কয়েকদিন আগে একজন ব্লগার একটা পোষ্ট দিয়েছিলেন। ''প্রবাসে রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের বেডরুম'' নামে। উদ্দেশ্য ছিল সম্ভবতঃ আমাদের দেশের প্রবাসী শ্রমিকদের কষ্টের জীবন চিত্রায়িত করা। সেখানে দুইজন ব্লগার দু'টি যুগান্তকারী মন্তব্য করেছেন। যুগান্তকারী বলছি এই কারনে যে, মন্তব্যে যেমন সরলতা (যা মনে আসে অগ্র-পশ্চাৎ চিন্তা না করে সরলভাবে বলে দিলাম জাতীয়) আছে, তেমনি 'একটা বিষয় না জানা'র ব্যাপারটাও ফুটে উঠেছে। সেইসঙ্গে এই না জেনে মন্তব্য করাটা যে দোষনীয় এবং দুষনীয় কিছু না, সেটারও প্রকাশ পেয়েছে; খুবই কিউট একটা ব্যাপার মনে হয়েছে আমার কাছে। এই যুগান্তকারী মন্তব্য দু'টা আপনাদেরকে আবার জানানোর লোভ সামলাতে পারছি না।
মন্তব্য ১ঃ প্রবাস থেকে যারা টাকা পাঠান, তা তাঁদের পরিবার-পরিজনদের জন্যে পাঠানো হয়। পরিবার-পরিজনরা অন্য দেশে থাকলে, প্রবাসীরা সেই দেশেই টাকা পাঠাতেন।
মন্তব্য ২ঃ কয়জন প্রবাসী দেশ সেবার ব্রত নিয়ে দেশ ছেড়েছিল? সবাই তো পেটের দায়ে যায়। উনি আরো বলেছেন, যারা প্রবাসী (আমি প্রবাসী প্রফেসর, ডাক্তার, ইন্জিনিয়ার, গবেষকদের মেনশন করছি না) তারা এমন একটা ভাব লাগায় যেন তারা ৭১ এর মুক্তিযোদ্ধা। আরে ভাই, টাকা পাঠাও কার জন্য, কাদের জন্য???
এই মন্তব্য দু'টার আনুষ্ঠানিক ব্যবচ্ছেদ আমি করবো না। আশা করছি পোষ্টের মধ্যে থেকেই আপনারা সেটা পেয়ে যাবেন।
পৃথিবীতে এমন কেউ নাই যে সর্ব বিষয়ে জ্ঞান রাখে। সেটা সম্ভবও না। কেউ নিজেকে সবজান্তা শমশের মনে করতেই পারে; সেটা তার নিজের আত্মতৃপ্তির ব্যাপার। কিন্তু অন্যদের কাছে সেটা তেমন একটা গুরুত্ব পায় না, পাওয়ার কথাও না। আমি সব সময়েই একটা কথা বলি, কোন কিছু না জানা কিংবা কম জানা দোষের না; বরং এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু না জানা বা কম জানা বিষয়কে এমনভাবে উপস্থাপন করা যে, ব্যাপারটা আমি শুধু জানি তাই না, আমি এটাতে মাষ্টার এবং আমি যা বলেছি এটাই শেষ কথা; এমন ভাব করাটা দোষের। শুধু দোষেরই না; এটা একধরনের বুদ্ধি-প্রতিবন্ধীতার লক্ষণ।
এবার একটু হাল্কা-পাতলা আলোচনা করি। বর্তমান বিশ্বে বিশুদ্ধ সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রচলন আছে, এমন রাষ্ট্র বোধকরি একটাও নাই। কিছু আছে, সুগার-কোটেড ট্যাবলেটের মতো; সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রলেপ দেয়া পুজিবাদী ব্যবস্থা। আর বাকী সবগুলো বিশুদ্ধ পুজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। পুজিবাদী ব্যবস্থার মূল কথাই হলো, ব্যক্তিগত লাভের জন্য কাজ করা। এখানে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কাজ করে নিজের লাভের জন্য। তাদের সিদ্ধান্ত, নীতি-নির্ধারন, কাজ কিংবা ব্যবসা পরিচালনা সবকিছুই করা হয় নিজেদের স্বার্থে। সরকার এখানে সেকেন্ডারী ভূমিকা পালন করে। তাহলে সরকারের কাজ কি? সরকার এখানে সহায়ক শক্তি। আইন-শৃংখলা রক্ষা করা, প্রতিরক্ষা, কর, বিচার ব্যবস্থা, রাজস্ব এবং আর্থিক নীতি ইত্যাদি বিষয়গুলো দেখভাল করে সরকার। এটা হলো সরল ব্যাখ্যা। দিনে দিনে পুজিবাদী ব্যবস্থায় অনেক ডালপালা, তত্ব গজিয়েছে। পিপিপি (পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি বা ক্রয় শক্তি সমতা'র কথা বলছি না) বা পাবলিক-প্রাইভেট (সরকারী-বেসরকারী) পার্টনারশিপ তাদের মধ্যে অন্যতম। তবে, সেটা অন্য আলোচনা; তাই সেদিকে যাচ্ছি না।
