বাক-স্বাধীনতা বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা একটা গনতান্ত্রিক দেশের নাগরিক বা প্রাতিষ্ঠানিক অধিকার। ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশান অফ হিউম্যান রাইটস (UDHR) এর আর্টিকেল ১৯ এ এটাকে 'হিউম্যান রাইট' হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। তাছাড়া এটা ইন্টারন্যাশনাল কনভিন্যান্ট অন সিভিল এন্ড পলিটিক্যাল রাইটস (ICCPR) এ বর্ণিত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনেও স্বীকৃত। বলে রাখা ভালো, বাংলাদেশও এতে স্বাক্ষরকারী একটা দেশ। আমরা আবার খুব দ্রুতই সবকিছুকে অতি-সরলীকরন করে ফেলি। তাই জানিয়ে রাখি, এই স্বাধীনতা মানে কিন্তু যা মনে আসে তাই বলে ফেলা নয়। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ করে কিংবা সামগ্রিকভাবে দেশ ও সমাজে বড় ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, এমন কোন বক্তব্য বা মতপ্রকাশ এর আওতা বহির্ভূত।
আচ্ছা, এসব গুরুগম্ভীর কথামালার কচকচানি আপাততঃ মুলতবি রাখি। বরং আসুন, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন সময়ে দেয়া তিনটি বক্তব্য দেখি এবং বোঝার চেষ্টা করি।
একাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ''গণতান্ত্রিক ধারায় সমালোচনা সব সময় গুরুত্বপূর্ণ। আমি এতটুকু আশ্বাস দিতে পারি যে এই সমালোচনা বিরোধী দলে যারা আছেন তারা যথাযথভাবে করতে পারবেন। আমরা কোনো বাধা সৃষ্টি করব না। কোনোদিন বাধা দেইনি, দিব না।''
জার্মান সংবাদ সংস্থা ডয়চে ভেলের সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে উনি বলেছেন, তিনি চিন্তার স্বাধীনতায় সমর্থন করেন। আর তার সমালোচনাও করা যাচ্ছে অবাধে। তিনি বলেন, ''আপনি যদি বেশি বেশি কাজ করেন তাহলে আপনার সমালোচনাও হবে বেশি। আমার জনগণকে জিজ্ঞেস করে দেখুন তারা সন্তুষ্ট কিনা। তারা কী ভাবছে। তারা তাদের প্রয়োজনীয় সব কিছু পাচ্ছে কিনা। আমি তাদেরকে সব দিতে পারছি কিনা।''
রাজশাহী সেনানিবাসে বাংলাদেশ ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্টাল সেন্টারের (বিআইআরসি) 'জাতীয় পতাকা প্রদান-২০১৯' অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, আমাদের সরকার শাসক নয়, সেবক হিসেবে দেশের সার্বিক উন্নয়নে সরকার কাজ করে যাচ্ছে।
এখন উপরের তিনটি বক্তব্যকে যদি ব্যবচ্ছেদ করেন তাহলে দেখবেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে কিন্তু আন্তরিকতার অভাব নেই। তাহলে সমস্যা কোথায়? সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে আসুন তিনটি কেসকে স্টাডী করি। এই তিনটিকে বেছে নিয়েছি কারন এগুলো সমসাময়িক, আন্তর্জাতিক গনমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষন করেছে, সমালোচিত হয়েছে এবং অবধারিতভাবেই দেশ হিসাবে বাংলাদেশের মানবাধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করেছে।
কেস-স্টাডী ১ঃ
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফটো সাংবাদিক শহিদুল আলম। উনি যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ সান্দারল্যান্ডের একজন ভিজিটিং প্রফেসর। ২০১৪ সালে শিল্পকলা পদক এবং ২০১৮ সালে হিউম্যানেটারিয়ান এওয়ার্ড পান এই খ্যাতিমান ফটো সাংবাদিক।
ছাত্রদের গত নিরাপদ সড়ক অন্দোলনের সময় আল-জাজিরাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারের কারনে তিনি গ্রেফতার হন। উনার জেলে অবস্থানকালীন পুরো সময়টাতে বিশ্বব্যাপি বাংলাদেশের বাক-স্বাধীনতা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে তুমুল সমালোচনা হয়। নোবেল বিজয়ী থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের অনেক নামী-দামী ব্যাক্তিবর্গ উনার মুক্তির দাবীতে সোচ্চার হয়ে উঠেন। ফলে একপর্যায়ে এটা সরকারের জন্য একটা দায় হয়ে দাড়ায়।
