সাধারনভাবে ''ভাষা'' বিষয়টা আমার কাছে সব সময়েই একটা রহস্যময় ব্যাপার। পৃথিবীব্যাপি লক্ষ-কোটি মানুষ কতো বিচিত্র ভাষায় কথা বলে। প্রায় শতভাগই বুঝি না। একেক রকমের ভাষা শুনলে একেক রকমের অনুভূতি হয়। কোনটাতে ঝগড়াটে, কোনটাতে প্রেমময় তো কোনটাতে আবার একেবারেই নিরস, রসকষহীন; একেবারেই এ্যভোকাডোর স্বাদের ভাইব আসে। তবে, আনকোরা নতুন ভাষা শেখার ব্যাপারে আমার ভীষণ অনিহা ছিল একটা সময়ে। এর চেয়ে কঠিন কাজ আমার কোনটাকেই মনে হয় না।
কিছুদিন আগে আমার কলীগ বন্ধু ক্রিস প্রস্তাব দিল, মফিজ চলো, আমরা জার্মান ভাষা শিখি। অবশ্য এই প্রস্তাবের পিছনে ওর নিজস্ব ধান্ধা আছে। আমাদের নতুন মিউনিখ অফিসের এক অস্ট্রিয়ান কলীগকে ওর মনে ধরেছে। সেইজন্যই এই আকুলতা! বললাম, তুই ধান্ধা করতে চাস, কর; এর মধ্যে আবার আমাকে টানাটানি করা কেন বাপু? তাছাড়া জার্মান ভাষার যেই কাটখোট্টা টোন, সেই টোনে তোর পক্ষে প্রেমালাপ জমানো কঠিন হবে। তোর প্রতি আমার উপদেশ হইলো, যেইখানে মেয়ে দেখস, সেইখানেই বড়শি ফেলা বন্ধ কর। ও আমতা আমতা করে বলে, তুমি সব সময়েই দড়িরে সাপ মনে করো। এই প্রস্তাবের মধ্যে প্রেম আসলো কোইত্থিকা? সারাহর লগে খাতির হওয়ার পর থিকাই তুমি কেমন জানি পর পর হয়া গেছো গা!!!
প্রেমের কথায় পুরানো কিছু কথা মনে পড়লো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে প্রেমে পড়লাম। আমি প্রেমের উপরে পড়লাম, নাকি প্রেম আমার উপরে পড়লো, সেই বিতর্ক দূরে রেখেই বলা চলে, সেটা ছিলো কঠিন প্রেম। বিয়ে করার আগেই পুরাদস্তুর জড়ুকা গোলাম বনে গেলাম। প্রেমিকার (তখনও যেহেতু বিয়ে করি নাই, তাই বর্তমান বউকে প্রেমিকাই বলছি; আপনাদের অন্য রকম চিন্তা করার সুযোগ নাই) কোন প্রস্তাবেই না করতে পারি না। সে এক বেকায়দা সময় গিয়েছে। উদাহরন দেই……. যেই আমার টক জাতীয় খাবার খেলে দাত এমন শিরশির করতো যে, কয়েকদিন অন্য কিছু খেতেই পারতাম না; সেই আমি প্রেমিকার প্রেমময় আহ্বানে অবলীলায় কাচা আম ভর্তা, কামরাঙ্গা মাখা কিংবা লবন-মরিচ দেয়া আমড়া দাত-মুখ খিচে অবলীলায় কচকচিয়ে খাওয়া শুরু করলাম। মিশন-ভিশন সফল করার জন্য কতো রকমের ত্যাগ স্বীকারই না করতে হয় এই এক মানব জীবনে!!!
