গত শুক্রবারের ঘটনা। সকাল ১১টার দিকে এক দেশী ছোটভায়ের এন্ট্রি ঘটলো আমার অফিসে। মুখ-চোখ শুকনা, উদভ্রান্ত চেহারা।
বললো, ভাই, ভীষণ বিপদে পড়ছি। আপনে ছাড়া এই বিপদ থেকে কেউ আমারে উদ্ধার করতে পারবে না।
আমি বললাম, আমি তো উদ্ধারকারী জাহাজ হামজা না। তবে ঘটনা বলো দেখি, আমার সাধ্যে যদি কুলায় অবশ্যই সাহায্য করবো।
অফিসের বাইরে গিয়ে ধুমপান করতে করতে ওর কাহিনী শুনলাম।
মাস তিনেক আগে এক ডেটিং সাইটের মাধ্যমে জনৈক রোমানীয়ান মেয়ের সাথে ওর বন্ধুত্ব হয়। বন্ধুত্ব থেকে প্রেম। একপর্যায়ে ওরা সিদ্ধান্ত নেয় বিয়ে করার। সিদ্ধান্ত মোতাবেক মেয়ে ইংল্যান্ডে আসার টিকেট করে এখন বুখারেস্টের হেনরী কোয়ান্ডা এয়ারপোর্টে বসে আছে। কেন? কারন মেয়ের কাছে কোন টাকা-পয়সা নাই। রোমানীয়ান ইমিগ্রেশান ওকে আটকে দিয়েছে, এই বলে যে, কোন টাকা ছাড়া সে কোন বুদ্ধিতে ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে উড়াল দিতে চায়?
মজনু ছোটভাই তার লাইলীর সাথে কথা বলেছে, ইমিগ্রেশান অফিসারের সাথেও কথা বলেছে। ইমিগ্রেশান অফিসারের কথা অনুযায়ী ওকে ওয়েস্টার্ণ ইউনিয়নের মাধ্যমে ৮০০ পাউন্ড পাঠাতে হবে। তাহলে মেয়েকে অনুমতি দেয়া সম্ভব হবে। এখন টাকা পাঠাতে ফটো আইডি লাগবে যেটা ওর নাই (ড্রাইভিং লাইসেন্স নাই, পাসপোর্ট হোম অফিসে)। গোদের উপর বিষফোড়ার মতো ওর কাছে ৮০০ পাউন্ডও নাই, ২০০ আছে। এদিকে হাতে সময়ও নাই। এতো এতো 'নাই' এর মধ্যে আমার কাছে ওর সবিনয়ে নিবেদন, আমি যেন আমার ফটো আইডি এস্তেমাল করে, আমার টাকা পাঠিয়ে ওই মেয়েকে এখানে আনার ব্যবস্থা করি।
ওকে অবশ্য আমার টাকা দিতে কোন সমস্যা নাই। সে একজন বিশ্বাসযোগ্য মানুষ। তাছাড়া একজন 'মফিজ' হিসাবে আমি এমনিতেই সবাইকে বিশ্বাস করি।
ওকে বললাম, দেখো ছোটভাই, টাকা পাঠাইতে আমার কোন সমস্যা নাই। কিন্তু তুমি যেই কাহিনী আমারে শুনাইলা, তাতে আমি মোটামুটি ৯০ ভাগ নিশ্চিত যে, তুমি প্রতারকের খপ্পড়ে পড়ছো। এই মেয়ে তোমার টাকা নিবে, কিন্তু তোমার কাছে আসবে না। তাছাড়া কোন ইমিগ্রেশান অফিসার তার কাজ-কাম ফালায়া ওই মেয়ের হয়া তোমার সাথে কথা বলবে না।
ছোটভাই দার্শনিকের মতো উত্তর দিলো, কতো টাকা কতোখানে যায়, কিছু টাকা না হয় রোমানীয়া গেলই! তবে ও আসবে, আমি নিশ্চিত। আমাকে খুব ভালোবাসে। এক দাদী ছাড়া এই দুনিয়াতে ওর কেউ নাই। সেই দাদীর সাথেও আমার কথা হইছে। দাদীই তার নাতনীর দায়িত্ব আমারে নিতে কইছে। তাছাড়া, আমারে বোর্ডিং পাসের ছবিও একটু আগে পাঠাইছে।
আমি বললাম, শোনো টেলিফোনে আমিও তোমার আব্বা হইতে পারি, অসুবিধা কি? কই দেখি বোর্ডিং পাসের ছবি? আর আমারে মেয়ের ছবিও দেখাও।
বোর্ডিং পাস দেখি ঠিকই আছে, তবে প্রতারকরা কাচা কাজ করবে এটা আশা করাও ঠিক না। মেয়ের ছবি দেখে তো আমার নিজেরই চোখ ট্যারা হয়ে গেল, ছোটভায়ের অন্ধ হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না! এই মেয়েকে দেখে প্রেমে না পড়াটা ফৌজদারী অপরাধ বলে গন্য হওয়া উচিত। আমারই তো ইচ্ছা করছে প্রেমে পড়ি! বুকের ভিতরে কেমন একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলাম। মনের মধ্যে লক্ষ লক্ষ প্রজাপতি উড়াউড়ি শুরু করে দিল! মনে হলো যেন শরীরে বসন্তের বাতাসের মৃদু-মধুর স্পর্শ অনুভব করলাম। আমার চেহারা দেখে ও পরিস্থিতি সম্ভবতঃ আচ করতে পারলো। আমার হাত ধরে বললো, ভাই, হাতে সময় নাই। একটু সাহায্য করতেই হবে আপনের এই ছোটভাইরে।
