটা এখানেই করবো। নতুন করে জীবন শুরু করার তোমার শেষ উপদেশটা আমার খুবই পছন্দ হয়েছে। সেজন্যে তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। একই অনুরোধ আমি তোমাকেও করছি।
ভালো থেকো।
বর্ষা।
চিঠি পড়ে মাসতিনেক সময়ের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো আকাশের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।
ছবিটা নেটের সৌজন্যে।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জানুয়ারি, ২০১৯ দুপুর ১২:০১