সম্প্রতি তুর্কি সরকার পৃথিবীর এক সময়কার সবচাইতে বড় ক্যাথেড্রাল আয়া সোফিয়াকে মিউজিয়াম থেকে মসজিদে রুপান্তর করেছে। এতে অনেকেই খুশী, অনেকেই না। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এখানে তুর্কি সরকারের উদারতা দেখানো সম্ভব ছিল। এটা মিউজিয়াম থাকলে যেমন বিশ্ব-ইসলামের কোন ক্ষতি হতো না, তেমনি মসজিদ হওয়াতে বিশ্ব-ইসলামের কোন লাভও হবে না। খোদ তুরস্কেও এটাকে মসজিদ বানানো নিয়ে বিশাল আকারের কোন প্রতিবাদ, মিটিং, মিছিল হয়েছে বলে আমার জানা নাই। তুরস্কের সাধারন লোকজন এটাকে মিউজিয়াম হিসাবে দেখেই অভ্যস্ত ছিল। কাজেই লাভ যদি হয়, তাহলে এরদোগানের হবে। তিনিই এটার একমাত্র বেনিফিশিয়ারী। তবে আমার এই চিন্তা একটু হলেও ধাক্কা খেলো, যখন ব্লগার নতুন নকীবের পোষ্ট দেখলাম। উনার মূল বক্তব্য ছিল, যেটা একসময়ে মসজিদ ছিল, যেখানে একসময় নিয়মিত পাচ ওয়াক্ত নামায পড়া হতো, সেখানে অন্য কিছু করার অনুমতি ইসলামে নাই। কথা ঠিকই আছে, তবে এই কথা সম্ভবতঃ নিরপেক্ষ কোন জায়গায় স্থাপিত মসজিদের ক্ষেত্রে খাটে। কিন্তু এখানের বিষয়টা একটু আলাদা। এখানে সমস্যা হলো, মসজিদ হওয়ার আগে এটা একটা চার্চ ছিল। যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত উনি দিয়েছেন, তবে সেটা আমার চিন্তা এবং দ্বিধা আরো বাড়িয়েছে!
ইতিহাস আমার একাডেমিক বিষয় না হলেও পছন্দের বিষয়। শখের বসে ইতিহাস পড়া আর পৃথিবীর ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো যতোদূর সম্ভব ঘুরে দেখা আমার একটা বড় রকমের প্যাশান বলতে পারেন। তারই ধারাবাহিকতায় ইস্তান্বুলেও ঘুরতে গিয়েছিলাম। কাজেই সেখানকার ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো নিয়ে আমার মোটামুটি পড়াশোনা আছে। মাথায় তো সেগুলো আছেই, তার সাথে এই নতুন ঘটনা যুক্ত হওয়াতে ভাবলাম, আরেকটু ঘেটে দেখি। সেই ঘাটাঘাটি থেকেই আয়া সোফিয়ার রুপান্তরের ইতিহাস, ইসলামে এই ধরনের রুপান্তর সম্পর্কিত আদেশ-নির্দেশ আর আমার কিছু লজিক্যাল সিকোয়েন্সিং……..এই নিয়েই আমার এই লেখা। চলুন, তাহলে শুরু করা যাক।
প্রথমেই স্থাপনাটার ক্রম-রুপান্তরের একটা অতি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা।
রোমান সম্রাট জাস্টিনিয়ানের (প্রথম) আদেশে ৫৩২ থেকে ৫৩৭ খৃষ্টাব্দের মধ্যে কনস্টান্টিনোপলের খ্রিস্টান ক্যাথেড্রাল হিসাবে এটি নির্মিত হয়। ১৫১৫ সালে সেভিল ক্যাথেড্রাল সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত এটি প্রায় এক হাজার বছর ধরে বিশ্বের বৃহত্তম ক্যাথেড্রাল হিসাবে রয়ে গিয়েছিল। ১২০৪ সালে এটিকে চতুর্থ ক্রুসেডারদের দ্বারা লাতিন সাম্রাজ্যের অধীনে রোমান ক্যাথলিক ক্যাথেড্রালে রূপান্তরিত করা হয়। পরবর্তীতে ১২৬১ সালে আবার বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের ফিরে আসার পরে এটি পূর্বের অর্থোডক্স চার্চে ফিরে যায়। ১৪৫৩ সালে