এখন কৃষক যখন ফসল ফলায়, তার নিজের এবং পরিবারের ভরন-পোষণের জন্যই ফলায়। সে কোনসময়েই এটা ভাবে না…...এই কাজ করে আমি দেশ ও দশের সেবা করছি কিংবা সমাজ সেবা করছি। একজন উদ্যোক্তা যখন একটা কারখানা স্থাপন করে, তখন ব্যাক ইন দ্য মাইন্ড তার একটাই লক্ষ্য থাকে যে, আমি একদিন বিশাল শিল্পপতি হবো, গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ বা কোম্পনীজের মালিক হবো, সিআইপি কিংবা ভিআইপি হবো। আর দিন শেষে আয়েশী জীবন-যাপন করবো। এটাই সত্যি আর এটাই স্বাভাবিক, এটাতে দোষের কিছু নাই। হ্যা, পাবলিকলি হয়তো সে গালভরা অনেক কিছুই বলতে পারে। এটাও বলতে পারে যে, আমার এই শিল্প স্থাপনার মূল লক্ষ্য হলো দেশের বেকার সমস্যার সমাধানে কন্ট্রিবিউট করা…….ব্লা ব্লা ব্লা; কিন্তু আসল সত্যিটা বুঝতে কি কারো বাকী থাকে? এটা নিপাতনে সিদ্ধ একটা ব্যাপার যে, ভিশন এবং মিশন না থাকলে পুজিবাদী অর্থ ব্যবস্থায় আপনি একটা অচল মাল। এখন সেই ভিশন এবং মিশনটা আসলে কি? আগেই পরিস্কার করেছি। ঠিক তেমনিভাবেই একজন প্রবাসী বিদেশে পরিশ্রম করে তার নিজের আর পরিবারের স্বচ্ছলতার জন্য। এটাও অতি সত্যি এবং স্বতঃসিদ্ধ একটা ব্যাপার। তাহলে এখানে তার রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতে কন্ট্রিবিউশানের ব্যাপারটা আসে কোত্থেকে? আর তার মুল্যায়নের প্রশ্নই বা আসে কেন? অবশ্যই আসে। ঠিক যেভাবে একজন উদ্যোক্তা দেশীয় অর্থনীতিতে কন্ট্রিবিউট করে এবং তার মুল্যায়নের প্রয়োজন পড়ে, সেভাবে।
এবার তাহলে একটু সরলভাবে ভেঙ্গে বলি। অতি-সরলীকরনের দোষে দুষ্ট হলে জানাতে আজ্ঞা হয়।
ব্যক্তি যখন তার অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির জন্য কাজ করে, তখন সে সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির জন্য কাজ করে, কারন ব্যক্তিকে নিয়েই রাষ্ট্র। ব্যক্তির সমষ্টিগত উন্নয়নই রাষ্ট্রের উন্নয়ন। কিভাবে? ব্যক্তি অর্থ উপার্জন করবে খরচ করার জন্য। এটাই একটা দেশের অর্থনীতিকে বড় করবে, গতিশীল করবে। একজন প্রবাসী যখন দেশে অর্থ পাঠায় তখন তার পরিবার সেই টাকা খরচ করে। মনে করেন, একজন প্রবাসীর পাঠানো টাকায় তার পরিবার এক কেজি চাউল কিনলো। এতে এই এক কেজি চাউল উৎপাদনকারী কৃষক থেকে খুচরা বিক্রেতার কাছে আসা পর্যন্ত যতোগুলো ধাপ পার হয়ে আসে, সবাই অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হয়। যে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শেষ পর্যায়ে এই চাউল বিক্রি করলো, সেও উপকৃত হলো। এর ফলে কতোজনের কর্মসংস্থান হলো, কতোজন মানুষ এই ধাপগুলোর ফলে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হলো, তারা আর তাদের পোষ্যরা ভালো জীবন-যাপন করলো; সেটাই ভাবার বিষয়। একই কথা একটা শার্ট (আমাদের দেশের কোন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে উৎপাদিত) বা দৈনন্দিন যে কোনও কমোডিটি ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এই যে পুজির বা পুজির তারল্যের মোবিলিটি……এটাই দিনশেষে আসল কথা। এটা না থাকলে একটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা স্থবির হয়ে যেতে বাধ্য। এভাবেই একজন উদ্যোক্তা যেমন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে, তেমনি একজন তথাকথিত রেমিটেন্স যোদ্ধাও। এই সামান্য অর্থনীতিটুকু আমরা না বুঝলে কেমনে হবে?
