
আচ্ছা বলেন দেখি, গাধা দিয়ে কি হালচাষ হয়? কেউ বলবেন হয়, কেউ বলবেন হয় না। আমি বলি হয়, তবে বলদের পারফরমেন্স পাওয়া যায় না।
গাধা দিয়ে হালচাষ করলে ফসল ভালো পাওয়া যায় না, মুফতে জমি নষ্ট করা হয়। কথাগুলো কেন বললাম? বললাম, চরম বিরক্তি থেকে। ইরান-ইজরায়েলের ১২ দিনের যুদ্ধ অন্য অনেকের মতো শুরু থেকেই ফলো করেছি। তবে মধ্যপ্রাচ্যের ইরান-ইজরায়েল দ্বন্দ্ব পর্যবেক্ষণ করা আমার বহুদিনের অভ্যাস। এই দ্বন্দ্ব নিয়ে আগেও পোষ্ট দিয়েছিলাম। ইরানের বোকামীর কারনে এর আগেও ইজরায়েল একবার পার পেয়ে গিয়েছিল। সে যাই হোক, ইরানের শাসক গোষ্ঠী একটা বিষয় বারে বারে বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছে; সেটা হলো, শুধুমাত্র জেহাদী জোশ দিয়ে আজকাল আর যাই হোক, যুদ্ধ করা যায় না। সেইজন্য ঘিলুও লাগে। ইরান যা করে তা হলো অনেকটা নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করার মতো। এরা বাস্তবতার কাছাকাছি অবস্থান করার চেষ্টা করে না।
ইরানকে বুঝতে হবে যে, এইসব যুদ্ধ করে তাদের আদপে কোন লাভ হবে না। অনেকেই এই ১২ দিনের যুদ্ধে ইজরায়েলের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে উল্লসিত। কিন্তু বাস্তবতা কি? ইজরায়েলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে মূলতঃ অবকাঠামোগত। এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আমেরিকা তাদের বাপ ইজরায়েলকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার দিবে। ইউরোপও দিবে। অপরদিকে, ইরানের ক্ষতি হয়েছে অপূরনীয়। বিল্ডিংকে বিল্ডিং দিয়ে রিপ্লেস করা যায়, কিন্তু ইরান যেসকল দক্ষ এবং অভিজ্ঞ বিজ্ঞানী আর জেনারেলদের হারালো, তার কোন রিপ্লেসমেন্ট সম্ভব না। ইরানের যেসকল পরমাণু স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্থ হলো, তাতে করে তারা কমপক্ষে এক দশক পিছিয়ে গিয়েছে। তার চাইতে বড় কথা, এইসব অবকাঠামোসহ অন্যান্য যেসকল অবকাঠামো ধ্বংস হলো, তা পূনঃস্থাপনের জন্য কেউ ইরানকে বিনাশর্তে এক টাকা দিয়েও সাহায্য করবে না। সবই ইরানকে করতে হবে নিজেদের তেল বেচা টাকায়। কাজেই যারা ইরানের সাময়িক সাফল্যে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন, তাদের জন্য সমবেদনা। এসব করে সত্যিকারের বন্ধুহীন ইরান ইজরায়েলের তেমন কিছুই করতে পারবে না। এটাই আফসোসের বিষয়!!!
আচ্ছা, এইসব বাদ দেন। এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা বিশাল ব্যাপার। ব্লগে একটা পোষ্ট দিয়ে সেটা সম্ভব না একেবারেই। তাই আমি এই পোস্টে ফোকাসড আলোচনার চেষ্টা চালাবো। আজ ইরানের দুইটা বেকুবী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করাই আমার মূল উদ্দেশ্য, যা ইরানের জন্য সূদূঢ়প্রসারী প্রভাব বয়ে নিয়ে এসেছে, আর সঠিক পদক্ষেপ না নিলে তাদেরকে ভবিষ্যতে আরো ভোগাবে।
প্রথমতঃ চাবাহার বন্দর প্রসঙ্গ।
ভারত ও ইরানের মধ্যে চাবাহার বন্দরের শহীদ বেহেস্তি টার্মিনাল পরিচালনার জন্য ১০ বছরের একটা চুক্তি ২০২৩ সালের মে মাসে স্বাক্ষরিত হয়। এর আগেও ২০১৬ সালে এই বন্দর পরিচালনার জন্য দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হয়েছিল। তবে প্রতি বছর সেই চুক্তি রিনিউ করতে হতো। ২০২৩ সালের দীর্ঘমেয়াদী চুক্তিকে ২০১৬ সালের চুক্তিরই একটা নতুন রূপ হিসাবে বর্ণনা করা হচ্ছে। তাজ্জবের ব্যাপার হলো, সারা দুনিয়ায় ইরান এই কামের জন্য একমাত্র ভারতকেই পেল। গবেট ইরানী কর্তৃপক্ষের মাথায়ই ছিল না যে, ভারতের ''র'' আর ইজরায়েলের ''মোসাদ'' ওয়ার্কিং পার্টনার। মোসাদ যে এই সুযোগে ইরানের শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী আর টপ মোস্ট জেনারেলদেরকে শহীদ করার মাধ্যমে বেহেস্তে পাঠানোর সুবন্দোবস্ত করবে, সেটা তাদের মস্তিষ্কেই খেলে নাই। এই কারনেই ''শহীদ বেহেস্তি টার্মিনাল'' নামকরনটার মধ্যে বেশ একটা ডার্ক হিউমার আছে!!! নামটা কি ভারত-ইজরায়েলের যৌথ উদ্যোগে দেয়া?