তো, একদিন আমার প্রেমিকা বললো, এ্যাই চলো না, আমরা আলিয়ন্স ফ্রসেজে গিয়ে ফ্রেঞ্চ শিখি। আমি বললাম, হঠাৎ ফরাসী ভাষা কেন? সে একটা মায়াকাড়া লুক দিয়ে বললো, কি সুন্দর প্রেমময় ভাষা! আমরা ফ্রান্সে গিয়ে ফ্রেঞ্চ বলবো!!! আমার মাথায় ঢুকলো না, দুনিয়াতে এতো দেশ থাকতে ফ্রান্সেই যেতে হবে কেন? তাছাড়া কয়েকদিন আগেই এক বন্ধুর সাথে কথায় কথায় বলেছিলাম, ফ্রেঞ্চ একটা ভাষা হইলো? ফকিরনী ভাষা! কেমন চেগায়ে চেগায়ে টাইনা টাইনা কথা বলে। মনে হয় বাস-ট্রেনে ভিক্ষা চাইতাছে! ইংরেজির মতোন স্মার্টনেসই নাই হালাদের। আমাগো কপাল ভালো, এই সাব-কন্টিনেন্টটা ফরাসীরা দখল করে নাই।
সেই কথা বেমালুম গিলে ফেলে মুখে বললাম, অবশ্যই, কেন নয়? প্রেম যেহেতু করছি, প্রেমময় ফরাসী ভাষা না শিখলে কেমন দেখায়? শেখা হয়ে গেলে আমরা নিজেরাও সবসময়ে ফ্রেঞ্চ ভাষাতেই ভাবের আদান-প্রদান করবো, কি বলো!!!
ভর্তি হয়ে গেলাম দু'জনে। সন্ধ্যার পরে ক্লাশ। কয়েকদিন ক্লাশের পরেই জানলাম, ফরাসী ভাষায় নাকি টেবিল-চেয়ারেরও লিঙ্গ-বিন্যাস আছে। বুঝে গেলাম, দুনিয়া উল্টে গেলেও এই খাতারনাক অযৌক্তিক ভাষা শেখা আমার কম্মো না। বাংলাতেই নদ আর নদীর ব্যাপারে আমি সব সময়েই প্রতিবাদমুখর। নদীর আবার লিঙ্গভেদ কি? সেখানে কি না টেবিল-চেয়ার! নো ওয়ে!! আমি ভেগে গেলাম। আমার প্রেমিকা অসীম ধৈর্য্য নিয়ে আরো কিছুদিন চালিয়ে গেল, তারপরে সেও ক্ষান্ত দিল; তবে দোষটা পুরাপরি আমার উপর চাপিয়ে দিয়ে। জানিয়ে দিল, আমি একটা অপদার্থ। আমাকে দিয়ে কিছুই হবে না। আমি গদগদ স্বরে বললাম, আর কিছু হওয়ার আমার দরকারও নাই। শুধু তোমার বর হইতে পারলেই আমি খুশী। ওর মুখ ভেঙচি দেখে বুঝলাম না, খুশী হলো.......নাকি রাগ!
আসলে জন্মসূত্রে বাংলার মতো একটা সুমধুর ভাষায় কথা বলার যোগ্যতা অর্জনেই আমি খুশী ছিলাম। তাছাড়া, দেশে অ আ ক খ শেখার সাথে সাথেই আমাদের এ বি সি ডি শেখাও শুরু হয়ে যায়। কাজেই ইংরেজির ক্ষেত্রে কখনও ক্ষুনাক্ষরেও মনে হয় নাই যে, একটা নতুন ভাষা শিখছি। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ার কল্যানে বাংলা আর ইংরেজি, দু'টাকেই আপন মনে হয়েছে সবসময়ে। বিজাতীয় বোধের স্থানই হয় নাই কখনও।
দেশে চাকুরী সূত্রে আমার এক ভারতীয় সহকর্মী ছিল। তার সাথে হিন্দিতে কথা বলার কসরৎ শুরু করলাম। লেগে থাকলে যে ফল ফলতে বাধ্য, সেটা অনুভব করলাম কিছুদিনের মধ্যেই। ইংরেজি বাদ দিয়ে বলিউডি মুভি দেখা শুরু করলাম নিজে, আর বউয়ের সাথে দেখা শুরু করলাম হিন্দি টেলি সিরিয়ালগুলো। কাহানী ঘর ঘর কি, কিউ কি শাস ভি কাভি বহু থি ইত্যাদি দেখতে দেখতে হিন্দির সাথে সাথে ঘরোয়া পলিটিক্সও ভালোভাবে শিখে গেলাম। বউকে বললাম, সারাদিন গয়না-গাটি পড়ে সাজুগুজু করে আমার চারিদিকে ঘুরাঘুরি করবা। দেখতেই তো ভালো লাগে। মনে করবা আমি পৃথিবী, তুমি আমার চাদ! হিন্দি সিরিয়ালগুলো দেখেও তো কিছু শিখতে পারো!!
