প্রথম পর্বের লিঙ্ক
বৃহসপতিবার ঠিক সকাল ৭টার সময়ে নাস্তার জন্য নীচে নেমে এলাম। প্রধান উদ্দেশ্য, সময়ের অপচয় রোধ করা আর দ্বিতীয় উদ্দেশ্য একটু নিরিবিলি, শান্তিতে নাস্তা-পর্ব সম্পাদন করা। আগেরদিন রাতেই শুনে নিয়েছিলাম এদের নাস্তার টাইমিং…...৭টা থেকে ৯:৩০ পর্যন্ত। খানিকটা লজ্জা লজ্জাও লাগছিল, একেবারে শুরুতেই চলে আসা সংক্রান্ত নিজের এই হাভাতে ছ্যাচড়ামীতে। কিন্তু নীচে এসে আমার লজ্জারাঙ্গা মুখাবয়ব আবার স্বাভাবিক রং ধারন করলো যখন দেখলাম, আমার চেয়েও বড় ছ্যাচড়া দু'জন বসে আছে নাস্তার অপেক্ষায়! হোটেলের কর্মীদের তখন ব্যস্ত পদচারণা নাস্তার ডিশগুলো নির্দিষ্ট জায়গায় রাখতে।
প্রথমবারের হাল্কা ওয়ার্মআপ রাউন্ডের পর যখন স্ক্র্যাম্বলড এগের ডিশটার উপর দ্বিতীয়বারের মতো ঝাপিয়ে পড়ার পায়তারা করছি, পাশে এক মহিলা এসে দাড়ালো। হাত নেড়ে নেড়ে স্প্যানিশ ভাষায় কিছু তুবড়ি ছোটালো যার মধ্যে 'নো সাব্জিয়াস' কথাটাই আমার এন্টেনা ক্যাচ করলো। আমার মনে হলো, মহিলা সব্জির কোন ডিশ খুজছে, কিন্তু স্প্যানিশ ভাষার সব্জি আর বাংলার সব্জি এক কিনা, সেই ব্যাপারে কিঞ্চিৎ অনিশ্চিত থাকায় বিস্বাদ মুখে বললাম, আমি তো ভইন স্প্যানিশ জানি না! নো স্প্যানিশ, ওনলি ইংলিশ। পেছন থেকে কেউ একজন বিশুদ্ধ ইংরেজিতে বললো, ও তোমাকে স্প্যানিশ মনে করেছে!! তাকিয়ে দেখি, এক ফ্রেঞ্চকাট দাড়িওয়ালা হাস্যোজ্জল ভদ্রলোক। ভাবলাম, বিষয়টা কি? জার্মানীতে এসে স্প্যানিশ দ্বারা ঘেরাও হয়ে গেলাম!!! ভদ্রলোক হাসতে হাসতে বললো, ও বলেছে ''লো স্যাবিয়াস…...অর্থাৎ তুমি কি জানো…….?'' আমার ''সব্জি'' মনে করার বিষয়টা নিয়ে একচোট হাসাহাসি হলো।
ভদ্রলোক মাদ্রিদের সেইন্ট লুইস বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক। স্ত্রীসহ বেড়াতে এসেছেন এক সপ্তাহের জন্য। সেদিন ছিল ওনাদের মিউনিখে চতুর্থ দিন। এর মধ্যে উনারা একজন স্প্যানিশও দেখেন নাই। আমাকে দেখে ভদ্রমহিলার মনে হয়েছিল, আমি নিশ্চিতভাবেই স্বদেশী কেউ হবো! যদিও অধ্যাপক সাহেব সেটা তৎক্ষনাৎ খারিজ করে দিয়েছিলেন। এটা নিয়ে দু‘জনের মধ্যে হাল্কা বেটাবেটিও হয়ে গিয়েছিল আমার অজান্তেই!!!
আমি আর অধ্যাপক সাহেব কফির পেয়ালা হাতে নিয়ে বাইরে গার্ডেনে এসে বসলাম। নেশাখোরদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক যে সব সময়েই অত্যন্ত দ্রুততায় সৌহার্দ্যপূর্ণ হয়, তা আরেকবার প্রমানীত হলো। এক কথা, দুই কথায় সম্পর্কটা জমতে সময় নিল না। কথায় কথায় জানলাম, আমার আজকের পরিকল্পনা তাদের পরশু‘র, তবে একসাথে ঘোরার নিয়্যতে একদিন এগিয়ে নিয়ে এসে একসাথেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন উনি, আমিও ফাও সঙ্গী পেয়ে গেলাম!!!
