ছোটবেলায় আমি নাকি বান্দর জাতীয় প্রাণী ছিলাম।
বলেন দেখি, কি আচানক কথা! যারা এমনটা বলতেন তাদের সাথে আমি কোনদিনই সহমত পোষণ করি নাই, তবে প্রতিবাদও করি নাই। কারন, যারা বলতেন তারা সবাই আমার দৃষ্টিতে নমস্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন। নিজেকে আমি অত্যন্ত ভদ্রগোছের নিরীহ প্রাণী হিসাবেই জানতাম, এখনও তাই জানি। তবে আমার বড়খালা একেবারেই নিশ্চিত ছিলেন এই বিষয়ে, মানে বান্দরের ব্যাপারে আর কি! আমার ব্যাপারে উনার মতামত ছিল, আমি ভুলক্রমে মনুষ্য সমাজে চলে এসেছি। আর সবসময় প্যান্ট পড়ে থাকায় আমার লেজ দৃষ্টিগোচর হয় না, তবে ওই অঙ্গটা আমার অতি অবশ্যই আছে।
যাক গে, ভূমিকা দিলাম। এবার আমার কৈশোরের একটা ঘটনা সবিস্তার বর্ণনা করি। আপনারাই না হয় সিদ্ধান্ত নেন!!
ক্লাশ সেভেনের ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে সাময়িক অবসরে আছি। তখন আমরা লালবাগ রোডের একটা বাসায় বিশেষ কারনে বেশ কিছুদিনের জন্য ভাড়া ছিলাম। সেই দেড়তলা বাড়িতে আমরাসহ আরো দু'টা পরিবার থাকতো। আগে থেকেই আমরা ওই এলাকার বাসিন্দা হওয়াতে পরিবার দু‘টা আমাদের পূর্ব পরিচিত। আমরা ছিলাম নীচতলায়। আমাদের পাশে আরেকটা পরিবার। সেই পরিবারের একমাত্র ছেলে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধূ এবং আমার তৎকালীন সকল কর্মকান্ডের সাথী। সে এখন মোটামুটি বিখ্যাত ব্যক্তি, কাজেই তার নাম না বলি। ধরে নেই রুবেল তার নাম। দোতলায় এক অংশে থাকতেন ফরিদ চাচা (এটাও ছদ্মনাম) আর চাচী। উনারা নিঃসন্তান ছিলেন। বাকী অংশটা ছিল প্রায়-খোলা ছাদ। প্রায়-খোলার কারন ছিলো, দু/তিন ইট পরিমান দেয়াল হওয়া আর পিলারের রডগুলো বের হওয়া। বাড়িওয়ালা চাচা কাজ শুরু করে হঠাৎ বন্ধ করে দেয়াতে এই অবস্থা।
ফরিদ চাচা এই ঘটনার প্রধান চরিত্র, কাজেই উনার কিঞ্চিৎ বর্ণনা দেয়া অতীব জরুরী। এই চাচার ছেলেসন্তানদের প্রতি ছিল দুর্নিবার আগ্রহ। এলাকার তাবৎ ছেলে বিশেষ করে আমার আর রুবেলের প্রতি উনার খবরদারী ছিল মাত্রাতিরিক্ত, অনেকটা সেরের উপর সোয়া সেরের মতো। সেই সময়ে মাগরিবের পর পরই ইলেক্ট্রিসিটি চলে যেতো; আসতো ন'টা নাগাদ। এটা মোটামুটি নিয়মিত ঘটনাই ছিল। তো, পরীক্ষা শেষ; আমরা হয়তো সন্ধায় ছাদে বসে গল্প করছি, উনি এসে বলতেন…..পরীক্ষা শেষ তো কি হয়েছে? এইটের বৃত্তি পরীক্ষার জন্য এখন থেকেই তোদের তৈয়ারী শুরু করা উচিত। কারেন্ট নাই তো কি, হ্যারিকেন আছে না? আমরা তো সারাজীবন হ্যারিকেনের আলোতেই পড়ালেখা করেছি……ইত্যাদি ইতং বিতং মাথা ধরানো কথাবার্তা!!
