বাংলাদেশে বর্তমানে ভারতীয় পন্য বয়কটের একটা আন্দোলন চলছে। অনেকেই এটাকে 'ভারত বয়কট' বলার চেষ্টা করছেন, যা আদপে ঠিক না। এটা আসলে ভারতীয় পন্য বয়কটের আন্দোলন যা মূলতঃ FMCG'র মধ্যে সীমাবদ্ধ। দেশ থেকে যতোটুকু খবর পাচ্ছি, সাড়া ভালোই পাওয়া যাচ্ছে। বিদেশেও অবস্থা আশানুরুপ।
আমি থাকি ইংল্যান্ডের একটা ছোট্ট শহরে। এখানেও এই পন্য বয়কটের প্রভাব দেখা যাচ্ছে। আমাদের শহরের টাউন সেন্টারে দু'টা বাংলাদেশী গ্রোসারী শপ আছে। এরা নতুন করে ভারতীয় পন্য দোকানে তোলা বন্ধ করে দিয়েছে। বেশ কিছু চেইন সুপারস্টোর আছে, যেখানে ভারতীয় বাসমতি চালের পরিবর্তে পাকিস্তানী বাসমতি চালের বিক্রি বেড়েছে। আমি বহু বছর ধরে ভারতীয় অরিজিনের টিলডা অথবা কোহিনুর ব্র্যান্ডের বাসমতি চাল খাচ্ছি। এবার কিনলাম পাকিস্তানের লায়লা ব্র্যান্ডের চাল। অতোটা ভালো না, তবে চলে; দামও খানিকটা কম। এখন থেকে এটাই খাবো। আমার এক বন্ধু কানাডার সাস্কাটুনে থাকে। তার কাছ থেকেও একই রকমের তথ্য পেলাম। বিভিন্ন দেশে অবস্থান করা আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকেও বয়কট সম্পর্কে যা তথ্য পাচ্ছি ….….শুরু হিসাবে খারাপ না।
আমার অফিসে তিনজন ভারতীয় সহকর্মী আছে। দুইজনের এই নিয়ে কোন হেলদোল নাই। আরেকজন গুজু; মোদীর চেলা। স্টাফরুমে একদিন আমি, ক্রিস আর ওই ব্যাটা বসে কফি খাচ্ছি। এই কথা সেই কথায় একসময়ে আমাকে বললো, তোমরা বয়কট যখন করবা, তখন শুধু পন্য কেন? হিম্মত থাকলে সবকিছুই বয়কট করো। তাকে বললাম, ডোন্ট গেট অফেন্ডেড। জাস্ট ফর ইনস্ট্যান্স…... মনে করো আমি তোমাকে প্যাদানী দিচ্ছি। এখন তোমার বডির কোথায় কোথায় প্যাদানী দিবো সেটা কি তুমি ঠিক করবা, নাকি আমি? সে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। তারপরে হজম করতে না পেরে ''হঠাৎ কালবৈশাখী''র মতো অন্ধকার মুখ নিয়ে উঠে চলে গেল। সামনে বসা ক্রিস সবগুলো দাত বের বললো, এইটা কি কইলা! ওর তো এখন রাগের চোটে পায়খানা কষা হয়া যাবে!!!
