দু'টা কারনে গত কয়েকদিন ধরে মন খুবই খারাপ।
প্রথমতঃ দেশে আমার বন্ধু, একজন অতুলনীয় সুহৃদ, ভার্সেটাইল অভিনেতা আহমেদ রুবেলের হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে আকস্মিক মহাপ্রয়াণ। আর দ্বিতীয়তঃ, বিদেশে অর্থাৎ এখানে আমার আরেক সুহৃদ রাশেদভাইয়ের (অনেক পোষ্টেই সুমনাভাবীর কথা বলেছি, উনার পতিদেব) হৃদযন্ত্রে আক্রমণ এবং ফলাফল Coronary Artery Bypass Grafting (CABG) এর সম্মুখীন হওয়া, যেটাকে সহজভাবে হার্টের বাইপাস সার্জারী বলা হয়। রাশেদভাইয়ের ক্ষেত্রে এক্সট্রা টেনশান, কারন সমস্যাটার কেতাবী নাম Triple Vessel Disease…...হার্টের সিরিয়াস টাইপের একটা সমস্যা। সোজা করে বললে, যেই তিনটা মূল ভেসেল বা চ্যানেলের মাধ্যমে আমাদের হার্ট রক্ত পরিবহন করে, সেগুলো ব্লক হয়ে যাওয়া। ভয়াবহতার মাত্রা আমার জন্য আরো বেশী কারন, আড্ডারত অবস্থায় আমার সামনেই তার এ্যটাক হওয়া; তারপরে আমার গাড়িতে করেই তুরন্ত তাকে নিকটস্থ হাসপাতালের এ এন্ড ই'তে নিয়ে যাওয়া। সম্পূর্ণ নতুন একটা অভিজ্ঞতা; তবে অতি অবশ্যই এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন দ্বিতীয়বার আর হতে চাই না।
হাজার মাইল দূরে থাকার আর দু‘জনেরই অত্যাধিক ব্যস্ত জীবনের কারনে রুবেলের সব খবর আমার নিয়মিত রাখা হয়ে উঠে নাই। আর এখন তো সে সবকিছুর উর্ধে চলে গিয়েছে। মহান সৃষ্টিকর্তা তাকে ক্ষমা করে দিবেন, এই কামনা এবং দোয়াই করি। এদিকে একই শহরে কাছাকাছি থাকার সুবাদে রাশেদভাইয়ের সব খবরই আমি রাখি। তাকে একজন 'মেডিক্যাল টেস্ট ফ্রিক' বলা যায়। এখানে সীমিত সুযোগের মধ্যেও যখনই সুযোগ পায়, বিভিন্ন টেস্ট করায়। আর দেশে গেলে তো কথাই নাই, যতো ধরনের টেস্ট আছে সবই করিয়ে আসে। তার লিপিড প্রোফাইল সব সময়েই চমৎকার। ইসিজি, ইটিটি, ব্লাড প্রেশার……..সবই স্বাভাবিক। অনিয়ন্ত্রিত খাওয়া-দাওয়া করে না, শারীরিককভাবে প্রচন্ড একটিভ একজন মানুষ। তার এই অবস্থা!! ভাবাই যায় না।
উনার এই অবস্থার জন্য আমি মনে করি, ডাক্তাররাই (দেশের এবং এইখানকার) দায়ী। কারন বলছি। যখনই সে হার্ট সংক্রান্ত বিভিন্ন টেস্ট করিয়েছে, সেসব রিপোর্ট দেখে ডাক্তার বলেছে, আরে…...আপনার হার্টের অবস্থা তো চমৎকার! কোন টেনশান করবেন না। এনজয় ইয়োর লাইফ!! এই মিসইনফরমেশানের কারনে কোন খারাপ চিন্তাই তার মনে কখনও আসে নাই। নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়িয়েছে। আর এখন, হসপিটালে শুয়ে আছে। এই হলো এনজয়মেন্টের নমুনা!!!