উনি আমাদেরকে এসব বলে থামলে ভালো ছিল। তা না; থামাথামি উনার ডিকশনারীতে ছিল না। এসব কথা আমাদের সুযোগ্য পিতামাতাকেও উনি নিয়মিত বলতেন, ফলে লোডশেডিংয়ের মধ্যেও আমরা মাঝে-মধ্যেই পড়তে বসতাম; বরং বলা ভালো, ঘাড় ধরে আমাদেরকে বসতে বাধ্য করা হতো। উনার সৃষ্ট এমন বহুবিধ জ্বালা-যন্ত্রণার কারনে আমাদের সুখের জীবন প্রায়শঃই বিষাক্ত হয়ে উঠতো।
তো, একদিন নির্ভরযোগ্য সূত্রে খবর পেলাম যে অভিসার হলে একটা নতুন ''এক টিকেটে দুই ছবি'' এসেছে; ইংরেজি বলাই বাহুল্য! এই ইংরেজি ''এক টিকেটে দুই ছবি''র বিষয়টা যারা জানেন, তাদেরকে নতুন করে বলার দুঃসাহস না দেখাই; আর যারা জানেন না, তাদের জেনে কাজ নাই। সেই সময়ে অভিসার, শাবিস্তানসহ আরো কয়েকটা হলে মাঝেমধ্যেই এমনতরো সুপার-ডুপার হিট সিনেমা দেখানো হতো। যা বলছিলাম, সেই নির্ভরযোগ্য সূত্রের রস উপচে পড়া বর্ণনা শুনে আমাদের দু'জনের চোখই মাঝারী সাইজের রসগোল্লার মতো বড় হয়ে গেল। রুবেলের ঢোক গেলার ধরন দেখে বুঝতে বাকী রইলো না যে, রসে টইটুম্বুর একের পর এক রসগোল্লা সে পেটে চালান দিয়ে চলছে। জায়গায় দাড়িয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম, এইটা দেখতেই হবে। না দেখলে এই যৈবন….থুড়ি…... জেবন থাকা না থাকা সমান!!! ''বাঙ্গালীর এক কথা'' প্রবচনকে সত্যে পরিণত করতে পরদিনই গিয়ে হাজির হলাম দুর্ঘটনাস্থলে। দুর্ঘটনাস্থল এই জন্য যে, সিনেমা দেখে হল থেকে বের হয়েই আমরা দু'জন বেমক্কাভাবে কট হলাম ফরিদচাচার হাতে। উনার অফিস কাছাকাছিই ছিল, কিন্তু কোন অবস্থাতেই তখন তার বাইরে থাকার কথা না। হয় উনিও ফজা মিয়া হয়ে ''এক টিকেটে দুই ছবি''র মজা লুটতে এসেছিলেন, অথবা আমাদেরকে ধরার জন্যই ওৎ পেতে ছিলেন……….আসল ঘটনা কি ছিল আল্লাহ মালুম! অবশ্য পরিবেশ তখন সে‘সব ভাবার অনুকূলে ছিল না। আসন্ন কালবৈশাখীর তান্ডবের কথা ভেবে ততক্ষণে আমাদের রসগোল্লার মতো চোখগুলো স্বাভাবিকের চেয়েও ছোট হয়ে গিয়েছে!!!
চারদিন পরের কথা।
চোরকে ধরতে পারলে যেভাবে মুগুর দিয়ে হাত-পায়ের গিট ছ্যাচা হয়, অনেকটা সেভাবেই আমাদেরকে ছ্যাচা হয়েছিল সেই দূর্যোগময় রাতে। রুবেলের বাবা পেটাইয়ের সময়ে কি বলেছিলেন জানি না, আমার আব্বা বলেছিলেন, এই বান্দরটার পড়ালেখার জন্য টাকা-পয়সা অপচয় করার দরকার নাই। সিনেমা হলের টিকেট ব্ল্যাক করেই নিজের সংসার চালাতে পারবে। কি ভয়ানক কথা!! পরবর্তীতে ১৪৪ ধারার কারনে আর পড়ার টেবিল ছেড়ে ওঠার ফুরসৎ হয় নাই। পরিস্থিতি মোটামুটি শান্ত হওয়াতে আমরা আবার হাফ-ছাদে মিলিত হলাম সন্ধায়। গিটে গিটে ব্যাথার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তখনও তরতাজা। আর আমাদের চোখে তখন প্রতিশোধের আগুন। এই অবস্থা আর চলতে দেয়া যায় না; একটা বিহিত করতেই হবে। এই কয়টা দিন টেবিলে বসে পড়ার ফাকে ফাকে শুধু এই নিয়েই ভেবেছি। আরেকটা কাজও করেছি। তা হলো, পাঠ্যবইয়ের নীচে রেখে একটা ভুতের গল্পের বই শেষ করেছি।