কন্সট্যান্টিনোপলের পতনের পর অটোমান সাম্রাজ্যের তৎকালীন মুসলিম শাসক ফাতিহ সুলতান মুহাম্মদ এটাকে মসজিদে রূপান্তরিত করেন আর ১৯৩৫ সা্লে কামাল আতাতুর্ক এটাকে যাদুঘরে রাপান্তরিত করেন। এ'বছরের জুলাইয়ের গোড়ার দিকে, কাউন্সিল অফ স্টেট ১৯৩৪ সালের মন্ত্রিসভার জাদুঘর স্থাপনের সিদ্ধান্ত বাতিল করে তুরস্কের রাষ্ট্রপতির একটি আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আয়া সোফিয়াকে পূণরায় একটি মসজিদ হিসাবে পুনঃনির্মাণের আদেশ দেয়।
ইসলামের প্রথম দিনগুলোতে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এবং উনার ছোট্ট বিশ্বাসী দল পূর্ববর্তী একেশ্বরবাদী - ইহুদি ও খ্রিস্টানদের মিত্র হিসাবে দেখেছিলেন; কারন, প্রথম দিককার মুসলমানগণ যখন পৌত্তলিক মক্কায় নির্যাতিত হয়েছিলেন, কেউ কেউ তখন ইথিওপিয়ার খ্রিস্টান রাজ্যে আশ্রয় পেয়েছিলেন। কাজেই আরো পরে মুসলমানদের দ্বারা মদীনা শাসনের সময়ে তিনি নাজরান শহর থেকে একদল খ্রিস্টানকে আমন্ত্রন জানান এবং তাদেরকে উনার মসজিদে এবাদত করারও সুযোগ দেন। তিনি তাদের সাথে একটা চুক্তিও করেন; যেটার ভাষ্য ছিল এমন, ''তাদের বিশ্বাস চর্চায় কোন রকমের হস্তক্ষেপ করা হবে না। কোনও বিশপ, সন্ন্যাসী কিংবা পুরোহিতকে তাদের ধর্মীয় ক্রিয়াকর্মে বাধা প্রদান করা হবে না।''
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন যে, "মঠ, গীর্জা, সিনাগগ ইত্যাদি উপাসনালয় এবং মসজিদগুলিকে আল্লাহ রক্ষা করেন, যেখানে আল্লাহ'র নাম অনেক বেশি উচ্চারিত হয়েছে।" (২২:৪০)। তারপরেও এটা নিশ্চিত যে, এই ধর্মতাত্ত্বিক সম্পর্কগুলি পরবর্তীতে রাজনৈতিক দ্বন্ধ রোধ করতে পারে নাই। তাই নবীজির ওফাতের পরে খ্রিস্টান ভূমি সিরিয়া থেকে স্পেন বিজয় যেমন বন্ধ রাখা হয় নাই তেমনি, ইসলামের প্রাথমিক পর্যায়ের মুসলিম বিজয়ীরা কখনও সে সময় পরাধীন লোকদের উপাসনালয় বা পবিত্র স্থান স্পর্শ করেন নাই।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে রোমান খ্রিস্টানদের দ্বারা পরিচালিত জেরুজালেম ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে জয় করার পরপরই খলিফা উমর (রাঃ) মহানবী (সাঃ) এর শিক্ষা আর আদর্শের সর্বোত্তম উদাহরণ প্রদর্শন করেছিলেন। এই শহরটি মুসলমানরা দখল করেছিল একটি দীর্ঘ এবং রক্তাক্ত অবরোধের মাধ্যমে। পরাজিত খ্রিস্টানরা যেখানে একটা গণহত্যার ভয় পেয়েছিল, তার পরিবর্তে তারা 'আমান' বা সুরক্ষা পেয়েছিল। 'আল্লাহ'র দাস' এবং 'বিশ্বস্ত সেনাপতি' খলিফা উমর (রাঃ) তাদের ''সম্পত্তি, গির্জা এবং ক্রুশগুলির জন্য" যথাযথ নিরাপত্তা দিয়েছিলেন। তিনি আরও আশ্বাস দিয়েছেন, "তাদের গীর্জা আবাসের জন্য নেওয়া হবে না এবং ধ্বংস করা হবে না ... বা তাদের ক্রুশগুলিও সরানো হবে না।"
