গত সপ্তাহ সোমবার সকাল সাড়ে আটটার সময় ক্রিসের একটা ফোন পেলাম। ক্রিস চি চি করে মোটামুটি করুণ সুরে বললো,
মফিজ, আমি আজকে অফিসে যাইতে পারবো না। তুমি দয়া কইরা বসরে একটু বুঝায়া বইলো।
আমি বললাম, আমারে বলার মানে কি? তুই জেনিরে ফোন কইরা জানা!! (জেনি অর্থাৎ জেনিফার আমাদের রিসিপশনিষ্ট)।
না, ওই মুটকিটা আমারে দেখতে পারে না। বানায়া বুনায়া বসের কান ভারী করবো। তুমিই বরং জানায়ো।
তোর গলার আওয়াজে তো আমার সন্দেহ হইতাছে। অবস্থা কি আসলেই খারাপ, নাকি একটিং করতাছোস?
ক্রিস এইবার আসল গলায় হে হে করে একচোট হেসে নিল। বললো, আসলে অতোটা খারাপ না। অফিসে চাইলে যাইতে পারি! তয় কাইল ফোরথ কোভিড জ্যাবটা নেওয়ার পর থিকা শরীলটা ক্যামন জানি ম্যাজ ম্যাজ করতাছে। টেম্পারেচারও আছে খানিকটা। তাই ভাবলাম, ইকটু রেস্ট লই!!!
আমি বললাম, তোরে কোনটা দিছে?
ও বললো, ফাইজার। তয় ফাইজার তো আগেও নিছি, সমস্যা হয় নাই। আমার মনে হয় ফ্লুর জ্যাবটাই ঝামেলা করতেছে। তারপরে একটা ভিলেনীয় হাসি দিয়ে বললো, তোমার তো সামনের সপ্তাহে ডেট তাই না? সাবধানে থাইকো। আর আমার দেখাদেখি তুমিও আবার একটিং কইরো না। তোমারে না দেখলে অফিসে আজকাল কেউ কেউ কেমন জানি আপসেট হয়!!! গা-জ্বলানো হাসিটা আরেকবার দিয়েই ফোন রেখে দিল ক্রিস।
কিঞ্চিৎ মন খারাপ করেই অফিসে গেলাম। আসলে সকালে কাজ শুরু করার আগে আমাদের প্রথম কাজ হলো, কফি সহকারে একটা ফ্যাগ-সেশান করা। দৈনন্দিন রুটিনে ছন্দ-পতন হলে কারই বা ভালো লাগে? অফিস থেকেই আমার সার্জারীতে ফোন করে জানালাম, আমি মডের্নার ভ্যাক্সিন নিতে চাই। আর ফ্লুর ভ্যাক্সিনটা একসাথে নিতে চাই না।
গতকাল যথাসময়ে গেলাম জ্যাব নিতে। রুমে ঢুকেই সুমো ফাইটারের মতো বিশাল বপু'র মহিলা নার্স দেখে ভড়কে গেলাম। আমাকে ঢোক গিলতে দেখে নার্স বললো,
বসো। ভয়ের কিছু নাই। এর আগেও তো তুমি তিনটা ডোজ নিছো, কাজেই অভিজ্ঞতা আছে। তাই না?
আমি বললাম, ভ্যাক্সিন নিয়া ভয় পাইতেছি না। তোমারে দেইখা ভয় পাইছি। তুমি সাবধানে ধীরে-সুস্থে দাও। টেইক ইয়োর টাইম!! আমার হাতে প্রচুর সময় আছে।
মহিলা খানিকটা রাগ করতে গিয়ে হেসে দিল। বললো, তোমার প্রচুর সময় থাকলেও আমার নাই। তবে আমি শুধুমাত্র দুষ্টদেরকে ব্যাথা দেই। আশা করি, তুমি সেই টাইপের না। তারপরে বললো, শুনলাম, তুমি নাকি ফাইজার নিতে চাচ্ছো না, আর এটার সাথে ফ্লু ভ্যক্সিনটাও নিতে চাচ্ছো না? বিশেষ কোন কারন?