সেই গল্পের নায়ক একদিন গভীর রাতে বসার ঘরের আধো-অন্ধকারে বসে বই পড়ছিল, হঠাৎ জানালায় চোখ পড়তে দ্যাখে বাইরে আপাদমস্তক সাদা পোষাকে কেউ একজন দাড়িয়ে আছে, যার কোন চোখ-মুখ নাই। প্রচন্ড ভয় পেয়ে সে উঠে দাড়িয়ে বাড়ির ভিতরের দিকে দৌড় দেয়ার জন্য ঘুরতেই দ্যাখে সেই চোখ-মুখহীন ভুতটা ঘরের ভিতরে, তার সামনেই দাড়িয়ে…….এই হলো সংক্ষেপে গল্প। গল্পটা মাথায় এমনভাবে গেথে ছিল যে, এটাকে কিভাবে বাস্তবে রুপ দেয়া যায়, এই কয়টা দিন শয়নে-স্বপনে আমি শুধু সেই চিন্তাই করেছি। রুবেলের অকুন্ঠ সমর্থনে সেটা আরো ফুলে ফেপে উঠলো।
আমি কুট্টিকাল থেকেই পারফেকশনিস্ট কিসিমের মানুষ। কোন প্ল্যান যখন করি, খুটিনাটি সবকিছু মাথায় রাখি। আমার বউকে একদিন কথায় কথায় বলেছিলাম, আমি যদি কোনদিন কাউকে খুন করি, এতো নিখুত প্ল্যানিংয়ে করবো যে, কোন পুলিশের বাপেরও ক্ষমতা নাই যে, আমাকে ধরবে। আমার বউ চোখ নাচিয়ে বলেছিল, হঠাৎ খুনের চিন্তা যে? কাকে করবা? তবে সিরিয়াল কিলার না হওয়াই ভালো। তাইলে একদিন না একদিন অবশ্যই ধরা খাবা। অন্য কথায় চলে গেলাম, আসল কথায় আসি।
ক'দিন আগে পড়া গল্পটা মঞ্চস্থ করার সিদ্ধান্ত নিলাম।
আপনাদের জানিয়ে রাখি, সন্ধায় ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেলেই চাচা সেই অর্ধ-ছাদে হাটাহাটি করতেন। আর উনি কিছুটা ভীতু প্রকৃতির ছিলেন। জ্বীনে তো বিশ্বাস করতেনই, ভুত-প্রেতেও করতেন। উনার কাছ থেকে আমরা বিভিন্ন কিসিমের ভুতের বিভিন্ন কেচ্ছা-কাহিনী বহুতই শুনেছি।
প্ল্যানটা ছিল এই রকমের। রুবেল নিজেকে সাদা কাপড়ে মুড়ে ছাদের উত্তর দিকের কোণায় আগে থেকেই দাড়িয়ে থাকবে। কোনায় দাড়ানোর কারন তিনটা। ওইদিকে একটা বড় আমগাছ ছিল। ডালপালার কিয়দংশ আমাদের ছাদে আসাতে ভুতের জন্য আদর্শ জায়গা। কোনাটা পাশের বাসার পেছন দিক, আর বেকায়দা দেখলে ওখান দিয়ে সহজেই চওড়া কার্নিশে নেমে ভেগে যাওয়া যায়। অবশ্য বেকায়দায় না পড়লেও ও ওইখান দিয়েই ভাগবে। চাচা ওকে দেখে ভয় পেয়ে বাসায় ঢুকতে যাবে, সেইসময়ে আমি দাড়ানো থাকবো সিড়ির ল্যান্ডিংয়ে, একই রকমের সাদা কাপড়ে নিজেকে মুড়ে। চাচা বের হওয়ার আগেই দু'জন অবস্থান নিবো, তবে আমাকে বের হওয়ার সময় উনি দেখবেন না। লুকিয়ে থাকবো। সহজ হিসাব। আমাদের বাসার পাশেই একটা দোকানে ক্যারাম খেলা হতো (পুরানো ঢাকা সম্পর্কে যাদের ধারনা আছে, তারা জানবেন)। সেখানে সন্ধ্যার পর গরম গরম পুরিও ভাজা হতো। কাজ শেষ করে দু'জনে সেখানে মিলিত হবো, তারপরে পুরি হাতে খেলা দেখার ভান করবো। কারন, এই ঘটনার পরে অবধারিতভাবেই আমাদের খোজা হবে, তখন একটা যুক্তিসঙ্গত শক্ত এ্যলিবাইয়ের দরকার হবে।