ইংল্যান্ডে আসার পরে এখানকার ডাইভার্সিফায়েড অবস্থা দেখে বড়ই পুলকিত বোধ করলাম। কতো দেশের বিচিত্র সব মানুষ, ততোধিক বিচিত্র তাদের ভাষা। তারা যখন নিজেরা নিজেরা কথা বলে, মন দিয়ে শুনি। যদিও কিছুই বুঝি না, তবে লাভের লাভ যেটা হলো..........নতুন ভাষা-ভীতি আস্তে আস্তে কেটে গেল।
এখানে আরেকটা লাভ হলো। চাকুরী, প্রতিবেশী বা সামাজিক কারনে বিভিন্ন সময়ে প্রচুর ভারতীয় আর পাকিস্তানীদের সাথে মেলামেশা, কথা বলার সুযোগ হলো। ভারতীয়রা বলে, আরে তুমি তো দেখি চমৎকার হিন্দি পারো!! আমি আনন্দে আটখানা হই। পাকিস্তানীরা বলে, বাহ........তুমি উর্দুও পারো দেখি!! ওরা অবশ্য ভারতীয়দের মতো অতোটা উৎফুল্ল হয় না, কারন আমি তো আসলে উর্দু না, হিন্দি বলি। সে যাই হোক, এভাবেই দিন চলে যাচ্ছিল। হিন্দি ভাষাটা খালি লিখতে, পড়তে পারি না। তবে, ভাবনায় ছিল, বলা আর বোঝাতে আমি প্রায় শতভাগ ফ্লুয়েন্ট!!! আমার এই আত্মবিশ্বাস ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেল একবার।
বছর দশেক আগের কথা। দেশে গিয়েছি। এক বন্ধুর সকরুণ মিনতিতে তার চিকিৎসার গ্রাউন্ড ওয়ার্ক করার জন্য ভারতে গেলাম, দিল্লীতে। আমার বন্ধু আবার হিন্দি পারেই না বলতে গেলে। কাজেই সুযোগ বুঝে ওর গার্ডিয়ান বনে গেলাম। যে কোন কথোপকথনেই আগ-বাড়িয়ে কথা বলি, বড়ই আনন্দ লাগে। মনে মনে বলি, দ্যাখ ব্যাটা.......হিন্দি কতো প্রকার ও কি কি!!
একদিন ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ বিএমডাব্লিউ এর একটা শো-রুম নজরে পড়লো। অনেকদিন আগের কথা, ওটা ছিল সম্ভবতঃ মথুরা রোডে। গাড়ীর প্রতি আমার ফ্যাসিনেশান সাংঘাতিক রকমের। তাছাড়া, আমার নিজের গাড়িটা ওই ব্র্যান্ডেরই হওয়াতে একটা আত্মীক টানও অনুভব করলাম। ঢুকলাম। এই গাড়ি সেই গাড়ি দেখি। এক স্মার্ট এবং সুন্দরী সেলস পারসন আমার সাথে সাথে ঘুরছে। হঠাৎ একটা গাড়ি দেখে থমকে গেলাম। চমৎকার মডেল, আর ততোধিক চমৎকার রং। বললাম, ইস কা টেস্ট ড্রাইভ হো সাকতা হ্যায়?