রুমে এসে তৈরী হতে হতে বহু বছর আগে ফিরে গেলাম। আমি তখন ক্লাশ ফোর বা ফাইভে পড়ি, আব্বা আমাকে একটা মুভি দেখাতে নিয়ে যান মধুমিতা হলে। মুভিটার নাম ছিল ''ব্যাটল ফর বার্লিন''। আব্বার খানিকটা ব্রিফিংয়ে কিছুটা বুঝলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিশালতা আর বর্বরতা বোঝার মতো পরিপক্কতা তখনও হয়নি আমার। কিন্তু ''বন্দুক-পিস্তল-মেশিনগান নিয়ে যুদ্ধ'' জিনিসটা আমার বরাবরই পছন্দ, মানে দেখতে ভালো লাগে আর কি! সেই শুরু। এরপরে কতো যে বিশ্বযুদ্ধের মুভি দেখেছি, কতো এ‘নিয়ে গল্প-উপন্যাস আর আর্টিকেল পড়েছি, তার কোন ইয়ত্তা নাই। আস্তে আস্তে বিশ্বযুদ্ধের কদর্যতা বুঝতে শুরু করলেও এ'নিয়ে আমার মোহ কাটে নাই এখনও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূতিকাগার জার্মানীতে আসবো, আর এই সংক্রান্ত কোন কিছু না দেখেই ফিরে যাবো, এটা আমার জন্য একটা অসম্ভব ব্যাপার!!
কাজে কাজেই, আমার আজকের গন্তব্য দাহাউ (জার্মান ওরিজিনাল উচ্চারণটা হ আর খ এর মাঝামাঝি যেটা লিখে প্রকাশ করা সম্ভব না, তাই দাহাউ-ই বলছি) নামে একটা শহরে যেখানে হিটলারের প্রথম কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্প স্থাপিত হয়েছিল।
এই ক্যাম্প দেখাটা আমার জন্য বিভিন্ন কারনে একটা আবেগের ব্যাপার। তাই নিজস্ব চর্মচোক্ষে এটা দেখতে দেখতে প্রায়শঃই আবেগ তাড়িত হয়েছি। শিউরে উঠেছি। বর্ণনায়-সিনেমায় দেখা আর নিজ চোখে বাস্তবে দেখে উপলব্ধি করার মধ্যে যে একটা বিশাল ফারাক আছে, সেটা জেনে বাকরুদ্ধ হয়েছি; সেসব যথাসম্ভব তুলে ধরার চেষ্টা থাকবে, যদিও জানি, সেটা পুরাদস্তুর সম্ভব না। তা সত্বেও তোলা ছবিগুলো দেখানোর চাইতে বকবকানী বেশী থাকবে। যাদের বকবকানী পছন্দ না, তারা সেগুলোকে স্কিপ করে শুধু ছবিগুলো দেখতে পারেন।
যাকগে এসব কথা। চলেন, যাওয়া যাক।
মিউনিখের হপবানহফ ট্রেন স্টেশন থেকে ট্রেনে করে গেলাম দাহাউ। সেখান থেকে বাসে করে দাহাউ কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্প। কর্তৃপক্ষ এই ক্যাম্প দেখার জন্য শাটল বাসের ব্যবস্থা করে রেখেছে পর্যটকদের জন্য, যেটা শুধুমাত্র ট্রেন স্টেশন আর ক্যাম্পের মধ্যে যাতায়াত করে।
এই ক্যাম্পের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে অগুনতি কান্নাভেজা গল্প; ভয়ংকর সব নির্যাতনের রোমহর্ষক ঘটনা যা কল্পনা করতে গেলেও শরীর শিউরে ওঠে। হিটলারের ''ফুয়েরার'' হয়ে ওঠার কয়েকদিন পরেই ১৯৩৩ সালে এই ক্যাম্প খোলা হয় রাজনৈতিক বন্দীদের জন্য, যাদেরকে হিটলার ''দেশের শত্রু'' হিসাবে দেখতো। তবে শীঘ্রই এটা পরিনত হয় জিপসী, সমকামী এবং সর্বোপরি ইহুদীদের নিধনকেন্দ্র হিসাবে। এই ক্যাম্পে ৩২টা ব্যারাক আর ৭টা গার্ড টাওয়ার ছিল। প্রধান ফটকে লোহার ফ্রেমে লেখা ছিল টিটকারী মেশানো কয়েকটা নিষ্ঠুর শব্দ ''Arbeit Macht Frei'' (Work sets you free বা কর্মেই মুক্তি)।