কাপড় কোথাও ফেলে আসা যাবে না। শীতকাল হওয়াতে জ্যাকেটে ঢুকিয়ে ফেলতে সুবিধা হবে। আর সপ্তাহ তিনেক পড়ে অপারেশানটা করার সিদ্ধান্ত নিলাম, কারন তখুনি করলে আমাদের উপর সন্দেহ জোড়ালো হবে। আরো বেশকিছু খুটিনাটি ব্যাপারও মাথায় রাখলাম, বিস্তারিত বলতে গেলে পোষ্ট বড় হয়ে যাবে, তাই সেদিকে যাচ্ছি না।
দেখতে দেখতে দিনক্ষণ ঘনিয়ে এলো। ধারে কাছেই পরিচিত ডেকোরেটর ছিল, কিন্তু আমরা লালবাগ কেল্লার কাছের এক ডেকরেটর থেকে দু'টা মাঝারী আকৃতির সাদা টেবিল ক্লথ নিয়ে এলাম। আর্ট পেপার কেটে একই রকমের দু'টা মুখোশ বানালাম, যাতে নাক-মুখ নাই, শুধু চোখের জন্য ফুটো করা।
এরপরের কাহিনী খুবই সংক্ষিপ্ত।
ঘটনার দিন যথারীতি মাগরিবের পর পরই সব বাত্তি নিভে গেলো। আমরা যার যার জায়গায় অধীর অপেক্ষায়। কাঙ্খিত টার্গেট দরজা খুলে বেড়িয়ে এলেন, হাতে একটা চার্জার ল্যাম্প। সেটাকে দরজার কাছে রেখে ছাদে গেলেন, প্রায় সাথে সাথেই ফিরেও এলেন। আমি ততক্ষণে জায়গামতো উদয় হয়েছি। আমাকে শুধু দেখতে দেরী, বিকট স্বরে আ আ শব্দ করে ল্যাম্প ট্যাম্প নিয়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেলেন। সেই শব্দে ভড়কে গিয়ে আমি ভুতের দায়িত্ব কর্তব্য ভুলে ঝেড়ে নীচের দিকে দৌড় দিয়ে পগার পার!!
আমাদের দুজনকে খুজতে কেউ অবশ্য আসে নাই সেদিন। সবাই চাচাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। আমরা ক্যারাম খেলে যতোটা ময়দা আর বরিক পাউডারের মিশ্রণ হাতে-শরীরে লাগে, তার চাইতে বেশী লাগিয়ে ঘন্টা দুয়েক পড়ে বাসায় ফিরলাম।
পরে চাচা আব্বাকে বলেছিলেন, ''ভুতটা প্রথমে ছাদে একহাত উপরে ভাসছিল। আর যেই না আমি তাড়াতাড়ি ভিতরে আসলাম, দেখি সেটা আমার আগেই সিড়িতে এসে দাড়িয়েছে, আর আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।'' বলাই বাহুল্য এমন কিছুই ঘটে নাই। পুরাটাই চাচার আলো-আধারীতে ভুত দর্শন সম্পর্কিত মনের মাধুরী মেশানো কল্পনা! আব্বা উনাকে যতোই বোঝাতে চেষ্টা করেছিল যে, ভুত টুত কিছু না। কেউ তোমাকে ভয় দেখানোর জন্য এসব করেছে। কে শোনে কার কথা!! উনি শতভাগ নিশ্চিত যে, ওটা একটা ভুতই ছিল।
আমাদের উপরে সবার সন্দেহ তো ছিলই। পরে বহুভাবে, বিভিন্নভাবে সবাই চেষ্টার কমতি রাখে নাই আমাদের পেটের ভিতর থেকে কথা বের করার জন্য। তাতে কোন লাভ অবশ্য হয় নাই। ওই ঘটনার পরে চাচা আর কোনদিন সন্ধ্যার পরে ছাদে যান নাই। আজ প্রায় তিরিশ বছরের উপরে হয়ে গিয়েছে, চাচাদের সাথে কোন যোগাযোগ নাই। উনি আছেন কি নাই, তাও জানি না। যদি, বাই এনি চান্স, এই লেখা চাচা বা চাচীর নজরে আসে, করজোড়ে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। অপরিনত বয়সের দু'টা ছেলের কর্মকান্ডকে উনারা যেন পিতা-মাতাসূলভ মনোভাব নিয়ে মাফ করে দেন।
সেই সময়ে এই ঘটনা নিয়ে আমরা দু'জনে মিলে খুব হাসাহাসি করতাম। এখন মনে পড়লেই খানিকটা অপরাধবোধে ভুগি।
ছবিসূত্র।