বললাম, আমার এক কলীগ দুইটা ভ্যাক্সিন একসাথে নিয়া খানিকটা বিপদে পড়ছিল। সেইজন্য ভাবলাম, আপাততঃ একটাই নেই। আর আমার প্রথম দুই ডোজ ছিল এস্ট্রাজেনেকা। তৃতীয়টা ছিল ফাইজার। এই ফাইজার আমারে বেশ খানিকটা প্যারা দিছিলো। তো এইবার ভাবলাম মডের্নার টেস্টটা কেমন একটু চাইখা দেখি!!
ভ্যক্সিনের টেস্ট তুমি কিভাবে নিবা? তারপরে বিষয়টা বুঝতে পেরে কপট রাগ দেখিয়ে বললো, নতুন জিনিসের প্রতি তোমার যে আগ্রহ, সেইটা জীবনের সব ক্ষেত্রে এ্যপ্লাই করতে যায়ো না আবার! বিপদে পড়বা।
আমি একটা হাসি দিয়ে বললাম, কুত্তার লেজ যেমন সোজা হয় না, তেমনই আমার এই অভ্যাসও যাবে না। বিপদে যে পড়ি নাই, তা না। অনেকবারই পড়ছি। তারপরেও খাসলতটাই এমন; কি করবো কও!! নতুন জিনিস দেখলেই জিহ্বা কেমন জানি লক লক করে!!!
ঘর কাপিয়ে একটা হাসি দিল মহিলা। বললো, তুমি যে একজন খুব মজার মানুষ, এইটা তোমার বউ জানে?
বললাম…….না। সে আমাকে একজন বদ মানুষ হিসাবে জানে।
আমার কথা একপ্রকার লুফে নিয়েই নার্স জানালো, আমিও প্রথমদিকে আমার হাজবেন্ডকে একজন মজার মানুষ হিসাবেই জানতাম। পরে দেখি, সে বিরাট বদ! বিরাট মানে বুঝলা তো…...বিরাট!! বদের বদ!!!
একজন লেফটি হিসাবে ভ্যাক্সিন নিয়েছি ডান হাতে। প্রথমদিকে ২/৩ ঘন্টা হাতে হাল্কা রকমের একটা চিনচিনে ব্যাথা ছিল। ড্রাইভ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে দেখি সেটা উধাও। ভাবলাম, স্টিয়ারিং ঘুরানোতে যেই এক্সারসাইজ হয়েছে, সেটা কাজে দিয়েছে। কিন্তু বাসায় এসে দুই তিন ঘন্টা পর পুরাই কাইত। শুরুটা আবারও হাতে চিনচিনে টাইপের ব্যাথা দিয়ে; কিছু পরে সেটা রূপ নিল ভোতা ধরনের ব্যাথায়। টেম্পারেচারের আনাগোনা দেখে আগেভাগেই শুয়ে পড়লাম। বেশ কয়েকঘন্টা পর ঘুম ভাঙ্গলো টনটনে ব্যাথায়। দেখি, যেই হাতে টিকা নিয়েছিলাম, সেই হাতের উপর কাৎ হয়ে শুয়ে আছি। নিজের উপর চরম বিরক্ত হলাম। ঘুমের মধ্যেও কিছুটা আক্কেল তো অন্ততঃ কাজ করা উচিৎ!! সম্ভবতঃ আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ও আমার সাথে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
ব্যাথা বাড়তেই থাকলো। অবস্থা এমন দাড়ালো যে, হাতই আর নাড়তে পারি না। দিলাম ফোন ডাক্তারকে। বললাম, তোমার নার্স কি জিনিস ঢুকাইলো আমার শরীরে! ব্যাথায় তো জান যায় যায়!! ডাক্তার বললো, দুইটা প্যারাসিটামল মাইরা দিয়া কেৎরায় পইড়া থাকো। আগামী দুই দিনেও ব্যাথা যদি না যায়, জানায়ো। এস্ট্রাজেনেকা, ফাইজার আর মডের্নার মিলমিশে তোমার ভিত্রে এমন টাইট অবস্থা যে, করোনা ভাইরাস তোমার ধারে কাছেও আসতে পারবো না। কাজেই নো টেনশান।
বললাম, করোনা নিয়া আমার কোন টেনশান নাই। তুমি তো জানোই আমার অরিজিন বাংলাদেশ। আমরা, বাংলাদেশীরা করোনার থিকাও শক্তিশালী। খানিকটা টেনশান ব্যাথা নিয়া। তোমার ভাবে মনে হইতেছে তুমি এক্সপেক্ট করতাছো ব্যাথা আরো দুই দিন থাকবো?
