মাদ্রাসা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ব্লগে বিভিন্ন লেখা এসেছে অতীতে, ভবিষ্যতেও আসবে; আসতেই থাকবে। কারন এটা এমন একটা বিষয় যেটা কয়েকদিন পর পরই আলোচনার দ্বার খুলে দেয় আর উৎসাহীরা পক্ষে বিপক্ষে ঝাপিয়ে পড়ে। কিন্তু কেউই সম্ভবতঃ আসল বিষয়গুলোর ধারে কাছে যায় না, কেবলই আশ-পাশ দিয়ে ঘোরাফেরা করে। এটা কি জ্ঞান-বুদ্ধির সীমাবদ্ধতা নাকি দৈন্যতা? স্পর্শকাতর বিষয় বলে হাল্কার উপরে ঝাপসা কিছু কথা বলে মূল বিষয়টা এড়িয়ে যাওয়া; নাকি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় যে শ্রেণী বৈষম্য জাকিয়ে বসে আছে সেটাকে জাগিয়ে রাখার সীমাহীন অপচেষ্টা........….কোনটা? তো, বিভিন্ন সময়ে অনেকের ঝাপানো দেখে ভাবলাম আমিও একটা ঝাপ দেই। এই ঝাপের ফলে দেহের কলকব্জায় কোন চিড় ধরে কিনা সেই ভাবনা না হয় আপাততঃ শিকেয় তোলা থাক!
মোটা দাগে বাংলাদেশে তিন ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত। বাংলা মিডিয়াম, ইংলিশ মিডিয়াম আর মাদ্রাসা। যতোদূর জানি, তিনটাতে ভিন্ন ভিন্ন তিন ধরনের কারিকুলাম অনুসরণ করা হয়। যে কোনও শিক্ষা ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্যই হলো, শিক্ষার্থীকে ভবিষ্যতের পেশাগত জীবনের জন্য তৈরী করা; এবং অতি অবশ্যই তাকে বর্তমান বিশ্বে বিচরণের উপযোগী করে গড়ে তোলা। সেক্ষেত্রে বাংলা বা ইংলিশ মিডিয়াম মূল স্রোতে সহজভাবে মিশতে পারলেও মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিতরা পিছিয়ে পড়ছে। এদেরকে সমাজের মূলধারা থেকে আলাদা করে দেয়া হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে। এই যে বৈষম্য সমাজে তৈরী করা হয়, সেটা কি আদতে কোন সুফল বয়ে আনে? একটা বিশাল সংখ্যার তরুণ জনশক্তির কি নিদারুণ অপচয়!! যে কোনও চাকুরী বা পেশাগত জীবনে মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিতরা প্রতিযোগিতায় অন্য দুই স্রোতের তুলনায় পিছিয়ে থাকে। একইভাবে বলা যায়, বাংলা মিডিয়ামে শিক্ষিতরাও ইংরেজি মিডিয়ামের শিক্ষিতদের তুলনায় কিছুটা হলেও পিছিয়ে থাকে। এই সমস্যার উপরে বিস্তারিত আলোকপাতের আগে চলুন মাদ্রাসা শিক্ষার কিছু ফ্যাক্টসের উপর একটু চোখ বুলাই।
দেশে বিভিন্ন ধরনের মাদ্রাসা রয়েছে। যেমন, আলীয়া (সরকার অনুমোদিত), কওমী (স্বায়ত্বশাসিত)। এ'ছাড়াও নূরানী, ফোরকানিয়া বা হাফিজিয়া এবং ক্যাডেট মাদ্রাসা রয়েছে যেগুলোর কোন সরকারী স্বীকৃতি কিংবা নিয়ন্ত্রণ নাই। এগুলোর বাইরে বর্তমান সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় আরেকটা নয়া ধারা দেশে প্রবর্তিত হয়েছে, দারুল আরকাম। দেশে প্রকৃতপক্ষে ঠিক কতোগুলো মাদ্রাসা আছে তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান নাই। তবে সব মিলিয়ে এই শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা হবে আনুমানিক ছয় থেকে আট মিলিয়নের মতো। বর্তমান বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে এই বিপুল সংখ্যক ছাত্র/ছাত্রীর বৃহদাংশের ভবিষ্যৎ যাত্রাপথ যে মোটামুটি