somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটা লাইফটাইম অভিজ্ঞতা আর কিছু স্মৃতিচারণ!

১৪ ই মার্চ, ২০২১ দুপুর ১২:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আর দশটা সাধারন আলসের মতোই ঘুম আমার খুব প্রিয়। দিবা নিদ্রাও। তবে দিনে ঘুমালে রাতে একেবারেই ঘুম হয় না। ঘুম আসে একেবারে ভোরের দিকে। ঘুমের চক্রও নষ্ট হয়ে যায়। তাই পারতঃপক্ষে আমি দিনে ঘুমাতে চাই না। শনিবার আমার দিবানিদ্রার জন্য মোক্ষম দিন। গত শনিবারের আগের শনিবারেও ঘুমিয়েছি আর রাতে যথারীতি জেগে। ভাবলাম একটা বই পড়ি, তাতে করে যদি ঘুম আসে; তবে কোন লাভ হচ্ছিল না। রাত তিনটার দিকে বের হলাম একটা বিড়ি খাওয়ার জন্য। বের হয়েই হার্টবিট মিস করলাম। ড্রাইভওয়েতে পার্ক করে রাখা আমার গাড়িটা নাই। আধা ঘন্টা আগেও একবার বিড়ি খেতে বের হয়ে দেখেছি ওটাকে। এখন নাই! বিষয়টা বুঝলাম না। গাড়ি তো আমাকে ছাড়া কোথাও যায় না!!!

কাপতে কাপতে ৯৯৯তে ফোন দিলাম পুলিশকে। কথোপকথন নিম্নরুপঃ

আমি কাদো কাদো স্বরে বললাম, ও মামু, আমার গাড়ি ড্রাইভওয়েতে আছিলো, এহন তো দেহি নাই!

ফোনের অপর প্রান্ত থেকে বললো, কস কি ভাইগনা!! ড্রাইভওয়েতে রাখছিলি নিশ্চিত, নাকি রাস্তায়…..চেক কইরা দেখ! গাড়িতে ট্র্যাকার লাগাইছিলি?

না না, ড্রাইভওয়েতেই রাখছিলাম। এই আধাঘন্টা আগেও দেখছি। হ…..ট্র্যাকার আছে।

তোর গাড়ির সব ডিটেইলস দে। অক্ষনই আমি সবকয়টা ইউনিটরে লাগায়া দিতাছি আর রেডিও স্টেশানেও খবর দিতাছি। চৌরা হালারা মনে কয় বেশীদূরে যাইতে পারে নাই।

নির্ঘুম সারারাত পার করলাম আকাশ-পাতাল চিন্তা করে আর ঘন্টায় ঘন্টায় বিড়ি ফুকে। গাড়ি সংক্রান্ত যতো স্মৃতি এ'যাবৎকাল পর্যন্ত মগজে সংরক্ষিত আছে সব সিনেমার মতো চোখে ভাসতে লাগলো। সকাল আটটার দিকে ফোন পেলাম, গাড়ি পাওয়া গিয়েছে। চোর কান্ট্রিসাইডে রেখে ভেগেছে। আমাকে গাড়ির ফব (চাবির মতো) নিয়ে পুলিশ স্টেশানে যেতে বললো। গেলাম। কাদা মাখা গাড়িটা আমাকে দেখে আবেগতাড়িত হলো, আমিও হলাম। চার চক্ষুর মিলন শেষ করে মামুকে বললাম, তয় আর কি? নিয়া যাই আমার ফিরা পাওয়া হারানো মানিকরে, কি কও! ব্যাটা বলে, না। গাড়ি কাইলকা দিমু। কি সব ফরেনসিক টেস্ট ফেস্ট করবে, অদেখা চোরদেরকে ধরার জন্য।

আচ্ছা…….ওরা টেষ্ট করতে থাকুক। ততোক্ষণে আমি একটু স্মৃতি রোমন্থন করি। তবে এবার একা না, আপনাদেরকে সাথে নিয়ে।