আমার কথার উত্তর না দিয়ে সুন্দরী পাল্টা প্রশ্ন করলো, আপ কাহাছে হো?
আমি বললাম, বাংলাদেশছে, কিউ?
সুন্দরী গাড়ির দিকে ইঙ্গিত করে বললো, ''ইস কা'' না ''ইস কি'' হবে, আর ''সাকতা হ্যায়'' না, ''সাকতি হ্যায়'' হবে।
আমি বললাম, বলো কি? কেন?
কিউ কি ইয়ে ফিমেইল হ্যায়। সুন্দরী ঘোষণা দিল।
স্যরি…...এক্সকিউজ মাই ল্যাঙ্গুয়েজ, ওর কথা শুনে আমি আক্ষরিক অর্থেই বোকাচোদা বনে গেলাম। গাড়িটার আপাদমস্তক ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলাম। নারীত্বের বিন্দুমাত্র চিহ্নও নাই। তবুও নিশ্চিত হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করলাম, ইয়ে লাড়কি হ্যায়? ইউ মাস্ট বি জোকিং। তা সব গাড়িই মেয়ে নাকি শুধুই বিএমডাব্লিউ?
সব গাড়িই মেয়ে।
সব গাড়ি বলতে ভারতের সব গাড়ি? নাকি তামাম দুনিয়ার সব গাড়ি?
এই পর্যায়ে মেয়েটা মনে হলো খানিকটা বিরক্ত। কিন্তু কাস্টমারের সামনে তো সেটা প্রকাশ করতে পারে না! প্রফেশনাল অবলিগেশান্স বলে কথা! তারপরেও গলায় খানিকটা বিরক্তি ঢেলে বললো, তামাম দুনিয়ার সব গাড়িই মেয়ে!!!
আমি মনে মনে বললাম, হলি কাউ! আর মুখে বললাম, কিছু মনে করবেন না বেহেনজি। আপনি মনে হয় খানিকটা বিরক্ত। আপনাকে এতো ত্যক্ত করার কারনটা খুলেই বলি। আমি বাংলাদেশী হলেও ইংল্যান্ডে থাকি। সেখানে গত দু'বছর ধরে একটা বিএমডাব্লিউ-ই ব্যবহার করছি। তাছাড়া দেশে বিদেশে কতো গাড়িতেই না চড়েছি। এরা সবাই যে মেয়ে সেটা জানা ছিল না। এখন থেকে কোন গাড়ির ভিতরে ঢোকার আগে 'এক্সকিউজ মি' বলতে হবে। মেয়ে বলে কথা!! তাছাড়া, গত দু'বছর ধরে আমার বর্তমান গাড়িটা ব্যবহার করছি যথাযথ সন্মান না দিয়েই! কি না কি মনে করে বসে আছে! তাকেও তো আমার স্যরি বলা উচিত, তাই না!!! সে‘জন্যেই এতো প্রশ্ন করলাম। কিছু মনে করবেন না।
হতভম্ব বেহেনজিকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ত্রস্তপায়ে সেখান থেকে ভেগে এলাম, গাড়িও যে নারী সেই জ্ঞান হাসিল করে! ভাবলাম, আমার এই নয়া লব্ধ জ্ঞান অতি-অবশ্যই গোপণ রাখতে হবে। বউ ক্ষুনাক্ষরেও যদি জানে, ইয়ে লাড়কি হ্যায়; তাহলে আমার সাধের গাড়িকে ঝেটিয়ে বাড়িছাড়া করবে তো বটেই, আমার এতোদিনের মেলামেশারও কৈফিয়ত চাইতে পারে!!
সন্দেহ খুবই খারাপ জিনিস!!!
ছবিসূত্র
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে আগস্ট, ২০২৩ দুপুর ২:১৯