অনিশ্চয়তায় ভরা, সেটা বলার কোন অবকাশ নাই। আরেকটা সমস্যা হলো, মাদ্রাসা শিক্ষার এই প্রতিটা ধারাই শুধুমাত্র নিজেদেরকেই ইসলামী শিক্ষা-দীক্ষা আর সংস্কৃতির একমাত্র ধারক ও বাহক মনে করে। এনারা বেশীরভাগ বিষয়েই একে অন্যের ধার ধারেন না। ফলে কোন সমস্যা সামনে আসলে সেটার সমাধান হওয়ার চাইতে আরো জটিল আকার ধারন করে। এসব থেকে বেরিয়ে আসার একটাই উপায় আছে। সেটা হলো, একটা সমন্বিত জাতীয় কারিকুলামের প্রবর্তন।
এখানে একটা প্রাসঙ্গিক বিষয় না বলে পারছি না। বর্তমানে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী সরকারের ২০১৮ সালের নির্বাচনী মেনিফেস্টোর প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অঙ্গ-সংগঠন ইসলামিক ফাউন্ডেশান বাংলাদেশের অধীনে ১,০১০টি নতুন মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়। এগুলোই দারুল আরকাম মাদ্রাসা নামে পরিচিত। এটা বর্তমানে পন্চম শ্রেণী পর্যন্ত থাকলেও এটাকে পর্যায়ক্রমে মাস্টার্স পর্যন্ত বিস্তৃত করার পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। তবে দেশে শিক্ষা ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের মতামত হলো, সরকার প্রবর্তিত মাদ্রাসা শিক্ষার এই নতুন তৃতীয় ধারাটা বর্তমানের জটিল এবং ঝামেলাপূর্ণ মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরো জটিলতর করে তুলবে। দেশের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা কতোটা জটিল এবং পশ্চাদপদ সেটা জানতে আগ্রহীরা চাইলে Faith and education in Bangladesh: A review of the contemporary landscape and challenges পড়ে দেখতে পারেন।
পাগলের জট-পাকানো চুলের মতো এই যে আমাদের জট পাকানো শিক্ষা ব্যবস্থা, এর পেছনের কারন খতিয়ে দেখারও প্রয়োজন আছে। ক্ষমতাসীনদের কেন এই জট খোলার ব্যাপারে কোন আগ্রহ থাকে না, বরং জট আরো বেশী করে পাকান? জাতি শিক্ষা-দীক্ষায় দূর্বল হলে একচ্ছত্র ক্ষমতালোভী ক্ষমতাসীনদের যে লাভ হয়, সেটা একটা প্রমাণীত সত্য। এটা বোঝার জন্য একজন রকেট সায়েন্টিস্ট হওয়ার প্রয়োজন নাই।
এবার একটা উন্নত দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে চোখ ফেরাই। পৃথিবীর সব উন্নত দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা পর্যালোচনা করা আমার পক্ষে সম্ভব না। তবে, ধারনা করি….…এগুলো মোটামুটি একই ধরনের। বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয় কারিকুলাম বা পাঠ্যক্রম হলো ইংলিশ কারিকুলাম। বিলাতে ১৯৮৮ সালে সংবিধিবদ্ধ জাতীয় কারিকুলাম চালু করা হয়। এর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো, সব শিক্ষার্থীর জন্য একই পাঠ্যক্রম অনুসরণ করা যাতে করে শিক্ষাকালীণ সময়ে কোন ধরনের বৈষম্য কিংবা অসামন্জস্যতা না থাকে। জাতীয় পাঠ্যক্রমটি শিক্ষার্থীদের মূল জ্ঞানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় যা তাদের শিক্ষিত নাগরিক হওয়ার জন্য অপরিহার্য। এর লক্ষ্য হলো, কঠোরভাবে শিক্ষার উচ্চমানকে বাস্তব রুপ দান করা। বাস্তব দুনিয়া আর স্কুলে যা শেখানো হয় তার মধ্যে একটা যোগাযোগ স্থাপন করা। সর্বোপরি, এটা নিশ্চিত করা যে, সমস্ত শিশুকে মূল বিষয়গুলির বিষয়ে প্রয়োজনীয় জ্ঞান হাতে-কলমে শেখানো হচ্ছে।
