আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।
আমেরিকা প্রবাসী আমার বড় বোনের প্রথম সন্তান হবে। এই ধরাধামে আমাদের পরের জেনারেশানের প্রথম সদস্যের আবির্ভাব ঘটতে যাচ্ছে, আব্বা-আম্মা প্রথমবারের মতো নানা-নানী হতে যাচ্ছেন……...সবাই তুমুল উত্তেজিত। উনারা সিদ্ধান্ত নিলেন মেয়ের পাশে থাকার। মাস তিনেকের জন্য সেখানে যাবেন; শুনে আমি ডাবল উত্তেজিত। কারন আর কিছুই না। প্রথমবারের মতো লম্বা সময়ের জন্য অবাধ স্বাধীনতার সুগন্ধ পাচ্ছি। যখন খুশী বাসায় ফিরবো, যখন খুশী ঘুমাবো আর ঘুম থেকে উঠবো, যা ইচ্ছা তাই করবো……...বলার, শাসন করার কেউ থাকবে না।
আব্বা-আম্মা চলে যাওয়ার পরের প্রথম দুই সপ্তাহ কিভাবে কেটে গেল, উদ্দামতায় টেরই পেলাম না। তৃতীয় সপ্তাহ থেকে কেমন যেন লাগা শুরু হলো। এক মাস পার হওয়ার পর মন খারাপ করা শুরু হলো। আম্মার উপস্থিতি, রান্না, কথা……..এক কথায় সব কিছু মিস করতে লাগলাম। শুরু করলাম ঘ্যান ঘ্যান। টেলিফোনে যখনই কথা বলি, ইনিয়ে বিনিয়ে ঘুরে-ফিরে একটাই কথা, চলে আসেন। আমার বোন আমার উপরে ভয়ানক ক্ষেপে গেল। ও আম্মাকে আরো কিছুদিন থাকার জন্য রাজি করিয়ে ফেলেছিল, আমার অত্যাচারে আম্মা সেটা বাতিল করে দেশে ফিরলেন। আর সেবারই প্রথমবারের মতো আমার উপলব্ধি হলো, আম্মার অনুপস্থিতিতে আমার এই আপাতঃ অবাধ স্বাধীনতা একেবারেই রুপ-রস-বর্ণহীন, বিস্বাদ!
আম্মার অবস্থান আমার জীবনে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ, এটা বলে বোঝানো যাবে না। তাই সেই চেষ্টা বাদ দিলাম। ''মায়ের আচল-ধরা ছেলে'' বলতে যা বোঝায়; বলতে দ্বিধা নাই, আমি ছিলাম অনেকটা তাই। শুধুমাত্র এই কারনেই প্রচুর সুযোগ থাকার পরেও বিদেশে স্থায়ী হওয়ার ইচ্ছা আমার কোন কালেই ছিল না। তাছাড়া দেশ ছেড়ে, প্রাণের শহর ঢাকাকে ছেড়ে অন্য কোথাও চিরদিনের জন্য স্থায়ী হবো, এটা আমি স্বপ্নেও ভাবতাম না কখনও। কিন্তু কথায় আছে না….মানুষ ভাবে একটা, ঘটনা ঘটে আরেকটা! বিয়ে, চাকুরী সবকিছু নিয়ে গুছিয়ে বসার পরেও জীবনের একটা পর্যায়ে এসে বিবিধ কারনে সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য হলাম। আমার আমেরিকা-কানাডাতে প্রচুর আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব আছে, তুলনায় ইংল্যান্ডে বলতে গেলে তেমন কেউ নাই। তারপরেও ইংল্যান্ডে স্থায়ী হওয়ার সিদ্ধান্তের পেছনে সবচেয়ে বড় কারন ছিল.........দুরত্ব। প্রতি বছর আমাকে যে একবার দেশে আসতেই হবে!
২০১৬ এর দিকে আম্মার পার্কিনসন্স অসুখটা ধরা পড়লো। সম্ভবতঃ তার হাত ধরেই আস্তে আস্তে এগিয়ে এলো আলঝেইমার্স! আমি আম্মাকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য বেশীরভাগ সময়ে না জানিয়েই দেশে উপস্থিত হতাম। ২০১৮তে দেশে গেলাম। আলঝেইমার্স আম্মাকে কতোটা ছোবল মেরেছে তার বাস্তবতা বুঝি নাই তখনও। আম্মার সামনে গিয়ে দাড়ালাম। আমাকে পুরাই ভড়কে দিয়ে উনি বললেন, আস-সালামু আলাইকুম। কেমন আছেন? আপনারে তো চিনলাম না ঠিকমতো! আমি বললাম, আম্মা, আমি আপনের বড় ছেলে। চিনেন নাই? আমার কথা শুনে আম্মা মাথার ঘোমটা আরো খানিকটা টেনে নিয়ে কাছেই দাড়ানো কাজের মেয়েটাকে বললেন, দাড়ায়া আছিস কেন? বাসায় মেহমান আসছে। চা-নাস্তা দিতে হবে না!!! বসে কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে হঠাৎ মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, তুই তো দেখি শুকায়ে গেছিস। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করিস না? বুঝতে পারলাম, উনার কগনিটিভ ফাংশান হঠাৎই এক্টিভ হয়েছে। এমনই অন-অফ পরিস্থিতি চলমান ছিল তখন।
দিনে দিনে আম্মার অবস্থার অবনতি হতেই থাকলো। ২০২০ এর জানুয়ারীতে আমরা সবাই দেশে জড়ো হলাম। আম্মার শরীর তখন বেশ খারাপ, কাউকেই চিনতে পারছেন না আর। এমনকি উনার সার্বক্ষণিক পরিচর্যার জন্য যে নার্স ছিল, তাকেও চিনতে পারছেন না। শরীর একদম শুকিয়ে কাঠ! একদিন রাত একটার দিকে বারান্দায় একা বসে আছি। আকাশ-পাতাল ভাবছি; ভাবছি, আম্মা কি আর কখনও আমাকে চিনতে পারবেন না! হঠাৎ কি হলো……..ভিতর থেকে অগ্নুৎপাতের মতো দলা পাকানো কান্না ছিটকে বেড়িয়ে এলো। থামানোর কোন সুযোগই পেলাম না। আমাকে শব্দ করে কাদতে শুনে আমার বউ পাশে এসে দাড়ালো। আমি কিছুটা লজ্জা পেয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলাম। দেখি, ও অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার কান্না বা চোখে পানি দেখা ওর জন্য একটা অচিন্তনীয় ব্যাপার! আসলে অবাক তো হওয়ারই কথা! কুমীর প্রজাতীর কারো চোখে পানি কে কবে দেখেছে!!!