নেতানিয়াহু সেই ১৯৯৫ সাল থেকে বলে আসছে, ইরান যে কোনও সময়ে পরমাণু বোমা বানিয়ে ফেলবে। তার এই ধোয়া তোলার দুইটা উদ্দেশ্য ছিল। প্রথমটা, যদি কখনও তার ইরানে আক্রমণ করতে হয়, সেটাকে জাস্টিফাই করার গ্রাউন্ড তৈরী করা। আর দ্বিতীয়টা হলো, আমেরিকা আর ইওরোপকে ইরানের বিরুদ্ধে তাতিয়ে তোলা। একথা অনস্বীকার্য যে, এই কাজে তার সাফল্য অভূতপূর্ব। এর আগেও সে সাদ্দামের কাছে গণ-বিদ্ধংসী অস্ত্র আছে, এই কথা বলে বুশ-ব্লেয়ারকে ইরাক আক্রমণে প্ররোচিত করেছিল।
মোদি-নেতানিয়াহুর টাই এর কথা সারা বিশ্বই জানে, সম্ভবতঃ ইরান জানে না। দুইটাই চরম ইসলাম বিদ্বেষী। ইজরায়েল ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ। তাছাড়া, আল জাজিরার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়েছে যে, গাজা যুদ্ধের সময় ভারতীয় অস্ত্র সংস্থাগুলি ইজরায়েলে রকেট এবং বিস্ফোরকও বিক্রি করেছিল। এই সম্পর্ক হার্ডওয়্যার বিক্রির বাইরেও বিস্তৃত, যার মধ্যে যৌথ অভিযান, সাইবার নিরাপত্তা সহযোগিতা এবং গোয়েন্দা তথ্য ভাগাভাগি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে ভারতের 'র' এবং ইসরায়েলের মোসাদের গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ের বিশ্বাসযোগ্য ইতিহাস রয়েছে। এমন একটা দেশকে একটা গুরুত্বপূর্ণ বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া আদপে ''খাল কেটে কুমীর আনা''রই নামান্তর। ফলে আজ আমরা দেখছি, ইরানের আইআরজিসি চাবাহার বন্দরের কাছে একটি গুদামে অভিযান চালিয়ে ইজরায়েলের মোসাদের সাথে যুক্ত গুপ্তচরবৃত্তির একটা নেটওয়ার্ক আবিষ্কার করে। ইরানি সাইবার ইউনিটগুলির কয়েক সপ্তাহের নজরদারির পর পরিচালিত এই অভিযানে ১৪১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যার ১২১ জন ভারতীয় এবং ২০ জন ইজরায়েলি।
আপনাদেরকে একটা চমকপ্রদ তথ্য দেই। আমেরিকা দীর্ঘদিন থেকে ইরানের উপর বানিজ্যিক এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। এমনকি যেসকল বৈশ্বিক কোম্পানী ইরানের সাথে কাজ করবে, তাদেরকেও নিষেধানজ্ঞার আওতায় নিয়ে আসা হয়। অথচ, চাবাহার বন্দরে কাজ করা ভারতীয় রাষ্ট্রায়ত্ব কোম্পানীকে নিষেধাজ্ঞার আওতা বহির্ভূত রাখা হয়, যাতে করে তারা নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারে। আমার তো ধারনা, ভারত সেখানে যে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে, তার সিংহভাগ অর্থই আমেরিকা-ইজরায়েল যৌথভাবে দিয়েছে।
দ্বিতীয়তঃ পরমাণু বোমা প্রসঙ্গ।