আমরা পাচ ভাইবোন। আমার বড় তিনজনই বোন। আম্মা পর পর তিন মেয়ের জন্ম দেয়াতে দাদা-দাদিসহ সবাই পড়ে গেল টেনশানে। আব্বা পরিবারের বড় ছেলে, তার একটা ছেলে নাই…...এটা কেমন কথা? যে সময়ের কথা বলছি, তখন বিষয়টা এমনই ছিল। ফ্যামিলি ট্রি ঠিক রাখতে ছেলে দরকার! আম্মা যখন চতুর্থবারের মতো অন্তঃসত্ত্বা হলেন, তখন দাদাজান ঘোষণা দিলেন, ছেলে হলেই উনি গাড়ি কিনবেন আর সেই গাড়িতে করেই বংশের বাত্তি বাইত্তে আসবে। এখানে উল্লেখ্য, আমার জন্ম হাসপাতালে হয়েছিল। আমার ধারনা, মায়ের পেটে আমি প্রথমে মেয়েই ছিলাম। তবে আল্লাহর দরবারে আম্মার কান্নাকাটি আর দাদাজানের ঘোষণার কারনেই মনে হয় ছেলেতে রুপান্তরিত হই। এই রুপান্তর প্রক্রিয়ায় সম্ভবতঃ কোন সমস্যা দেখা দিয়েছিল। জন্মের পর আমাকে প্রায় মাসখানেক হাসপাতালে থাকতে হয়। দাদাজান উনার কথা রেখেছিলেন। আমাদের প্রথম গাড়িটা ছিল ফক্সওয়াগেন…….কচ্ছপমার্কা, বিটলস যার পোষাকী নাম। আমি নতুন কেনা গাড়িতে করেই বাসায় আসি। এভাবেই গাড়ি জিনিসটার সাথে আমার একটা নিবিড় আত্মার সম্পর্ক গড়ে ওঠে!

গাড়ি আব্বার খুবই পছন্দের একটা জিনিস ছিল। ওটা উনার শুধু শখই না, উনি এই ব্যাপারে ওবসেসড ছিলেন। পৈতৃক সূত্র ধরে আমিও গাড়ির ব্যাপারে ওবসেসড। শিশুকালে আমাকে দুধ খাওয়ানো নাকি খুবই কষ্টকর ছিল, তবে সামনে একটা খেলনা গাড়ি থাকলে আর কোন সমস্যা হতো না। এভাবে আমার গাড়িপ্রীতি আত্মীয় এবং পরিচিত মহলে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে, জন্মদিন বা যে কোনও অনুষ্ঠানে আমার জন্য সবাই গাড়ি আনা শুরু করলো। চারদিক থেকে জলের মতো গাড়ি এসে আমার দোলনা মোটামুটি গাড়িময় হয়ে যায়। যাকগে, এসবই আমার শোনা কথা। আমার স্মৃতিতে এ'সংক্রান্ত কোন তথ্য জমা নাই।

তিন মেয়ের পরে প্রথম ছেলেসন্তান। আমার প্রতি আদরটা ছিল বাড়াবাড়ি রকমের। অতি আদরে বাদর হওয়া একটা স্বাভাবিক পরিণতি। আমিও এর বাইরে ছিলাম না। আমার বড়খালা আমাকে দেখলেই বলতেন, কি রে তোর লেজ গজায় নাই এখনও? প্রত্যেকদিন সকালে উঠে চেক করবি। আর গজালে খবরটা সর্বপ্রথম আমাকে দিবি। তাহলে আমি তোকে চাবি দেয়া একটা গাড়ি কিনে দিবো। সেই গাড়ির লোভে আমিও প্রতিদিন সকালে উঠেই লেজ অনুভবের চেষ্টা করতাম।