অবশেষে প্রায় সাড়ে তিন মাস কারা ভোগ করার পর তিনি জামিনে মুক্তি পান। পরবর্তীতে এই মামলার তদন্ত কার্যক্রমে স্থগিতাদেশ দেন মহামান্য হাইকোর্ট।
কেস-স্টাডী ২ঃ
ক্রীড়া সংগঠক মাহফুজা আক্তার কিরণ। যিনি একাধারে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশানের এক্সিকিউটিভ কমিটির নির্বাচিত সদস্য, ফেডারেশানের মহিলা ফুটবল উইং এর চেয়ারপারসন, এশিয়ার ফুটবল নিয়ন্ত্রক সংস্থা এএফসির এক্সিকিউটিভ কমিটি ও মহিলা ফুটবল কমিটির সদস্য এবং একই সাথে বিশ্ব-ফুটবল নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফার কাউন্সিল মেম্বার।
একটা টক শো-তে দেয়া বক্তব্যকে ঘিরে বিতর্কের সূত্রপাত; যেখানে উনার বক্তব্যের মূল বিষয়বস্তু ছিল, প্রধানমন্ত্রী ফুটবলের চেয়ে ক্রিকেটকে বেশী গুরুত্ব দেন যেটা ঠিক না। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে উনার সবাইকে সমান চোখে দেখা উচিত।
প্রধানমন্ত্রীকে কটূক্তির অভিযোগে দায়ের করা মানহানির মামলায় কিরণকে আটক করা হয় গত ১৬ মার্চ। ওইদিনই মূখ্য মহানগর হাকিম তাঁর জামিন আবেদন নাকচ করে কারাগারে পাঠান। কিরণের আইনজীবী অ্যাডভোকেট লিয়াকত হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ''মামলাটি দণ্ডবিধির ৫০০ ধারায় করা। এটা জামিনযোগ্য মামলা। কিন্তু জামিন দেয়া হয়নি''।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান ডয়চে ভেলেকে এ'সম্পর্কে বলেন, ''যৌক্তিক সমালোচনাকে আমলে না নিয়ে মামলা করে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া আইনের শাসনের পরিপন্থি। এটা এক ভয়ার্ত পরিবেশের সৃষ্টি করে বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ করে। কিছু মানুষ এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। তারা চারপাশে থেকে এমন পরিবেশ তৈরি করছে, যাতে যৌক্তিক সমালোচনার পথও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তারা এমন অবস্থার তৈরি করছে, যাতে কিছু মানুষের ব্যাপারে কিছু বলা যাবে না। যৌক্তিক কথাও বলা যাবে না''। তিনি আরো বলেন, ''চারপাশের কিছু মানুষ এখন স্তাবকে পরিণত হয়েছে। তারাই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি করছেন''।
মামলায় দোষী প্রমাণিত হলে কিরণকে দু'বছরের জন্য কারাবরণ করতে হতে পারে। তাঁর গ্রেফতার দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। ''ফুটবলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কোনো অপরাধ নয়। মাহফুজা আক্তার কিরণ কেবল নিজের মত প্রকাশের স্বাধীনতার চর্চা করে বলেছিলেন যে, প্রধানমন্ত্রী ক্রিকেটকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন,'' বলেন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়া প্রচারক সাদ হাম্মাদি। তিনি আরো বলেন, ''একটা মানহানির মামলার প্রভাব যদি গুরুতর না হয়, তাহলে সেটা হাস্যকর হয়ে দাড়ায়।''
অবশেষে এ'মাসের ১৯ তারিখে জামিন পান এই সংগঠক। তাঁর আইনজীবী বলেন, ''এপ্রিলের ২ তারিখ পর্যন্ত আদালত তাঁকে জামিন দিয়েছেন মূলত মেডিকেল গ্রাউন্ডে, কারণ তিনি ক্যানসারের রোগী; ক্যানসারের চিকিৎসা নিচ্ছিলেন।''
কেস-স্টাডী ৩ঃ
সামহোয়্যারইন ব্লগ। দেশে-বিদেশে বাংলা চর্চ্চার সবচেয়ে বড় মাধ্যম এই ব্লগ। এই কেসটা সম্পর্কে ব্লগের সবাই জানেন, তাই বেশী কিছু বলার দরকার নাই। মায়ের কাছে মাসীর গল্প করে কি লাভ, বলেন? আমাদের প্রিয় এই ব্লগ বন্ধের অপচেষ্টা নিয়ে প্রচুর পোষ্ট আছে, আমিও লিখেছি; তাই সেদিকে আর যাচ্ছি না। শুধু শুধু পোষ্ট বড় করে লাভ নাই। এটুকুই বলবো, যে বা যারা এটি বন্ধের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন, তারা জেনে-বুঝে উদ্দেশ্যমূলকভাবেই করছেন। তবে তারা যেটা জানেন না তা হলো, আজ অথবা কাল অশুভ শক্তি পরাজিত হয়। এটা একটা অবশ্যম্ভাবী ব্যাপার; ইতিহাস সাক্ষী!
চাইলে খলিলভাই এর আপলোড করা তৃতীয়মাত্রার ভিডিওটা দেখতে পারেন, যারা এখনও দেখেননি। view this link
উপরের লেখাটুকু পড়ে কি বুঝলেন?
