প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটা সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। এটা হচ্ছে নিউটনের তৃতীয় সূত্র। সবারই জানা। তো, সামু’তে বেশী সময় দেয়াকে যদি একটা ক্রিয়া ধরি তাহলে এর একটা বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকবেই......তবে সেটা সমান কিনা আমার জানা নাই। সে ভার আপনাদের উপর ছেড়ে দিচ্ছি।
সবাই সামু’তে যার যার সুযোগ-সুবিধা মতো ঝাপাচ্ছে। আমিও ব্যাতিক্রম নই। এই ঝাপানোর কারনে ঘরে এবং বাইরে যেসব প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হচ্ছি, সেটা নিয়েই আমার এই রচনা।
অফিসে আমার গুনমুগ্ধ এক সহকর্মী আছে। সহজ-সরল আইরিশ একটা ছেলে। নাম ক্রিস। সবাই বলে ও আমার একজন চামচা (খাটি বাংলায় বললাম)। আর ও বলে, আমার সাথে কথা বলে নাকি ও খুব আনন্দ পায়, কথা না বললে ওর খাবার হজম হয় না। কেন? কারন, আমি জানি না হেন বিষয় নাকি এই দুনিয়াতে নাই। আমি ওকে বলি, আমি তো কিছুই না। তুমি বাংলাদেশে একবার গেলে বুঝবা জ্ঞান কাকে বলে। এমনকি আমাদের দেশের একজন রিকশাওয়ালার যে রাজনৈতিক বা জীবন দর্শন সম্পর্কিত জ্ঞান আছে সেটা এ'দেশের একজন প্রথম সারির রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বা দার্শনিকেরও নাই। ও যতোই শোনে ততোই আশ্চর্য হয়। এমনিতে এদেশের লোকজন তার কাজের বাইরে খুব একটা জানে না। ও একজন আইটি স্পেশালিস্ট। কম্পিউটার জগতের সবকিছু ওর নখ-দর্পনে। কিন্তু ওকে যদি জিজ্ঞেস করি, নেপালের রাজধানীর নাম কি? ও হয়তো বলে বসবে এভারেস্ট। বিচিত্র কিছুই না।
এমনিতে আইরিশরা একটু সোজা ধরনের। ইংলিশরা ওদেরকে বলে বোকা। ইংলিশরা অবশ্য স্কটিশদেরকেও দেখতে পারে না। ওদের ভাষ্যমতে ওরা কিপটা। আসলে একই দেশের নাগরিক হলেও এই তিন জাতি আদতে কেউ কাউকে পছন্দ করে না। এসব নিয়ে বিভিন্ন কৌতুক প্রচলিত আছে ব্রিটিশ সমাজে। লোভ সামলাতে পারছি না, মূল প্রসঙ্গে যাবার আগে একটা বলি।
লান্চের সময়। একটা বহুতল ভবনের কন্সট্রাকশান সাইটের ছাদে তিন কর্মী তাদের লান্চবক্স খুলছে। বলাই বাহুল্য, একজন ইংলিশ, একজন স্কটিশ, অপরজন আইরিশ।
ইংলিশ তার বক্স খুলে বললো, আবারও হ্যাম আর চীজ স্যান্ডউইচ! আমার বউয়ের আক্কেলটা দেখ! প্রত্যেকদিন একই জিনিস! ওকে আমি কিছুই বলবো না, কিন্তু কাল যদি একই জিনিস পাই......আমি সরাসরি নীচে লাফ দিবো।
স্কটিশ তার বক্স খুলে বললো, দেখো, জ্যাম স্যান্ডউইচ! কাল যদি এটা পাই আমিও লাফ দিবো।
আইরিশ তারটা খুলে বললো, ডিম আর ক্রেস স্যান্ডউইচ! অবস্থার পরিবর্তন না হলে আমিও তোমাদের সাথে আছি।
পরদিন যথারীতি একই খাবার পেয়ে তারা লাফ দিল।
ফিউনারেলে তিন বউ কথা বলছে। ইংলিশের বউ বললো, দেখো, আমি যদি জানতাম যে এই খাবারে ও এতোটা বিরক্ত, তাহলে এটা প্রতিদিন কখনও দিতাম না। স্কটিশের বউও একই কথা বললো। আইরিশের বউ বললো, একটা কথা আমার মাথায় ঢুকছে না। আমার হাজব্যান্ড তো প্রতিদিন নিজের খাবার নিজেই নিতো। তাহলে ও লাফ দিল কেন?
মূল প্রসঙ্গে আসি। ক্রিস প্রতিদিন আমার ডেস্কের কাছে কয়েকবার আসে। আমরা কফি নিয়ে একসাথে বাইরে যাই ফ্যাগব্রেকে (এখানে সিগারেটের প্রচলিত নাম 'ফ্যাগ' )। আমার ডেস্কে এসে পিসিতে উকি দেয়া ওর স্বভাব। গত দু’সপ্তাহ ধরে বেশীরভাগ সময় ও দেখে সামু’র পেইজ খোলা। গতকাল ও আমাকে বললো, নিউজিল্যান্ডে সন্ত্রাসী হামলার পর থেকেই দেখি এই ফরেন পেইজে তুমি আছো। এটা কি আল-কায়েদার বোমা তৈরীর রেসিপি? আমি বললাম, নারে ছাগল, এটা আমি যেই ব্লগে ব্লগাই, তার পেইজ। আর তুমি যে জোরে জোরে এসব কথা বলছো......এর প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে তোমার কোন আইডিয়া আছে? ও জিভে কামড় দিয়ে চারদিক তাকিয়ে দাত বের করে বললো, কেউ শোনে নাই!!!