একদিকে বাদর-স্বভাব আর অন্যদিকে গাড়ির প্রতি টান! সেই কারনেই আমাদের প্রথম ড্রাইভার আঙ্কেলকে (উনার নাম মনে নাই) আব্বার কড়া নির্দেশ ছিল, আমাকে ড্রাইভিং সিটের ধারে-কাছে যেন যেতে না দেয়া হয়। আর ওই বজ্জাৎ আঙ্কেল আমার শত অনুনয়-বিনয়েও কান দিতেন না। কপাল ভালো, সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় ওনার রিপ্লেসমেন্ট হিসাবে আসেন তৌফিক আঙ্কেল। উনি আমাকে আদর দিয়ে প্রায় মাথায় তুলে ফেলেন (যতোদূর মনে পড়ে, ওনার দুইটা মেয়ে ছিল, কোন ছেলে ছিল না)। প্রায়ই আমার জন্য উনার সাধ্যমতো এটা সেটা নিয়ে আসতেন। ওনার আশকারা পেয়েই আস্তে আস্তে আমি আমার এতোদিনের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হই। স্কুল থেকে ফেরার সময়ে ধানমন্ডি মাঠে আমার স্টিয়ারিংয়ে বসা শুরু।

একদিনের ঘটনা বলি। তখন আমি নাইনে পড়ি। মাঠে গাড়ি চালানোর সময় রিভার্স করতে গিয়ে সামনে স্তুপ করে রাখা ইটের উপর গাড়ি তুলে দিয়েছিলাম (যাদের ফক্সওয়াগেনের এই মডেলটা চালানোর অভিজ্ঞতা আছে, তারা জানেন এটার রিভার্স গিয়ারটা অন্যরকম)। গাড়িতে বেশ খানিকটা ডেন্ট হয়ে যায়। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, তৌফিক আঙ্কেল আব্বাকে জানান, এটা উনার ভুলে হয়েছে। রাস্তায় পার্ক করতে গিয়ে ইটের স্তুপ খেয়াল করেন নাই। উনার বেতন থেকে যেন রিপেয়ারের টাকা কেটে রাখা হয়। সেদিন রাতে খেতে বসে আব্বা আমাকে বলেছিলেন, তৌফিক কিভাবে গাড়ি চালায় আমি জানি। আর আমি এটাও জানি যে, এটা তোমারই কাজ। কলেজে ওঠার আগে আমি যেন আর না শুনি যে, তুমি স্টিয়ারিংয়ে হাত দিয়েছো। আব্বাকে বাঘের মতো ভয় করতাম। তবে সেটা আমাকে কোন অকাজ করা থেকে বিরত রাখতে পারতো না। কিন্তু তৌফিক আঙ্কেলের আমার প্রতি এহেন ত্যাগের মানসিকতা দেখে আর কোনদিন ওনার কাছে ড্রাইভিংয়ের আব্দার করি নাই।

কলেজে ওঠার পরে হাত একেবারে পাকিয়ে ফেলি। কলেজে পড়ার শেষের দিকে ঘটে আমার জীবনের একটা অন্যতম স্মরনীয় ঘটনা। এক ছুটির দিনে আব্বা আমার হাতে গাড়ির চাবি তুলে দিয়ে বলেন, চলো বাজার করে আসি। আর দেখি, কেমন গাড়ি চালানো শিখেছো তুমি! আব্বাকে পাশে বসিয়ে সেদিনের গাড়ি চালানোর কথা কোন দিন ভুলবো না। শুধু বলি, টেনশানের কারনে গ্যারাজ থেকে একবারে গাড়ি বের করতে পারি নাই!!