এখন সময় এসেছে (একটু ভুল বললাম, ''সময়'' বহু আগেই এসেছে; দরজায় দাড়িয়েও আছে তাকে সাদর অভ্যর্থনার অপেক্ষায়। করা হয় নাই। তারপরেও…...বেটার লেইট দ্যান নেভার!!), আমাদের দেশেও একটা সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার। একটা ''জাতীয় কারিকুলাম'' চালু করা বর্তমানে সময়ের দাবী, যেটা ইংলিশ মিডিয়াম, বাংলা মিডিয়াম কিংবা মাদ্রাসা, সবাই অনুসরন করবে, আর আস্তে-ধীরে সবাইকে একীভূত করবে। ইংলিশ মিডিয়ামের শিক্ষার্থীরা এই কারিকুলামের ইংলিশ ভার্সান পড়বে। সব শ্রেণীতেই একটা আলাদা বিষয় অন্তর্ভূক্ত করা দরকার (ফোর্থ সাবজেক্টের মতো)। এতে করে, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা ধর্মীয় জ্ঞানের উপরে একটা আলাদা কোর্স করতে পারবে। এখানে লাভ যেটা হবে, সেটা হলো ধর্ম বিষয়ক মুখস্থ বিদ্যার উপর ফোকাস না করে বিষয়বস্তুকে আত্মীকরণ করা। অন্যরাও তাদের পছন্দমতো একটা বিষয় বেছে নিবে। এটা কার্যকর থাকবে এইচএসসি পর্যন্ত। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইসলামিক স্টাডিজ বা ইসলামের ইতিহাসের মতো সাবজেক্ট এমনিতেই চালু আছে। প্রয়োজনে আরো নতুন নতুন বিষয় চালু করা যেতে পারে, যাতে করে যারা ধর্মীয় কোন নির্দিষ্ট ধরনের উচ্চশিক্ষা নিতে চায়, নিতে পারে। আর এ‘জন্যে প্রয়োজন শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়ানো আর একটা নির্দিষ্ট পরিকল্পনা যার মধ্যে শিক্ষক প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে অন্যান্য সুযোগ সুবিধার পর্যাপ্ততা থাকবে। মোট কথা, সরকারের সদিচ্ছা ছাড়া এটা কোনভাবেই সম্ভবপর হবে না। তবে, আমাদের বর্তমান সরকারের সদিচ্ছার একটা নমুনা আগেই উপস্থাপন করেছি, আরেকটা নীচে দেখেন। এই মানসিকতার পরিবর্তন খুবই প্রয়োজন।
Government expenditure on education, total (% of GDP) - South Asia
আমাদের দেশটাকে বা আরো নির্দিষ্ট করে বললে ঢাকাকে সময়ে সময়ে আমাদের কর্তাব্যক্তিরা সিঙ্গাপুর, লন্ডন, প্যারিস, লস এন্জেলেস ইত্যাদি নগরীর সাথে তুলনা করেন; সম্ভবতঃ এটা বর্তমানের তথাকথিত অবকাঠামোগত উন্নয়নের কারনে। যদিও এসব শহরের সাথে তুলনাটা হাস্যকর, তারপরেও তেনারা করেন। কেন করেন বা এটা করে কোন ধরনের আত্মতৃপ্তি পাওয়া যায়, আমার জানা নাই। তাহলে এসব শহর যে সব দেশে অবস্থিত, তাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে আমাদেরটার তুলনা করাটাও যুক্তিযুক্ত, নয় কি? কারন একটা জাতির আসল উন্নয়নই তো হয় শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে। আচ্ছা, বাদ দেন উন্নত বিশ্বের সাথে তুলনার এইসব হাবিজাবি কথা। আপনারা বরং উপরে দেয়া আমাদের আশেপাশের দেশগুলো শিক্ষাখাতে তাদের জিডিপি'র কতোভাগ ব্যয় করে, সেটার তুলনামূলক চিত্রটা আরেকবার দেখেন। অবশ্য এটা না দেখেও চোখ বন্ধ করেই বলে দেয়া যায় যে, বাংলাদেশের অবস্থান তলানীতেই হবে!!!