বেশী আলোচনার কি প্রয়োজন আছে? আচ্ছা, আলোচনায় না যাই। কারন আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যারা এখানে ভিজিটর কিংবা ব্লগার তাদের বিদ্যা-বুদ্ধি আমার চাইতে কোন অংশেই কম না, বরং বেশী। আমি বরং একটু অন্যদিকে ফোকাস করি।
অনেক আগে একটা হিন্দী মুভি দেখেছিলাম। পরেশ রাওয়াল অভিনীত ''ওহ মাই গড'' (যারা দেখেন নাই, দেখতে পারেন। অত্যন্ত চমৎকার একটা মুভি। বিষয়বস্তুঃ ভগবানের বিরুদ্ধে মামলা)। সেই মুভিতে আদালতে পরেশ রাওয়ালের একটা ডায়লগ ছিল এমন, ''ইলেকট্রিসিটি চলে গেলে মানুষ রিলায়েন্সের অফিসেই তো ফোন করবে, তাই না! সোজা অনিল আম্বানীকে তো করবে না।'' উল্লেখ্য, রিলায়েন্স ভারতে আম্বানী পরিবারের মালিকানাধীন একটা বিদ্যুত সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। এদিকে আমাদের দেশের অবস্থা ঠিক তার উল্টা। কিভাবে? বলি তাহলে।
আমাদের দেশে যে কোনও সমস্যায় আমরা প্রথমেই প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করি। যেমন মনে করেন, কেউ গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে? মাস্তানরা কারো জায়গা-জমি দখল করে নিয়েছে কিংবা সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ মারা গিয়েছে, বিচার চাই? প্রধানমন্ত্রী যেন ব্যবস্থা গ্রহন করেন। কেন? কারন বর্তমান প্রশাসন কিংবা এর বিভিন্ন স্তরের দায়িত্বে যারা আছে তাদের উপর সাধারন মানুষের একেবারেই কোন আস্থা নাই। এখন এ অবস্থার দায় কি প্রশাসনের সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপর বর্তায় না? অথচ এর সমাধানটা কিন্তু খুবই সহজ। উনি যদি সঠিক লোককে সঠিক জায়গায় বসান আর মন্ত্রী/সচীবদেরকে কড়া জবাবদিহিতার মধ্যে রাখেন, তাহলেই হয়। সবকিছু কেন প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত আসতে হবে? তাহলে বাকীদের কাজ কি? মোসাহেবী করা?
জীববিজ্ঞানের একটা সাধারন, সহজ সূত্র আছে। কোন জীবের যদি শরীরে পচন ধরে কিন্তু মাথা সুস্থ্য থাকে, তাহলে তার বেচে থাকার একটা সম্ভাবনা থাকে। উল্টাটা হলে কোন আশা নাই। আমাদের দেশের জনগন বুঝে ফেলেছে, প্রশাসনের শরীর শেষ, এখন যা কিছু করার মাথাই করতে পারে। কিন্তু এভাবে তো একটা দেশ দীর্ঘদিন চলতে পারে না। এর সমাধানের কথা বলেছি এবং এটা প্রধানমন্ত্রী......শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রীই করতে পারেন।
আমার আগের আরেকটা লেখাতে বলেছিলাম, আবারও বলছি; উনার চারপাশে যে অতি-উৎসাহী স্তাবক, মোসাহেব বা চাটুকার অথবা সোজা বাংলায় চামচা, যে ভাবেই বলি না কেন, আছে; তাদেরকে চেনাটা জরুরী। দেশে কিংবা বিদেশে মানুষ যখন সরকারের সমালোচনা করে, তখন কিন্তু শুরুই করে ''শেখ হাসিনার সরকার'' কথাটা দিয়ে। এখন সুনাম-দূর্ণাম সবই যেহেতু উনার নামেই হয় কাজেই সাবধান কিন্তু উনাকেই হতে হবে। উনার পিতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এদেরকে ভালোই চিনতেন। উনি এদেরকে বলতেন, চাটার দল!
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনিও এদেরকে চিনুন। বড় ধরনের সর্বনাশ করার আগে এদেরকে সমূলে উৎপাটন করুন। এরা নিজেরটা ছাড়া আর কারোর স্বার্থ দেখে না। কারোরই না। এরা পরগাছা.......অন্যের আশ্রয়ে লালিত-পালিত হয়। নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অন্যকে শুধু ব্যবহার করে মাত্র।
দেশ এগিয়ে যাক। আমরা বাংলাদেশকে বিশ্ব-মানচিত্রে সর্বঅর্থেই একটা আদর্শ দেশ হিসাবে দেখতে চাই; প্রকৃত বাক-স্বাধীনতার চর্চা যার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ!
তথ্যসূত্রঃ ডয়চে ভেলে, বিডি নিউজ ২৪ এবং অন্যান্য।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মার্চ, ২০১৯ দুপুর ১২:৪০