গাড়ি ছিল আমার ধ্যান-জ্ঞান। এমনকি স্বপ্নেও গাড়ি চালাতাম। জীবনের এই পর্যায়ে এসেও সেসব একটুও কমে নাই। ড্রাইভিং সিটে বসলেই আমি অন্যরকমের আনন্দ পাই। ব্লগে আমার প্রথম পোষ্ট যারা পড়েছেন, তারা সেখানে আমার গাড়িপ্রীতির কিছুটা নমুনা পেয়ে থাকবেন। গাড়ি নিয়ে আমি সারাদিন বকর বকর করতে পারি। তবে সেসব করে আপনাদের উপর মানসিক অত্যাচার করার কোন মানে নাই। তাই আপাততঃ এখানেই থামলাম। সময়-সুযোগ হলে আবার কোন একদিন কিছু কথা নিয়ে হাজির হলেও হতে পারি! তাছাড়া, এই খুশী উপলক্ষে আজ সুমনা ভাবীদেরকে দাওয়াত দিয়েছি। অনেক কাজ বাকী!! :P

আপনাদের কারো গাড়ি চুরি যাওয়ার কোন অভিজ্ঞতা হয়েছে? হলে জানাবেন। চাইলে আলাদা পোষ্টও দিতে পারেন। আমার জন্য এটা ছিল কইলজাতে টান পড়া একটা লাইফ টাইম অভিজ্ঞতা। তবে এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন আর হতে চাই না ভবিষ্যতে। সেজন্যে পুলিশ স্টেশান থেকে আমার সাথীকে বাসায় নিয়ে আসার পথে একটা স্টিয়ারিং লকও কিনে নিয়ে এসেছি। ডাবল সিকিউরিটিতে থাকুক আমার পথচলার সার্বক্ষনিক সাথী!!

শিরোনামের ছবিটা আমার হারিয়ে ফিরে পাওয়া মানিকের! এখন পর্যন্ত আমি যতোগুলো গাড়ি ব্যবহার করেছি, তার মধ্যে এটাই আমার সবচেয়ে প্রিয়। পুলিশের ছাড় পাওয়ার পর তাকে গোসল করিয়ে ছবিটা তুলেছি।
ক্যামেরাঃ আমার নয়া আইফোন ১২ প্রো!!! =p~
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মার্চ, ২০২১ দুপুর ১২:৫৮
৩২টি মন্তব্য ৩২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মানুষের জন্য নিয়ম নয়, নিয়মের জন্য মানুষ?

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৪৭



কুমিল্লা থেকে বাসযোগে (রূপান্তর পরিবহণ) ঢাকায় আসছিলাম। সাইনবোর্ড এলাকায় আসার পর ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি আটকালেন। ঘটনা কী জানতে চাইলে বললেন, আপনাদের অন্য গাড়িতে তুলে দেওয়া হবে। আপনারা নামুন।

এটা তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

একটা গাছ কাঠ হলো, কার কী তাতে আসে গেলো!

লিখেছেন নয়ন বড়ুয়া, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:০৬



ছবিঃ একটি ফেসবুক পেইজ থেকে

একটা গাছ আমাকে যতটা আগলে রাখতে চাই, ভালো রাখতে চাই, আমি ততটা সেই গাছের জন্য কিছুই করতে পারিনা...
তাকে কেউ হত্যা করতে চাইলে বাঁধাও দিতে পারিনা...
অথচ... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। কালবৈশাখী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:২৪



গত পরশু এমনটি ঘটেছিল , আজও ঘটলো । ৩৮ / ৩৯ সে, গরমে পুড়ে বিকেলে হটাৎ কালবৈশাখী রুদ্র বেশে হানা দিল । খুশি হলাম বেদম । রূপনগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

একজন খাঁটি ব্যবসায়ী ও তার গ্রাহক ভিক্ষুকের গল্প!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৪


ভারতের রাজস্থানী ও মাড়ওয়ার সম্প্রদায়ের লোকজনকে মূলত মাড়ওয়ারি বলে আমরা জানি। এরা মূলত ভারতবর্ষের সবচাইতে সফল ব্যবসায়িক সম্প্রদায়- মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ীরা ঐতিহাসিকভাবে অভ্যাসগতভাবে পরিযায়ী। বাংলাদেশ-ভারত নেপাল পাকিস্তান থেকে শুরু করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×