ব্লগে আমার খুবই প্রিয় একজন ব্লগার আছেন। প্রিয় এই কারনে যে, উনি আমাকে ভীষণভাবে আমোদিত করেন। যখনই উনাকে অনলাইনে দেখি, খুবই আশায় থাকি আর উৎসাহে বুক বাধি; কারন কিছু না কিছু বিনোদনের উজ্জল সম্ভাবনা থাকে। উনি সর্বশেষ বলেছেন……..আমাদের পাশে ভারতের মত একটি ''ভদ্র সুপ্রতিবেশী'' ছিল বলেই বাংলাদেশ আজ একটি সফল সচ্ছল রাষ্ট্র। এটা পড়ার পর থেকেই পেটের মধ্যে কেমন একটা যেন গুড়গুড় করা আনন্দময় অনুভূতি হচ্ছে। ভারতের অবদান অবশ্যই অনস্বীকার্য। দেখি, সুযোগমতো এই পোষ্টের পরতে পরতে এই বিষয়ে আলোকপাতের চেষ্টা করবো।
তবে, ''ভদ্র সুপ্রতিবেশী'' কথাটায় আমার প্রবল আপত্তি আছে। এটা কেমন যেন খানিকটা পর পর শোনায়। ভারতকে এতোটা ডাউনস্কেলে ভাবা কি ঠিক? কথাটা সম্ভবতঃ 'নিকটাত্মীয়' অথবা মোর প্রিসাইসলি 'আত্মার আত্মীয়' হবে। একটু ব্যাখ্যা না করলে বিষয়টা মনে হয় পরিস্কার হবে না। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একসময়ে বলেছিলেন, ''আমি কোন প্রতিদান চাই না। প্রতিদানের কি আছে এখানে? আর কারো কাছে চাওয়ার অভ্যাস আমার কম, দেয়ার অভ্যাস বেশী। ভারতকে যা দিয়েছি, সেটা ভারত সারাজীবন মনে রাখবে।'' অনেস্টলি বলেন, এটা আপনাদের কাছে কি আন্তর্জাতিক রাজনীতির ভাষা মনে হচ্ছে, নাকি রোমান্টিক ভাষা মনে হচ্ছে? এই যে দেয়া-নেয়ার দুইটা পক্ষ, এদের সম্পর্কটা কিন্তু আসলেই বেশ রোমান্টিক!! সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলগা মোমেন সাহেবের কাছে এই বিষয়ে আমার সবিশেষ কৃতজ্ঞতা। উনি অসম্ভব রকমের একজন সৎ মানুষ। কোনরকমের ধোয়াশা ছাড়াই বিষয়টাকে খুবই সফলতার সাথে ব্যাখ্যা করেছিলেন; এক্কেবারে ক্রিস্টাল ক্লিয়ার। ভারত ঘুরে এসে উনি আরো বলেছিলেন, শেখ হাসিনা সরকারকে টিকিয়ে রাখতে যা যা করা দরকার, তার জন্য আমি ভারত সরকারকে অনুরোধ করেছি। আহা…….সাধু সাধু!! এমন একজন অতি কামিলদার বান্দার জন্য হ্যাটস অফ!!!
আসলে প্রিয়জনকে দেয়ার মধ্যে যে আনন্দ আছে, সেটা স্বর্গীয় আনন্দ। ভারতের সেভেন সিস্টার্সে মাল পরিবহনের জন্য আওয়ামী সরকার ভারতকে লম্বা করিডোর দিচ্ছে। আমাদের সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করে সেই সাত বোনকে মালামাল পরিবহনে সহায়তাও দিচ্ছে। কিন্তু ভারত আমাদেরকে নেপাল বা ভুটানের সাথে বানিজ্য করার জন্য ছোট্ট একটুখানি করিডোর দিচ্ছে না। সোজা কথায়, বাংলাদেশের ৪০০ থেকে ৫০০ কিলোমিটার সড়ক ব্যবহার করে ভারত তার দেশে পণ্য পরিবহন করছে। কিন্তু নেপাল-ভুটানে সরাসরি পণ্য পাঠাতে ভারতের মাত্র ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার সড়ক ব্যবহার করার বাংলাদেশের অনুরোধ তারা ঝুলিয়ে রেখেছে। তবে আমরা কিন্তু সেটা নিয়ে একেবারেই মর্মাহত না। কারন, যে সুবিধা নিচ্ছে; তার তো বিশেষ সম্পর্কের কারনে নেয়ার অধিকার আছে, তাই না!!! এক্ষেত্রে প্রতিদান কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না।
তারপরে মনে করেন, ভারত আমাদের সাথে ৫৪টা নদীর পানি-বন্টন নিয়ে গড়িমসি করছে। তিস্তা আর খোয়াই নদী তো বহুল চর্চিত একটা বিষয়। সেখানে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বিনা দ্বিধায় ফেনী নদীর পানি ভারতকে দিয়ে দিয়েছেন। একেই বলে অমর প্রেম। এই প্রেমে যে বা যারা বাধা হয়ে আসবে, তাদেরকেই চরম শিক্ষা দেওয়া হবে। কোন এক প্রেম-বিদ্বেষী নাদান আবরার ফাহাদ এই দুঃসাহস দেখিয়েছিল। ব্যাস…….ফুট্টুস!!!! কাজেই এই অবৈধ প্রেমের প্রতিবাদ জানানোর যে হাতিয়ার জনগনের কাছে আছে, সেটার ব্যবহারই তারা করছে। তাদের টাকা তারা কোথায় ব্যয় করবে, সেই সিদ্ধান্ত একান্তই তাদের। আমাদের পুরানো ঢাকায় এই প্রক্রিয়াকে বলে.........আমার চ্যাটের খুছি!!!