হার্টের বিভিন্ন রকমের অসুখ আছে। তবে যেটার কারনে মানুষ সবচেয়ে বেশী ভোগে কিংবা মারা যায়, সেটা হলো হার্ট এ্যটাক। আর এই হার্ট এ্যটাক হয় আর্টারী কিংবা ব্লাড ভেসেলগুলোতে ব্লক হওয়ার কারনে। ব্লক হয় আর্টারী বা ধমনীগুলোর ভিতরের দেয়ালে প্লাক (প্রধানতঃ চর্বি, কোলেস্টেরল, ক্যালসিয়াম ইত্যাদি) জমা হওয়ার কারনে। ভয়াবহতা আর অধিক মৃত্যুহারের কারনে এটাকে একসময়ে ''উইডো-মেইকার'' বলা হতো; তবে মহিলাদের অধিকহারে এই অসুখে আক্রান্ত হওয়া আর এর চিকিৎসায় প্রভূত উন্নতি হওয়ার কারনে এটা এখন আর ততোটা প্রচলিত শব্দ না।
রাশেদভাইয়ের সমস্যার জন্য ডাক্তারদেরকে কেন দায়ী করছি তা একটা উদাহরনের মাধ্যমে বোঝানোর চেষ্টা করি। বাড়ি তৈরীর সময়ে পানির সাপ্লাইয়ের জন্য যে পাইপগুলো লাগানো হয়, সেগুলোর মাধ্যমে নতুন অবস্থায় যে পরিমান পানি প্রবাহিত হতে পারে, যতোদিন যায় প্রবাহ বিভিন্ন কারনে (যেমন, আয়রন, বিভিন্ন রকমের ময়লা ইত্যাদি জমা হওয়া) আস্তে আস্তে কমে আসে। এই সমস্যা কেন হচ্ছে, এটা কিন্তু বাইরে থেকে দেখে বোঝা সম্ভব না। পাইপের এই সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান হয়তো একেবারে সম্ভব না, তবে সাবধান হলে ক্ষতি কমানো সম্ভব। আমি যেই টেস্টগুলোর কথা উপরে বলেছি, সেগুলো হলো পাইপকে বাইরে থেকে দেখার মতো। ওই টেস্টগুলো অবশ্যই দরকারী, কিন্তু সেইসাথে আরো কিছু টেস্টও দরকারী যেগুলো পাইপের ভিতরটাও দেখতে পারে, নয়তো রাশেদভাইয়ের মতো সর্বনাশ হতে পারে যে কোনও সময়েই।
কবি-সাহিত্যিকদের বর্ণিত হৃদয় বা আমাদের শরীরে স্থাপিত বায়োলজিক্যাল যন্ত্র, হৃদযন্ত্র বা হৃদপিন্ড হচ্ছে একমাত্র যন্ত্র যেটা মানবশিশু ভুমিষ্ঠ হওয়ার আগে মায়ের গর্ভ থেকেই কাজ শুরু করে, আর একেবারে মৃত্যুর সাথে সাথেই কাজ বন্ধ করে। মাঝের এই সময়টুকুতে কোন একটা ভগ্নাংশের জন্যও এটা কাজ বন্ধ করে না। মুহুর্তের জন্যও বিশ্রাম নেয় না। এহেন যন্ত্রের একটা বিকল্প শরীরের ভিতরে থাকা খুবই জরুরী ছিল। কিন্তু নাই যেহেতু, এটার মঙ্গলের আর সুস্থতার সর্বোচ্চ চেষ্টা আমাদের করা উচিত, আমাদের নিজেদেরই স্বার্থে। মনে রাখতে হবে, এটার কর্তব্যপরায়নতার কারনেই আমাদের শরীরের প্রতিটা কোষ রক্তের মাধ্যমে খাদ্য আর অক্সিজেনের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ পায়। এটা কাজ করা বন্ধ করার সাথে সাথেই আমাদের আজরাইল-দর্শন হয়ে যায় তৎক্ষনাৎ। কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো, এমন একটা মহা গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র বিভিন্নভাবে আমাদের বেকুবী আর অবহেলার শিকার হয় প্রতিটা পদে।
আমরা কিভাবে আমাদের হৃদযন্ত্রের ক্ষতি করছি? তার আগে বুঝতে হবে, হৃদযন্ত্রের অসুখগুলোর ধরন আসলে কেমন। মোটাদাগে মানব শরীরের অসুখগুলো দুই ধরনের। জীবাণুঘটিত আর লাইফ স্টাইল সম্পর্কিত। হৃদযন্ত্রের যে কোনও অসুখই লাইফ স্টাইল সম্পর্কিত। এই লাইফ স্টাইলের বিষয়টা আবার দুই ধরনের। একটা ধরনকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি অর্থাৎ আমরা যেভাবে দৈনন্দিন জীবন-যাপন করি এবং খানা-খাদ্য খাই। উদাহরন হিসাবে বলা যায়…….ধুমপান করা, অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট, তৈলাক্ত আর তেলেভাজা খাবার, প্রোসেসড খাবার, ফাস্টফুড (জাঙ্ক ফুড), চিনি, লবন ইত্যাদি খাওয়া, কায়িক পরিশ্রম না করা, শাক-সব্জী ফল-মূল কম খাওয়া, আমাদের খাওয়া আর ঘুমের মধ্যে একটা সমন্বয় করা ইত্যাদি। আরেকটা যেটা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেমন, আমাদের পারিপার্শ্বিকতা, পরিবারের সদস্যদের হৃদরোগের ইতিহাস, ভৌগলিক অবস্থান, সামাজিক ও জাতিগত অভ্যাস ইত্যাদি ইত্যাদি।