খ্রিস্টান ঐতিহাসিক ইউটিচিয়াস এই ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন যে, খলিফা উমর (রাঃ) যখন শহরে প্রবেশ করেছিলেন, তখন জেরুজালেমের নগরপিতা সোফ্রোনিয়াস তাকে খ্রিস্টানদের সবচাইতে পবিত্রতম স্থান: চার্চ অব দ্য হলি সেপুলচারে (Church of the Holy Sepulcher) প্রার্থনা করার আমন্ত্রণ জানান। উমর (রাঃ) বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন যে, মুসলমানরা তাহলে পরে এই ঘটনাকে এই চার্চটিকে মসজিদে রূপান্তরিত করার কারণ হিসাবে গ্রহণ করতে পারে। অন্য কথায়, ইসলাম জেরুজালেমে কোন রকমের রূপান্তর না ঘটিয়েই প্রবেশ করেছিল।
মুসলমানদের শক্তি আর সাম্রাজ্য বৃদ্ধির সাথে সাথে আস্তে-ধীরে ইসলাম একটি সাম্রাজ্যের ধর্ম হয়ে উঠছিল; যা অন্য সব সাম্রাজ্যের মতো, আধিপত্যের জন্য কিছু কিছু বিষয়কে ন্যায়সঙ্গত মনে করতে শুরু করে। ফলে, কোন কোন বিজয়ী 'জেরুজালেম মডেল'টি কাটিয়ে উঠার অজুহাত খুজে পেয়েছিলেন এভাবে; সেখানে (জেরুজালেমে) খ্রিস্টানদের পুরোপুরি নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছিল কারণ তারা শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ আত্মসমর্পণের বিষয়ে একমত হয়েছিল। কিন্তু যে শহরগুলিতে মুসলিম বিজয়ীদের প্রতিহত করা হয়, সেখানে তারা লুটপাট, দাসত্ব এবং উপাসনালয় রুপান্তরের মতো কাজকে ন্যায্য মনে করেছিলেন।
এবার আসি ১৪৫৩ সালে কন্সট্যান্টিনোপল বিজয়ের কথায়। মুসলমান সেনাদল যে সময়ে কন্সট্যান্টিনোপলের নগর তোরণে এসে উপস্থিত হয়, ততোদিনে ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গির অনেক পরিবর্তন হয়েছে, যার অন্যতম কারন ছিল, ক্রুসেডারদের সাথে অন্তহীন সংঘাত।
সুতরাং, আমরা.....মুসলমানরা যদি সত্যই অতীতের থেকে কিছু পুনরজ্জীবিত করতে চাই তাহলে মহানবী (সাঃ) দ্বারা সূচিত মডেল এবং খলিফা উমর (রাঃ) দ্বারা প্রয়োগ করা মডেলটির দিকে মনোনিবেশ করা উচিত। এর অর্থ কোনও মন্দির বা চার্চকে মসজিদে রূপান্তর করা কিংবা পুনর্নির্মাণ করা উচিত না। সকল ধর্মীয় মুল্যবোধ এবং ঐতিহ্যকে সন্মান করা উচিত। সহনশীলতার বিশালত্বের উচিত আধিপত্যবাদের ক্ষুদ্রতা কাটিয়ে ওঠা। এটাই বোধহয় আল্লাহর আদেশ এবং আমাদের প্রিয় নবীজি (সাঃ)এর শিক্ষা।
ফাতিহ সুলতান মুহাম্মদ আয়া সোফিয়া কিনেছিলেন, নাকি কিনেন নাই, সেটা নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে আমি সেই বিতর্কে না গিয়ে আমার নিজস্ব কিছু বিশ্লেষণ এখানে তুলে ধরতে চাই। সাধারন বোধ অনুযায়ী, কোন ধর্মের মানুষই একজন বিধর্মীর কাছে স্ব-ইচ্ছায় নিজস্ব উপসনালয় বিক্রি করবে না, আয়া সোফিয়ার মতো ব্যাসিলিকা তো একেবারেই না। সে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃষ্টান কিংবা ইহুদী…….যাই হোক না কেন। অটোম্যান সম্রাটের কন্সট্যান্টিনোপল বিজয়ের পরে এটা হয়ে যায় উনার সাম্রাজ্যের অংশ। উনি যদি এটাকে মসজিদ বানাতে চান, তাহলে কার ঘাড়ে কয়টা মাথা যে, সে বা তারা এটার বিরোধিতা করবে! তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই যে, তিনি এটা নগদমুল্যে কিনেছিলেন; তারপরেও প্রশ্ন থেকেই যায়, যারা এটা বিক্রয় করেছিল তারা কি কোনরকমের অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হয়ে খুশী মনে এটা বিক্রয় করেছিল? জান বাচানো ফরজ, এটা আমাদের ধর্মেই আছে। তবে সকল যুগেই মোটামুটিভাবে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সবাই এই সূত্র মেনে চলে।