আমার এদেশীয় বেরাদার, বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ রবার্ট ম্যালথাসের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতেই যেন ভারত সরকার বাংলাদেশ সীমান্তে যুদ্ধাবস্থার চেয়েও ভয়ংকর পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছে। সুপ্রতিবেশী হিসাবে সীমান্তে ভারতের বিএসএফ জওয়ানরা আমাদের দেশের জন্যসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ আর খাদ্য সংকট নিরসনে কার্যকর ভূমিকা রাখছে। খবরে দেখলাম, দেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর বিক্রয়/ব্যবহার কমে গিয়েছে। কিন্তু সেই রিপোর্টে এর পেছনের কারনটা ব্যাখ্যা করা হয় নাই। এখন কারনটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন!! এটাই একটা ''ভদ্র সুপ্রতিবেশী''র দায়িত্ব এবং কর্তব্য। তবে কানে কানে বলে রাখি, ভারত-পাকিস্তান বা উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার বর্ডারেও এতো খুন হয় না। বিশ্বের অন্যতম ভয়ংকর সীমান্ত হলো বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত। আহা…….প্রেমের কি প্রতিদান!! আপনাদের কি মনে হচ্ছে, বড় প্রেম কাছে না টেনে দূরে ঠেলে দিচ্ছে? কাভি নেহি। পরে একসময়ে এই বিষয়ে আলোকপাত করবো নে!!!
এ ছাড়াও প্রেমের আরো অনেক অনেক সেক্টর আছে। সেসব দেখলে প্রেম যাদের কাছে এখন পুরানো বিষয় মনে হয়, তারাও আবার কোমর বেধে প্রেমে পড়তে ঝাপিয়ে পড়বেন। তবে, এক পোষ্টে তো আর সব নিয়ে কথা বলা সম্ভব না! তাই এখানে কয়েকটা স্যাম্পল দিলাম আর কি! একটা বিষয় জানিয়ে রাখি, এই প্রেম আমাদের দিক থেকে আসলে একমুখী প্রেম। ভারত ভন্ড প্রেমিকের মতো প্রেমের ভান করছে, আর বাংলাদেশকে যথেচ্ছ ব্যবহার করছে। কিসের মতো, তা আর বললাম না। আমার কথা বিশ্বাস হয় না, না? একটা উদাহরন দেই। ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে তারা প্রতিবছর একটা বন্ধুদেশের রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধানকে প্রধান অতিথি করে সন্মান দেখায়। আমাদের আশেপাশের সব দেশকেই তারা এই সন্মান দেখিয়েছে; শুধুমাত্র বাংলাদেশ বাদে। কারন তারা জানে অসন্মান করলেও বাংলাদেশের ক্ষমতার লোভে মত্ত আত্মসম্মানহীন একটা রাজনৈতিক দল পদলেহন কখনও বন্ধ করবে না। এই ব্যাপারে আরো জানতে চাইলে এখানে দেখেন।
আচ্ছা, আপনাদের কি ধারনা আছে ভারতীয় পন্য বয়কট কেন হচ্ছে? একটাই কারন। বাংলাদেশের আভ্যন্তরীন রাজনীতিতে ভারতের নাক গলানোর প্রতিবাদ। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে গুম-খুন করার একমাত্র সহযোগী হয়ে ওঠার কারনে প্রতিবাদ। এখন কান (এই ইস্যু) টানলে স্বাভাবিকভাবেই মাথাও (অন্যান্য ইস্যু) চলে আসবে; যদিও অনেকেই এটাতে ভারত বিরোধীতার রং চড়ানোর চেষ্টা করছে। বিষয়টা আদপে ভারত বিরোধীতা না, কিংবা ভারতকে শত্রু ভাবার বিষয় না। বিষয়টা ভারতের ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রতিবেশী দেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। একটা উদাহরন দিয়ে বিষয়টা পরিস্কার করার চেষ্টা করি। প্রায়শঃই লন্ডনের আন্ডারগ্রাউন্ড রেল কর্মীরা কর্ম-বয়কট করে। এর মানে কিন্তু রেইল কর্তৃপক্ষের সাথে তাদের শত্রুতা না; বরং তাদের কিছু সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানানো, দাবী-দাওয়া আদায়ের জন্য বার্তা দেয়া। আর ভারতে যে একটা ফ্যাসিস্ট সরকার ক্ষমতাসীন, এটা আমার কথা না। ভারতের সবচাইতে জনপ্রিয় ইউটিউবার ধ্রুব রাঠির কথা। যারা ধ্রুবকে চেনেন না তাদের বলছি, এর সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ১৬ মিলিয়নের উপরে। একটা পোষ্ট দিলে মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ হয়ে যায় অল্প সময়েই। সময় করে মোদী সরকারের অকাম-কুকামের উপরে করা এই ভিডিওটা দেখবেন।
জানুয়ারীর তথাকথিত নির্বাচনের পর অনলাইন একটিভিস্টদের মাধ্যমে এই আন্দোলনের সূত্রপাত এবং গতিশীলতা; আর পরবর্তীতে দেশে-বিদেশে সমমনা বাংলাদেশী জনসাধারনের সম্পৃক্ততা। এটা এখনও তাদের দ্বারাই চলমান। যে কোনও আন্দোলন জনপ্রিয় হলে তার রাজনৈতিক চরিত্রায়ন পুরানো স্ট্র্যাটেজি। বিএনপি সেটাই করার চেষ্টা করছে। করুক; তাতে যদি এই আন্দোলনে আরো গতি আসে, ক্ষতি কি? তবে এটাকে বিএনপির ব্রেইনচাইল্ড বলার কোন অবকাশ নাই। যারা বলছে, তাদের ব্যাক্কল বললেও কম বলা হয়। এরা উটপাখীর মতো বালুতে মাথা গুজে থাকা প্রজাতি। এদের কোন নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা, চেতনা বা আত্মসন্মানবোধ নাই।
এই উটপাখীরা বলছে এই আন্দোলনের কোন বেইল নাই। তাহলে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার ফোকাস; ভারতীয় দাদাদের গাত্রদাহ আর তাদের এদেশীয় দালালদের নর্তন-কুর্দনের কারন কি? আন্দোলন যদি কোন ফলই বয়ে না আনে, সফলই যদি না হয় তাহলে তো তাদের চুপচাপ ফজা মিয়ার মতো মজা লোটার কথা। সমস্যাটা কোথায়? সত্যি বলতে ভারতীয় দাদা, তাদের দোসর আর দালালদের ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চার মতো দৌড়-ঝাপ দেখলেই আসল পরিস্থিতি আচ করা যায়। এসব দেখি আর বিমলানন্দ অনুভব করি। কিছু মানুষের কাছে দালালী পেশাটা দেশপ্রেমের চাইতেও মহান!!!
মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী বলেছিলেন, যদি কখনো ভারতীয় দাদাদের মুখে আমার প্রশংসা শোনো তাহলে বুঝে নিবা আমি আমাদের দেশের বিরুদ্ধে কাজ করছি। এই বাণীর তাৎপর্য বুঝতে হবে। দাদারা যেহেতু আওয়ামিলীগ সরকারকে মন-প্রাণ উজার করে ভালোবাসা দিচ্ছে, বাংলাদেশের ক্ষমতায় টিকে থাকার নেপথ্যে কাজ করছে; কাজেই ……………….।
আকালমান্দ কে লিয়ে ইশারাই কাফি!!!
শিরোনামের ছবির লিঙ্ক।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