এই ছেলের আবার ইউকেতে রেসিডেন্ট স্ট্যাটাসে সমস্যা আছে। ইউরোপিয়ান বিয়ে করতে পারলে তার সেই সমস্যারও সমাধান হয়। আমাকে জানালো গতসপ্তাহেই ও মেয়েকে ৩০০ পাউন্ড পাঠিয়েছে ইমার্জেন্সী পাসপোর্ট আর টিকেট করার জন্য। আমি বললাম, ওকে। সাহায্য করতে আমার আপত্তি নাই। কিন্তু এই মেয়ে ভুয়া, আমি নিশ্চিত। টাকা নিয়া উধাও হয়ে যাবে। তারপরে ওর করুণ চেহারার দিকে তাকিয়ে বললাম, ঠিক আছে, চলো। টাকা পাঠাই। কিন্তু মনে রাইখো, আমি তোমারে সাবধান করছিলাম।
ওয়েস্টার্ণ ইউনিয়নের মাধ্যমে আমি অনেকবারই এদিক-সেদিক টাকা পাঠিয়েছি। শেষবার পাঠিয়েছি প্রায় বছর দুয়েক আগে। আইডি, টাকা, ফিলআপ করা ফর্ম দিয়ে কাউন্টারে অপেক্ষা করছি। কাউন্টারের মেয়েটা বললো, তোমার টাকা যাচ্ছে না, 'অন হোল্ডে' আছে। তোমার নাম্বারে কল আসবে, কথা বলো; কিছু সিকিউরিটি চেকআপের ব্যাপার-স্যাপার আছে। এটা আমার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা, এমনটা আগে কোনবারই হয়নি। ফোন নাম্বার দেয়া ছিল ছোটভায়েরটা। কল আসলো, ও কথা বললো এবং আল্লাহর কি রহমত, টাকা পাঠানো গেল না। ওরা নাকি এতো টাকার ট্রান্জেকশানের জন্য যে কারন প্রদর্শিত হয়েছে তাতে সন্তুষ্ট না।
এর মধ্যেই ছোটভাই মিনিটে মিনিটে সেই মেয়ে আর ইমিগ্রেশান অফিসারের সাথে কথা বলছে। মেয়ে ওদিক থেকে কান্নাকাটি করে বলছে, এখন সে কোনমুখে দাদীর কাছে ফিরে যাবে! কাউন্টারের মেয়েটা আমার পরিচিত। আমাকে বললো, ঘটনা কি? তুমি রোমানীয়ায় কাকে টাকা পাঠাও? আমি ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করলাম।
সে বললো, দাড়াও, আমার এক রোমানীয়ান বান্ধবী আছে, তাকে কল দেই। সব শুনে ওই বান্ধবী যা বললো, তাতে আমি যেসব পয়েন্টে সন্দেহ করছিলাম তা বহুলাংশে মিলে গেলো।
বাইরে এসে ছোটভাইকে বললাম, তুমি মিলাদ দিও একটা। বড় বাচা বাইচা গেলা আজকে। আমার তো এখনও বুঝে আসে না ওয়েস্টার্ণ ইউনিয়ন টাকা আটকায় দিল কি মনে কইরা? মনে করো, এইটা আল্লাহ তোমারে সরাসরি রহমত করছে।
সর্বশেষ ঘটনা হলো, ওই মেয়ে ওকে জানিয়েছে, এয়ারপোর্ট থেকে ওর বাসা প্রায় ৪ ঘন্টার পথ। বাসায় ফেরত যাওয়ার ট্যাক্সি ভাড়া ওর কাছে নাই। সেজন্যে ১০০ পাউন্ড যেন পাঠায়!!
শুনে আমার মনে একটা কথাই আসলো, সখী তুমি আসলে কার? ছোটভায়ের, নাকি অন্য কারো, নাকি অন্য আরো অনেকের?
(ঘটনা কিন্তু আমার বানানো না, ১০০% সত্যি। আমি শুধু ছোটভায়ের নামটা বলি নাই! পুরো ঘটনা ঘটার পর মনে হলো এটা আপনাদের না জানালে আমার পেটের ভাত হজম হবে না, তাই লিখে ফেললাম।)
ছবিঃ ইন্টারনেট থেকে।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই এপ্রিল, ২০১৯ রাত ১২:৩৫