এখানে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো হৃদরোগের আক্রমণ সম্পর্কিত কিছু জরুরী বিষয় জানা এবং মনে রাখা; আর বয়স ৩০ এর বেশী হলে কিছু পরীক্ষা নিয়মিত করানো। ৪০ এর বেশী হলে আরো কিছু পরীক্ষা এবং ৫০ এর বেশী হলে আরো কিছু পরীক্ষা নিয়মিত করানো।
কমিউনিটি বা প্রিভেনটিভ মেডিসিনে একটা কথা খুবই প্রচলিত। সেটা হলো, Prevention is better than cure. অর্থাৎ কোন একটা অসুখ হয়ে যাওয়ার আগেই সেটা যাতে করে না হয়, তার পদক্ষেপ নেয়া। এটা সব রোগের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য তবে লাইফ স্টাইল রোগ যেমন হৃদরোগ, ডায়াবিটিস ইত্যাদির জন্য আরো বেশী করে প্রযোজ্য। কিছু বোকামী আর ছন্নছাড়া জীবন-যাপনের জন্য একজন আপাতঃ সুস্থ মানুষ কিভাবে চট করে দীর্ঘদিনের জন্য অসুস্থ হয়ে যায়, চর্মচোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। আপনাদের যাদের হার্ট বাইপাস সার্জারীর রোগীর আদ্যোপান্ত দেখার সুযোগ হয়েছে, তারা বুঝবেন আমি কি বলতে চাচ্ছি। চোখের সামনে এমন একজনকে দেখে আমি সিগারেট ছেড়ে দিয়েছি। জীবন-যাপনে বেশ কিছু পরিবর্তনও এনেছি। দোয়া রাইখেন।
আমি মানছি, চিকিৎসা বিজ্ঞান অনেক এগিয়েছে। তবে, বাড়ির কাছে দমকল বাহিনীর অফিস আছে বলেই আমরা যেমন নিজের বাড়িতে আগুন ধরাই না; তেমনি, ভালো চিকিৎসা আছে বলেই অনিয়ন্ত্রিত জীবন-যাপন করে খাল কেটে কুমীর আনাটাও কোন বুদ্ধিমানের কাজ না। চল্লিশ বছর ধরে বিড়ি ফুকছি। নিজের কি সর্বনাশ করেছি জানি, আর না। এবার রিটায়ারমেন্টের সময় হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি রাশেদভাই এবং রুবেল, দু'জনেই চরমমাত্রায় বিড়ি খেতো।
অনেক বছর ধরেই আমার মাথায় Prevention is better than cure নামে একটা সিরিজ লেখার আইডিয়া ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি বহুকিছুই চিন্তা করি, কিন্তু বেশীরভাগের বাস্তবায়নই সম্ভব হয় না। বাস্তবায়নের জন্য আমার একটা যথাযথ ধাক্কা বা ট্রিগারের দরকার হয়। এমনিভাবেই এর আগে লিখেছিলাম ডিমেনশিয়া নিয়ে। তারপরে ভাবছিলাম হার্ট নিয়ে লিখবো। তবে আমার ক্ষেত্রে যা হয়, করবো করবো করে করা হয় না; লিখবো লিখবো করে লেখা হয় না, যতোক্ষণ পর্যন্ত একটা ধাক্কা বা ট্রিগারের উদ্ভব না ঘটে। এবার এটা লেখার ক্ষেত্রে মনখারাপের বিষয়টা ট্রিগার হিসাবে কাজ করছে। তবে হৃদয়ঘটিত সমস্যার গুরুত্ব আর বিষয়বস্তুর বিশালত্ব এতোটাই যে, এটা এক পর্বে লেখা সম্ভব না। কাজেই আপনারা চাইলে চেষ্টা থাকবে সহজ ভাষায় আরো বিস্তারিত কিছু একটা দাড় করানোর। সেই চেষ্টার অংশ হিসাবেই আজ খানিকটা স্যাম্পল দিলাম।
হৃদয় নিয়ে সবাই যত্নবান হবেন, এটাই আশা।
শেষ কথাঃ ফ্যামিলি হিস্ট্রি থাকলে বয়স ৩০ এর উপরে হলেই চিন্তা-ভাবনা শুরু করে দেয়া উচিত। একটা খুব দরকারী ভিডিওর লিঙ্ক দিলাম। কষ্ট করে শেষ পর্যন্ত দেখবেন। হার্ট এ্যটাকের পরে ভুল চিন্তা থেকে মানুষ কিভাবে সময় নষ্ট করে, বুঝতে পারবেন। হার্ট এ্যটাক হলে শরীর আপনাকে বেশ আগে থেকেই সংকেত দিবে। দিবেই। রাশেদভাইকে দিয়েছিল এবং আমি শত-সহস্রভাগ নিশ্চিত, রুবেলকেও দিয়েছিল। কিন্তু নতুন মুভি মুক্তির উত্তেজনায় সে সেটাকে ইগনোর করেছিল। কে জানে, হয়তো ভেবেছিল মুভির প্রিমিয়ারটা হয়ে যাক আগে। তারপরে না হয় ডাক্তারের কাছ থেকে ঘুরে আসা যাবে!!! এই ইগনোরটা না করলে ও হয়তো আজ আমাদের মাঝে বেচে থাকতো…….কে বলতে পারে!!!
Photo by Khadeeja Yasser on Unsplash.
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ রাত ২:২২