একটা উদাহরন দেই। রাশান সম্রাটের আলাস্কা বিক্রয়ের অন্যতম প্রধান কারন ছিল ভীতি, যে এই ভুখন্ড ভবিষ্যতে সে তার দখলে রাখতে পারবে না। কাজেই ''নগদ যা পাও, হাত পেতে নাও'' নীতিটাই ছিল তখন বুদ্ধিমানের কাজ। যদি আয়া সোফিয়া বিক্রিই হয়ে থাকে, সেরকম কোন কারন থাকা কি অযৌক্তিক? কথা হলো, অন্য ধর্মাবলম্বীদেরকে ভয় দেখিয়ে তাদের উপাসনালয় দখল করা কি ইসলাম সমর্থন করে? মূল কথা, তখন সুলতানের ইচ্ছাটাই ছিল আদেশ, যার অন্যথা করার কথা কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারতো না। আর বিধর্মীদের জন্য তো সেটা একটা অসম্ভব কল্পনা!!!
একটা বিষয় পরিস্কার করে দেয়া ভালো। এটা নকীবভাইয়ের পোষ্টের কোন কাউন্টার পোষ্ট না, বরং এটাকে উনার পোষ্টের একটা সম্পূরক পোষ্ট বলা যেতে পারে। আমি স্বীকার করে নিচ্ছি, ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত আমার জ্ঞান অত্যন্ত সাধারন মানের। ধর্মের অনেক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে আমি আমার নিজের লব্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগাই। তবে আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকে তা যেন অবশ্য অবশ্যই ইসলামের মূল আদর্শ থেকে বিচ্যুত না হয়ে করা হয়। তারপরেও কম জানার কারনে ভুল হয়ে যেতেই পারে। সেজন্যেই নতুন এবং পুরাতন, সব নকীবভাইসহ সবাইকে আলোচনার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। এতে করে আমার চিন্তা-চেতনায় পোষ্ট সংক্রান্ত কোন বিভ্রান্তি থাকলে সেটা দূর করা সম্ভব হবে। এটা আমার জন্য যতোটা প্রযোজ্য, ''আমাদের'' জন্যও ঠিক ততোটাই। আমার বিশ্বাস…….সঠিক রেফারেন্স, তার ব্যাখ্যা এবং সুস্থ ও গঠনমূলক আলোচনা; শুধুমাত্র এগুলোর মাধ্যমেই আমাদের সকল রকমের বিভ্রান্তি দূর করা সম্ভব। আর এই ''সুস্থ ও গঠনমূলক আলোচনা'' রিমাইন্ডস মি এ্যানাদার থিং! লেট মি টেল য়্যু দ্যাট!!
আমি নীতিগতভাবেই একজন নির্বিরোধী মানুষ; তবে হঠাৎ হঠাৎ চেইতা যাওয়ার একটা অতি বদ অভ্যাস আমার আছে। তাই ক্যাচালপ্রিয় ব্লগারদেরকে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে অনুরোধ করবো আমার এই পোষ্টে কোন ধরনের ক্যাচাল না করার জন্য। সেটা হতে পারে ধর্ম সংক্রান্ত কটুক্তি কিংবা অন্য কারো মন্তব্যের সূত্র ধরে ব্যঙ্গ করা বা আপত্তিকর শব্দ চয়ন। এমন পরিস্থিতিতে আমি হার্ডলাইনার হলে দিনশেষে আমাকে আবার দোষ দিবেন না যেন!!
তথ্য এবং ছবিটা গুগল থেকে নেয়া।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ৮:১৫