ক্যাম্পের মূল প্রবেশদ্বারের লংশট আর মাঝারীশটের দু‘টা ছবি। তৃতীয় ছবিটার মতো একটা ছবি তোলার জন্য বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে রণে ভঙ্গ দিয়েছিলাম। প্রতিনিয়তই কেউ না কেউ আসছে যাচ্ছে। তাছাড়া কাঙ্খিত ছবিটা তুলতে হলে গেট বন্ধ করতে হবে, সেটাও সম্ভব হয় নাই। তাই শেষ ভরসা গুগল মামার শরনাপন্ন হতে হলো।
ছবিসূত্র।
এখানে একটা বিষয় জানিয়ে রাখি, তৃতীয় ছবির Arbeit Macht Frei লেখা ছোট গেটটা কিন্তু ওরিজিনাল না, কপি। মূল গেট টা একবার চুরি হয়ে গিয়েছিল। পরে সেটাকে উদ্ধার করার পর কর্তৃপক্ষ আর লাগানোর সাহস পায় নাই। সোজা ক্যাম্পের মিউজিয়ামে ঢুকিয়ে দিয়েছে। এই সেই আসল গেটের ছবি।
গেট দিয়ে ঢুকলে ডানদিকে মিউজিয়াম আর প্রশাসনিক ভবন। বায়ে তাকালে দেখা যায় পরীখা, বিদ্যুৎহীন বৈদ্যুতিক বেড়া আর গার্ড টাওয়ার। সে সময়ে গার্ড টাওয়ারের বুভুক্ষু মেশিনগান আর বিবিধ নিরাপত্তা ব্যুহ ভেদ করে কয়েদিদের পলায়ন ছিল একটা অসম্ভব ব্যাপার। তাছাড়া, নিরাপত্তা বেস্টনীর আশেপাশে কেউ গেলেও 'শ্যুট টু কিল' এর নির্দেশনা ছিল। তারপরেও পাশবিক নির্যাতন যারা আর সইতে পারতো না, মানসিকভাবে একেবারেই ভেঙ্গে পড়তো, তারা দিনে-দুপুরে হঠাৎ করেই বৈদ্যুতিক বেড়ার দিকে দৌড় দিত। আসলে কয়েদিদের মধ্যে এটা ছিল আত্মহত্যার জনপ্রিয় আর সহজতম উপায়!!!
মিউজিয়ামে রক্ষিত তখনকার নিরাপত্তা বলয়ের বর্ণনাসহ একটা ছবি।
ক্যাম্পে কয়েদিদের ৩২টা ব্যারাক এখন আর নাই। নীচের ছবিতে দেখেন, ব্যারাক তুলে দিয়ে সারিবদ্ধ ব্যারাকের জায়গা রেখে দেয়া হয়েছে। শুধু দুরে যে দু'টা ব্যারাক দেখা যাচ্ছে, সেই দু'টা স্যাম্পল হিসাবে রাখা হয়েছে। ফলে আজকের দর্শনার্থীরা জানতে পারে, সে'সময়ের কয়েদিদের জীবন-যাপনের মান কেমন ছিল।
এক পর্বে এই ক্যাম্প ঘুরে দেখানোর বৃত্তান্তে সমাপ্তি টানার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু এটা আসলে এতো বিরাট আর এতোকিছু দেখার আছে যে সেটা আসলে সম্ভব না। দুই পর্বেও পারবো কিনা জানি না। কারন আপনাদেরকে ডিটেইলসে দেখানোর চেষ্টা করছি।
দোয়া রাইখেন, যেন বাকী পর্বগুলোও তাড়াতাড়ি দিতে পারি।

বি.দ্রঃ এই পোষ্ট দিতে গিয়ে মেজাজ চরম খারাপ। ৯টা ছবি আপলোড দিলাম, আর দেয়া যাচ্ছে না। আগে তো কায়দা-কানুন করে ৩৫টা পর্যন্ত ছবি আপলোড দিয়েছি এক পোষ্টে। এখন কি হলো.........কেউ কি জানেন? আরো ছবি দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পারলাম না। এই দুঃখ রাখি কোথায়? হালার কপাল!!!!

শিরোনামের ছবির গেটটা বর্তমানে আর নাই। ১৯৪৫ সালে আমেরিকান সৈন্যরা ক্যাম্প দখল করার পরে মূল ফটকে তাদের অবস্থান গ্রহন। ছবিসূত্র।
ছবিসূত্রঃ আমার মোবাইল।
তথ্যসূত্রঃ বিভিন্ন ট্যুরিষ্ট গাইড আর লোকেশানের ইনফরমেশান বোর্ড।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ বিকাল ৩:৩৩