বললো, থাকার সমূহ সম্ভাবনা। আম্রিকান মাল তো! খানিকটা সমস্যা না করলে কেমনে কি? তারপরে খানিকটা চিন্তিত গলায় বললো, বাংলাদেশীরা করোনার থিকাও শক্তিশালী? কও কি! কই কোন জার্নাল বা ডাব্লিউ এইচ ও'র রিপোর্টে তেমন কিছু তো দেখলাম না!!
আমি বললাম, এই তথ্য ওইসব জায়গায় পাইবা না। এইটা আমাদের একজন নামীদামী মন্ত্রী কইছে। খুবই সিক্রেট!! তোমারে আপন মনে কইরা কইলাম।
ডাক্তার ভড়কে গিয়ে বললো, মন্ত্রী? সে কি ডাক্তার বা বিজ্ঞানী জাতীয় কিছু?
আমি একটা বিলম্বিত হাসি দিয়ে বললাম, সে ডাক্তারও না, বিজ্ঞানীও না। এই দুই প্রজাতীর বাপ!! তবে, এইসব জাতীয় সিক্রেট। তোমারে ভাইঙ্গা বলা যাবে না। তারপরেও ডাক্তার খানিকটা ক্যা কো করতেই তাকে অথৈ জলে ফেলে দিয়ে 'বাই' বলে ফোনটা রেখে দিলাম। আমার এই ডাক্তার একটা চরম ইনকুইজিটিভ চরিত্র। খালি প্রশ্ন করতেই থাকে। আমি নিশ্চিত, এই তথ্য ওর মাথায় ঘুরতে থাকবে। পরেরবার কথা হলে তার প্রথম প্রশ্নই হবে এটা নিয়ে!!!
ফোনটা কেটে দিয়ে ভাবলাম, ডাক্তার সাবে কথাটা মন্দ বলে নাই। আম্রিকা সারা দুনিয়া যেখানে জ্বালায়ে ছারখার করে দিচ্ছে, সেখানে আমি কোন হরিপদ পাল!! ক্রিসকে ফোন দিলাম। বেঈমানটা ফোন ধরেই বলে, তুমি যদি অফিসে যাইবা না, এইটা বলার জন্য ফোন কইরা থাকো, তাইলে আমি স্যরি। বসরে আমি কিছু কইতে পারুম না।
বললাম, শুন ব্যাটা। এইটাই কিন্তু আখেরী শীতকাল না। সামনের বছরও আইবো। ইন ফ্যাক্ট প্রতিবছরই আইতে থাকবো। কাজেই ভালো কইরা বসরে বুঝায়া কইবি। আরও কইবি, এক ব্যাগ কমলা আর এক থোক আঙ্গুর নিয়া মফিজরে দেখতে গেছিলাম। অর অবস্থা তো দেখলাম পুরাই কাহিল। শুইয়া আছে, উইঠা বইতেও পারে না ঠিক মতোন। চি চি করতাছে!!!
আপনাদের কাছে দোয়ার দরখাস্ত রইলো। ব্যাথাটা যেন আর কয়টা দিন থাকে। বুঝেনই তো, শরীর সম্পূর্ন ঠিক হয়ে যাওয়ার পরেও অফিসে না গেলে বিবেক খোচাখুচি করে। আসলে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ওয়ার্ল্ড কাপের খেলাগুলো দেখার মজাই আলাদা!!!
ছবিসূত্র।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২২ বিকাল ৪:৩৫