দেশের যে কোনও অনাচারের ঘটনা সামনে আসলেই সোশ্যাল মিডিয়া কিংবা ব্লগে রব উঠে এই বলে যে, এই অধঃপতিত জাতি বা সমাজ থেকে আমরা আর কি আশা করতে পারি…….ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু পিছনের কারনটা কেউ খতিয়ে দেখেন না। এটা নিয়ে ব্লগে বহুবার বলেছি, পোষ্টও দিয়েছি। তারপরেও কতিপয় মানব সন্তানের ঘুম ভাঙ্গে না। কেন? উনাদের কি জানা নাই, বান্দরের হাতে একে-৪৭ রাইফেল দেয়া আর অশিক্ষিত জনগোষ্ঠির হাতে স্মার্টফোন দেয়া একই কথা!! জাতি কাকে অনুসরণ করবে? জাতির মাথা বা বিবেককে, তাই না? তাহলে এটাও তো ভাবা দরকার যে এই মাথা বা বিবেকদের কাছ থেকে সাধারন জনগন কি শিখছে? মন্ত্রী, বিচারক, পুলিশ, সরকারী কর্মকর্তা…….এনারা যদি ট্রাফিক আইন অমান্য করে রাস্তার উল্টাদিকে গাড়ি ছোটান, তাহলে সাধারণ মোটর সাইকেল চালকরা তাদের বাইক ফুটপাথে তুলতেই পারে; সেটাই তো স্বাভাবিক!! প্রকৃত শিক্ষার অভাবেই সমাজে এ'ধরনের বিশৃংখলা ঘটে। এই অবস্থার পরিবর্তন না হলে শুধুমাত্র গেল গেল রব তুলে কোটিবার চিৎকার করলেও কোন লাভ হবে না। বরং উত্তোরণের সঠিক পথ নিয়ে যদি আলোচনা করি, তাহলে কিছু হলেও হতে পারে।
জাতিকে সঠিক পথে আনতে আইনের শাসন দরকার। যথাযথ আইনের যথাযথ প্রয়োগ দরকার। জাতির সামনে রোল মডেল দরকার যার বা যাদের কাছ থেকে আপামর জনসাধারণ অণুপ্রেরণা লাভ করবে, দেশপ্রেমের দীক্ষা পাবে। আর সর্বোপরি বৈষম্যমূক্ত একটা সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা দরকার যা কিনা জাতিকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবে। আমাদের জাতির কাছে এর কোনটা আছে? সচেতনতা কি আসমান থেকে পড়বে? কতিপয় আদম সন্তানের কি আজব মেন্টালিটি!!!
কোন রকমের দূরদর্শী নেতৃত্ব ছাড়া দুনিয়াতে কবে কোন জাতি নিজে নিজে ঠিক হয়েছে? উদাহরন আছে কোন? কারো কাছে থাকলে আওয়াজ দিবেন দয়া করে, তারপরে না হয় সাধারন জনমানুষের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করবেন।
সমালোচনার একটা বেসিস তো থাকতে হবে, নাকি!!!
শিরোনামের ছবিসূত্র।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুন, ২০২৩ সকাল ১১:২৪