এ'ছাড়া দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সুদৃঢ় হওয়ার বিষয়টা তো আছেই। এটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে যাওয়া এই পোষ্টে কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক হওয়ায় সেদিকে যাচ্ছি না। তাছাড়া, আমার শক্ত বিশ্বাস আছে যে, একটা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সুদৃঢ় হওয়া যে কতোটা জরুরী এটা সবাই জানে। বিশেষ করে ব্লগারদের তো আরো ভালোভাবে জানার কথা!
প্রসঙ্গক্রমে আরেকটা বিষয় বলি। প্রবাসে যারা উচ্চ-শিক্ষিত; প্রফেসর, ডাক্তার, ইন্জিনিয়ার, গবেষণা ইত্যাদি পেশায় আছেন, তারা মোটামুটিভাবে সেদেশেই স্থায়ী। উনাদের বেশীরভাগই স্বচ্ছল পরিবার থেকে উঠে আসা। দেশে উনাদের পাঠানো টাকায় সংসার চালানোর মতো মানুষ স্বাভাবিকভাবেই কম, অনেক ক্ষেত্রে একেবারেই নাই। তাই দেশে উনারা বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া খুব একটা টাকা পাঠান না। পক্ষান্তরে, যাদেরকে আমরা শ্রমিক বলি, যারা আমাদের চোখে অশিক্ষিত বা স্বল্প-শিক্ষিত; তারা ন্যুনতম খরচে প্রবাসে মানবেতর জীবন-যাপন করে বাকী প্রতিটা পাই-পয়সা দেশে পাঠান। ''রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের বেডরুম'' দেখে আপনাদের এ'ব্যাপারে সম্যক ধারনা অবশ্যই ইতোমধ্যে হয়েছে। আমাদের দেশের রেমিটেন্স প্রবাহ মূলতঃ ইনারাই চালু রাখেন, উচ্চশিক্ষিত পেশাজীবিরা নন। আর এনারাই দেশে আসলে বিমান বন্দর থেকে শুরু করে প্রতিটা পদে হয়রানী আর তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শিকার হন। আর এসব অনাচারে ত্যক্ত হয়ে কেউ যদি ভুলক্রমে একটু প্রতিবাদী প্রতিক্রিয়া দেখিয়েই বসে, তাহলেই চারিদিকে ধর ধর রব উঠে…….আরে! বিদেশে কামলা দেয়া এক অশিক্ষিতের এতো বড় দুঃসাহস!! সবাই তখন ভুলে যায়, একটু আগেই ''অশিক্ষিত'' আখ্যা দেয়া একজনের কাছ থেকে আশা করা হচ্ছে একজন উচ্চশিক্ষিতের বিনয়!! এসব দেখলে আমার একটা শব্দই মাথায় আসে…...হলি কাউ!!! এদের সমালোচনায় সময় নষ্ট না করে পারলে এসব অনাচার নিয়ে লিখুন। তারা যতোটুকু ডিজার্ভ করে, অন্ততঃ ততোটুকু দেয়ার চেষ্টা করুন। প্রতিবারই যখন দেশে আসি, এয়ারপোর্টে আমি নিজের চোখে এদের প্রতিপদে হয়রানির শিকার হতে দেখি। আর শেষ পর্যন্ত এদের প্রাপ্য সন্মান যদি নাই দিতে পারেন, অন্ততঃ এদের নিয়ে নেগেটিভ কথা বলা বন্ধ করেন……এটাও তাদের জন্য 'অনেক করা' বলেই গন্য হবে।
বাইরের কথা বাদ। প্রবাসীদেরকে নিয়ে বিভিন্ন রকমের অনাকাঙ্খিত মন্তব্য বিভিন্ন সময়ে এই ব্লগেই দেখি। অন্ততঃ এক্ষেত্রে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশীপ দেখি বেশ ভালোভাবেই আছে! বেশীরভাগ সময়েই ইগনোর করার চেষ্টা করি, তবে এবার ভাবলাম কিছু বলে নিজে একটু হাল্কা হই। আমি বুঝি না, কেউ যদি একটু আবেগী হয়ে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে রেমিটেন্স যোদ্ধা ও তাদের অবদান, পোষাক শিল্পের বোনদের অবদান কিংবা আমাদের কৃষকভাইদের অবদানের কথা বলে, তাতে সমস্যা কোথায় আর এতে গাত্রদাহের কারনই বা কি? এরা সবাই তো এ'দেশেরই সন্তান। এরা সবাই নিজের আর তার পরিবারের স্বচ্ছলতার জন্য যেমন কাজ করছে, তেমনিভাবেই দেশের উন্নয়নেও ভূমিকা রাখছে…..নাকি ভুল বললাম! ভুল কিছু বললে আমাকে সংশোধন করে দিবেন দয়া করে।
প্রতিটা মানুষকেই তার প্রাপ্য সন্মান দেয়া উচিত। আর তা না দিতে পারলে অন্ততঃ অসন্মান যেন আমরা কোনভাবেই না করি।
ছবিটা গুগল থেকে নেয়া।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুন, ২০২০ দুপুর ১২:৫৭