গতপরশু সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেছি। শব্দে বুঝলাম বউ রান্নঘরে। ব্যাগটা রেখে মাত্র ল্যাপটপে হাত দিয়েছি.....ও ঝড়ের বেগে রুমে ঢুকলো, হাতে একটা খুন্তি। ওটা নাড়াতে নাড়াতে বললো, খবরদার, ল্যাপটপে হাত দিবা না।
আমি ভড়কে গিয়ে হাত সরিয়ে ফেললাম। বললাম, কেন, বোমা ফিট করেছো নাকি?
- এখনও করি নাই। তবে করবো, যদি সারাক্ষণ সামু’র পেইজ খুলে বসে থাকো। সারাদিন বাইরে থাকো আর ঘরে এসে ল্যাপটপের সামনে। সংসারে আর কোন কাজ নাই? সামু’র দুর্দিন..... সামু’র দুর্দিন শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা। এদিকে আমার যে দুর্দিন সেদিকে কোন নজর আছে তোমার?
- কেন, তোমার আবার কি হলো?
- গত দু’সপ্তাহ ধরে ঘরের কোন কাজ করো, নাকি আমাকে সময় দাও? হাজব্যান্ডের দায়িত্ব তুমি পালন করবা, নাকি পাশের বাসার মার্টিন করবে! বলতে বলতে রণরঙ্গিনীর প্রস্থান।
মার্টিন? কি সর্বনাশের কথা! গত বছর ডিভোর্স হওয়া পাশের বাসার মার্টিনের চেহারা মনে ভেসে উঠলো। ওর এখনও ব্যাচেলর অবস্থা! ইদানীং দেখি আমার সাথে খুব গল্প করার চেষ্টা করে। ভেবেছিলাম ব্যাটাকে একদিন বিরিয়ানী খাওয়াবো। ওর আবার আমাদের এই খাবারটা খুব পছন্দ। সজোরে মাথা ঝাকিয়ে আইডিয়াটা মাথা থেকে বের করে দিলাম। খাল কেটে কুমীর আনার কোন দরকার আছে! আসলে একটু বাড়াবাড়িই করে ফেলেছি। বউয়ের কাছে গিয়ে মিহিসুরে বললাম, থাক। আজ আর রান্না করে কাজ নাই। চলো, সুমনা ভাবীদের বাসায় যাই। ফেরার পথে কোথাও থেকে খেয়ে আসবো।
এই সুমনা ভাবী আবার ওর খুব প্রিয় বান্ধবী। সব ব্যাপারেই দু’জন খুব শলা-পরামর্শ করে। আমার বউয়ের রাগ ঠান্ডা করার অন্যতম উপায় হলো ওই বাসায় বেড়াতে যাওয়া।
ওনার বাসায় বসে গল্প করছি। ভাবী বউকে বললো, কি ব্যাপার, তোমার মুখ এতো গোমড়া কেন?
আর বইলো না ভাবী। বাসার কোন কাজ করে না, আমাকে সময় দেয় না। সারাক্ষন সামু’র কাছে পরে থাকে। কাহাতক মন ভালো থাকে? সব কিছুরই তো একটা সীমা আছে!
ভাবীর দেখি কেমন অপ্রস্তুত চেহারা, পরিবর্তনটা বেশ লক্ষনীয়। তাড়াতাড়ি অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলো। এর মধ্যে ভাইও চলে এলেন। খাওয়া-দাওয়া, গল্প-গুজব........ভালোই একটা সময় কাটলো। বউ খুশী, আমিও খুশী।
বাসায় আসতে না আসতেই ভাবীর ফোন। ফিস ফিস করে বললো, ভাই, আপনার সাথে জরুরী কথা আছে। আপনার বউ আশে-পাশে থাকলে একটু দুরে যান। উনাকে আচ্ছা বলে আমি বউকে বললাম, তুমি ভিতরে যাও, আমি একটু ধুম্রপান করে আসি।
- হ্যালো ভাবী, জ্বী বলেন।
- কিভাবে যে বলবো ভাই! আপনারা দু’জন এতো ভালো। দু’জনের মধ্যে এতো মিল-ভালোবাসা খুব কমই দেখা যায়। তারপরেও এসব হয়। আর যখন হয়, ঠেকানো যায় না। তবে, সাবধান থাকা দরকার। কখন কি হয়ে যায় বলা যায় না।
- আমি তো ভাবী কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম।
- আচ্ছা, সরাসরিই বলি। সামিনা বা সামিয়া যার নাম, মেয়েটা কে? তবে যেই হোক, শুরুতে একটু ভালো লাগা, তারপরেই কিন্তু ঘনিষ্ঠতা বাড়ে আর সমস্যার সৃষ্টি হয়। ভাবী গলা আরো খাদে নামিয়ে বললো।
- কোন সামিনা সামিয়া, কার কথা বলছেন ভাবী?
- আহা ঢং করবেন না। ওই যে, যাকে আপনি আদর করে সামু বলেন! সামু তো কারো নাম না। অন্য কিছু হবে। ওই যে, আপনার বউ বললো না! যার কাছে আপনি সারাক্ষণ পরে থাকেন?
মোটামুটি আক্কেল গুরুম অবস্থায় বাসায় ঢুকলাম। মানুষজনের কল্পনাশক্তি দেখে ক্ষণে ক্ষণে চমৎকৃত হই। কোথাকার কথা কোথায় নিয়ে যায়! প্রথমে মার্টিন, তারপর ভাবী আর শেষে কোনদিন না দেখা সামিনা বা সামিয়া! একদিনে এতো?
নাহ্, একটা ব্রেক নেয়া দরকার!!
ছবিঃ গুগল।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মে, ২০১৯ সকাল ৯:৫৫