ইরান মূলতঃ পরমাণু বোমার বিষয়ে অনাগ্রহী ছিল একটা ফতোয়ার কারনে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ২০০৩ সালে একটি ফতোয়া বা ধর্মীয় আদেশ জারি করেন, যাতে পারমাণবিক অস্ত্রের উন্নয়ন, উৎপাদন, মজুদ এবং ব্যবহারকে ইসলামবিরোধী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অথচ কোরআন শরীফে সূরা বাকারার ১৯৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, "তোমরা নিজেদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিও না।" এই আয়াত থেকে ইসলামী ফেকাহবিদরা মনে করেন, নিজের জীবন রক্ষা করা বা আত্মরক্ষা করা ফরজ। এছাড়াও, কোনো নিরপরাধ মানুষের জীবন রক্ষা করাকে সমগ্র মানবজাতির জীবন রক্ষার সমতুল্য বলা হয়েছে, যা সূরা মায়িদার ৩২ নম্বর আয়াতে উল্লেখ আছে। আমি কোন ইসলামী স্কলার না, তবে আমার মনে হয় এর আলোকেই তো পরমাণু বোমা তৈরী করা যায়!!! হুদাই ফালতু ফতোয়া দেয়ার দরকারটা কি? আজকালের বিশ্বে এই বোমা থাকাটাই যথেষ্ট, ব্যবহারের দরকার পড়ে না। এই বোমার কারনেই দূর্বল অর্থনীতির উত্তর কোরিয়া ঠাট-বাট নিয়ে বিশ্বে যারে তারে হুমকি-ধামকি দেয়। এই বোমার কারনেই আগের মেয়াদে ট্রাম্প তাদের প্রেসিডেন্ট কিমের সাথে বৈঠক করতে বাধ্য হয়েছিল। আর এই বোমার কারনেই টাকার জন্য দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করা গরীব পাকিস্তানের সেনাপ্রধানকে ট্রাম্প হোয়াইট হাউজে লাঞ্চের দাওয়াত দেয়!!! তাদের তো এই বোমা ব্যবহার করতেও হয় নাই, কিন্তু দেশ ও জাতির সুরক্ষা তারা ষোলআনাই নিচ্ছে। এই নশ্বর দুনিয়ায় ইজ্জৎও হাসিল করে নিচ্ছে!!! বোমা না থাকলে আজকের বিশ্বে ভুখা-নাঙ্গা উত্তর কোরিয়া আর পাকিস্তানকে কে গুনতো? ইরানের সর্বোচ্চ নেতৃবৃন্দ এসব দেখেও কোন শিক্ষা নিবে না। তাদের সব নজর একটা ফালতু, অবিবেচনাপ্রসূত ফতোয়ার দিকে। তাদের শুধু বড় বড় হুমকি-ধামকি, ওইদিকে যে তলা খালি হয়ে যাচ্ছে তার কোন খবর নাই। কথা কম বলে তাদের উচিত কাজের দিকে মনোযোগ দেয়া। আজ তাদের কাছে পরমাণু বোমা থাকলে ১২ দিনের এই যুদ্ধই হতো না। পুরা মধ্যপ্রাচ্য তাদের কথায় সূর মেলাতো। ভুল কিছু কি কইলাম?
চীন, রাশিয়া কিংবা ব্রিকসের কল্যানে আমরা যতোই বহুপক্ষীয় বিশ্বব্যবস্থার স্বপ্ন দেখি না কেন, এই জন্য আমাদের অপেক্ষার সময় হবে দীর্ঘতর। এই সময়টাতে পীর ইজরায়েল আর তার গুণমুগ্ধ ভক্ত-আশেকান আমেরিকা এবং পশ্চিমা বিশ্বের মাস্তানী আমাদের সহ্য করতেই হবে। আন্তর্জাতিক আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তারা বিশ্বের যে কোনও প্রান্তে যা খুশী তাই করতে পারবে কিন্তু জাতিসঙ্ঘ নামক আবাল ক্লাবটা কিছুই করতে পারবে না। বিলাসিতায় ডুবে থাকা মধ্যপ্রাচ্যের ইতরশ্রেণীয় মুসলিম দেশগুলোর কল্যানে ওআইসি ঠুটো জগন্নাথের ভূমিকা পালন করতেই থাকবে। এই বিশ্ব-বাস্তবতায় এখানে ওখানে ইরানকে কেন মাথা ঠুকতে হয়, সেটাই বুঝি না। কেউ কিছু করে দেবে না। যা করার, তাদেরকেই করতে হবে। এটা তারা যতো তাড়াতাড়ি বুঝবে, ততোই মঙ্গল।
আমি আসলে বুঝি না, আমার মতোন ভুয়া যেই বিষয়টা চ্যালচ্যালাইয়া বুঝতে পারতেছে, ইরানের তাবৎ বাঘা বাঘা নেতৃবৃন্দ সেইটা বুঝতে পারতেছে না কেন? হুয়াই!!!!!!
ফটো ক্রেডিটঃ বিবিসি।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুন, ২০২৫ দুপুর ১২:০২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