প্রচন্ড রকমের মন খারাপ নিয়ে ফিরে এলাম ফেব্রুয়ারীতে। এরপরেই বিশ্বব্যাপী শুরু হয়ে গেল করোনা মহামারীর দাপট। বিশ্ব পরিস্থিতির অবণতির সাথে পাল্লা দিয়ে আম্মার শারীরিক অবস্থারও অবণতি ঘটতে থাকলো। এ'বছর দেশে আসার জন্য কয়েকবারই চেষ্টা করলাম। বাংলাদেশকে লাল তালিকায় রাখাসহ আরো কিছু কারনে বার বার পিছিয়ে গেলো আমার সে প্রচেষ্টা। অক্টোবরের ১৩ তারিখে খবর পেলাম, আম্মার শরীর খুবই খারাপ। দেশে আসার তোড়জোড়ের মধ্যেই খবর পেলাম, আম্মা আমাদেরকে ফেলে চিরদিনের জন্য চলে গিয়েছেন না ফেরার দেশে। মেজচাচা ফোন করে বললেন, তোমরা চাইলে তোমাদের না আসা পর্যন্ত আমরা দাফন পিছিয়ে দিতে পারি, তবে তাতে করে ভাবীর রুহ কষ্ট পাবে। সারাজীবন কতোভাবেই না আম্মাকে কষ্ট দিয়েছি; শেষবারের মতো আর দিতে মন চাইলো না। আমরা, ভাইবোনদের মিলিত সিদ্ধান্তে আর দেরী না করার সিদ্ধান্ত নিলাম।
এই পোষ্টটা লেখার সময়ে মাথার মধ্যে মান্না দে'র ''কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই'' গানের ক'টা লাইন খুব যন্ত্রণা দিয়েছে।
একই সে বাগানে আজ
এসেছে নতুন কুড়ি;
শুধু সেই সেদিনের মালী নেই।
আমাদের ''পরিবার'' নামের বাগানটাতে নতুন কুড়ি অনেক এসেছে, কিন্তু বাগানের সৌন্দর্য বিকশিত করতো যেই মালী; হারিয়ে গিয়েছে চিরতরে। মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে প্রার্থনা, আম্মার এই চিরনিদ্রা যেন শান্তির হয়। রাব্বির হাম-হুমা কামা রাব্বায়ানি সাগিরা: "হে আমার প্রতিপালক! আমার পিতা-মাতার প্রতি দয়া করো, যেমন তারা দয়া, মায়া, মমতা সহকারে শৈশবে আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন।''
কিছু কথাঃ
দুই সপ্তাহের জন্য দেশ থেকে ঘুরে এসেছি। যেই উৎসাহ নিয়ে আগে দেশে যেতাম, সেটা আর নাই। দেশটা কেমন যেন ফাকা ফাকা। অন্য সময়ে দেশ থেকে ঘুরে এসে যেই উদ্দীপনার সাথে দৈনন্দিন জীবনে ঝাপিয়ে পড়তাম, সেটাও আর নাই। অফিসে যাই, বাসায় আসি; বেচে থাকার জন্য যতোটা করা দরকার, করি। এর বাইরে কিছু করতে মন চায় না। আমি যেন একটা রোবটে পরিণত হয়েছি। কোন কিছুতেই উৎসাহ পাই না। শরীরের কলকব্জাও কেমন যেন বিদ্রোহ করে আজকাল। আমার বউ আগে ব্লগিংয়ে সময় দিলে বাকাভাবে তাকাতো। সেই মানুষটাই আমাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়েছে, ব্লগে যা হোক কিছু একটা লিখে যেন পোষ্ট করি। কী-বোর্ডে হাত রাখতেই ইচ্ছা করে না এখন, তারপরেও সেই প্রতিজ্ঞা রাখতেই এই পোষ্ট। আপ্রাণ চেষ্টা করছি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার, তবে কবে নাগাদ সেটা সম্ভব হবে……….তাও জানি না।
আমার আম্মার জন্য দোয়া করবেন।
ছবিটা নেট থেকে নেয়া।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে নভেম্বর, ২০২১ দুপুর ১:৩৩