
১৯৯০ সালের ২৭শে নভেম্বর। ঘুমিয়ে আছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সূর্যসেন হলের চার তলার একটা রুমে। রুমটা আমার এক বাল্যবন্ধুর, ডাবল এই রুমটাতে একাই থাকে ছাত্রদলের একজন মাঝারীমানের নেতা হওয়ার কল্যানে। এখন সে বিএনপির বড় নেতা, তাই সঙ্গত কারনেই তার নাম বলছি না। ধরে নেই তার নাম মাসুম। বেলা ১২টার দিকে তার ধাক্কায় চকি থেকে প্রায় পড়ে যাওয়ার অবস্থা। বলছে, ওঠ শালা। এরশাদের কুত্তারা মিলন ভাইরে গুলি করছে!!!
ধড়মড় করে উঠে বসলাম। কোনমতে বললাম, কস কি? এরশাদ শিকদার খুলনা থিকা কুত্তা পাঠাইছে? এরশাদ শিকদার তখন খুলনার নামকরা সন্ত্রাসী, বিরাট নামডাক; লেজেহোমো এরশাদের একনিষ্ঠ চামচা। তার নামই কেন ওই মুহুর্তে আমার মাথায় এসেছিল, আজও জানি না। মাসুম আমাকে ভয়ঙ্করভাবে ঝাকাতে ঝাকাতে বললো, শালার গান্জার নেশা এখনও যায় নাই!!! এরশাদ শিকদার না, জেনারেল এরশাদ। মিলনভাইরে হাসপাতালে নিছে, মনে হয় আর নাই।
হুড়মুড় করে বিছানা থেকে নামলাম। গান্জার নেশা.........মাসুম অবশ্য কথাটা খারাপ বলে নাই। গতকাল সারাদিন মিটিং-মিছিল আর দৌড়-ঝাপ করে রুমে এসে গাজায় দম দিয়ে ফজরের দিকে ঘুমিয়েছিলাম। বিকালের আগে ঘুম থেকে উঠার কোন প্ল্যানই ছিল না। কোনমতে রেডি হয়ে জিনিস-পত্র নিয়ে হাসপাতালের দিকে দৌড়ালাম।
আমি আসলে হলে থাকতাম না, বিশেষ বিশেষ সময় ছাড়া। আমি এটাচড ছিলাম জহুরুল হক হলে, কিন্তু ওইটা ছিল ছাত্রলীগের দখলে। ছাত্রদলের সাথে সংশ্লিষ্টতার কারনে সেখানে থাকার প্রশ্নই ছিল না। খুব জরুরী কাজ ছাড়া ওইমুখো হতাম না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়েছে তারা জানে, আবাসিক কিংবা অনাবাসিক, সব ছাত্রকেই কোন না কোন হলে এটাচ করা হতো। প্রতিটা ছাত্রের প্রশাসনিক রুটিন কাজগুলো হলের অফিস থেকেই হতো। তো, আমার বিচরণ মূলতঃ ছিল ছাত্রদলের দখলে থাকা মহসিন হল আর সূর্যসেন হলে। যাই হোক, প্রসঙ্গে আসি। হলের গেটে আসতে আসতেই খবর পেলাম, মিলনভাই আমাদের মাঝে আর নাই। ডাঃ শামসুল আলম খান মিলন। উনি ছিলেন বিএমএ'র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।
স্ফুলিঙ্গের মতো সারা ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়লো, সবার প্রিয় মিলনভাইকে এরশাদের কুত্তারা মেরে ফেলেছে। ওটাই ছিল এরশাদের পতনের ফাইনাল ঘন্টা। তারপর আর কি? উত্তাল হয়ে উঠলো সারা ক্যাম্পাস। আন্দোলন সামলাতে না পেরে হল খালি করা, হত্যা-দমন-পীড়ন, পেটোয়া বাহিনী লেলিয়ে দেয়াসহ কোন উপায়ই বাকী ছিল না। শোনা যায়, শেষ উপায় হিসাবে এরশাদ সামরিক আইন জারি করতে চেয়েছিল, কিন্তু তৎকালীন সেনা প্রধান রাজী হয় নাই। অগত্যা কি আর করা, শেষরক্ষা করতে না পেরে তীব্র আন্দোলনের মুখে স্বৈরাচার এরশাদ ৪ ডিসেম্বর রাতে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। অবশেষে ৬ই ডিসেম্বর ভুয়া রাষ্ট্রপতি হোসেইন মোহম্মদ এরশাদ আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করে এবং বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ দায়িত্ব গ্রহণ করেন, যার মাধ্যমে সামরিক শাসক স্বৈরাচার এরশাদের পতন হয়।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
২০২৪ সালের ১৬ই জুলাই। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে গুলি করা হয় আনুমানিক বেলা সাড়ে তিনটার দিকে, সেটা ইংল্যান্ড সময় সকাল সাড়ে দশটা। স্বৈরাচার হাসিনা পতনের টার্নিং পয়েন্ট। আমি তখন অফিসে। লাঞ্চ ব্রেকের সময়ে আমার এক পরিচিত আবু সাঈদকে গুলি করার ভিডিও আর ছাত্রলীগের সাধারন ছাত্রীদের উপরে জঘন্যতম হামলার কতোগুলো ছবি হোয়াটসএ্যাপে পাঠায়। ভিডিও আর ছবিগুলো দেখে প্রচন্ড রাগ হলো। কাজে কিছুতেই মন বসাতে পারছিলাম না, মাথার মধ্যে শুধুই ছবিগুলো!!!! কয়েকজনকে ফোন করলাম। ততোক্ষণে মোটামুটি সবাই জেনে গিয়েছে। ঠিক হলো, বিকাল সাতটার দিকে সবাই একত্র হবো।
এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, ১লা জুলাই থেকে শুরু হওয়া বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে আমি শুধুই কোটা সংস্কার আন্দোলন হিসাবে দেখছিলাম, যা অনেকটা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মতোই একটা আন্দোলন। এর পরিনতিও যে ওই আন্দোলনের মতোই হবে, তাতে আমার কোন সন্দেহ ছিল না। ফলে অনেকটা নিরাসক্তভাবেই দেশের মধ্যে জমে উঠা এই আন্দোলনকে ফলো করছিলাম। কিন্তু আবু সাইদের হত্যাকান্ড আর সাধারন ছাত্রীদের উপর ছাত্রলীগের এই পৈশাচিক হামলা আমার মনোজগতে একটা বড় ঢেউ তুললো। শুধু আমার না, দেশে এবং দেশের বাইরে ছড়িয়ে থাকা কোটি কোটি বাংলাদেশীর মনের অবস্থা নিশ্চিতভাবেই একইরকমের ছিল।
আমাদের শহর আর এর সাথে লাগোয়া আরো চারটা শহর মিলে বাংলাদেশী কমিউনিটি বেশ বড়। তাছাড়া এই পাচ শহরে দু'টা বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যেখানে আমাদের দেশী ছাত্রের সংখ্যা নেহায়েত কম না। ২০২৪ সালের ১৬ই জুলাই ছিল মঙ্গলবার। সেদিন ঠিক হলো বৃহসপতিবার বড় পরিসরে আমরা বসে করনীয় ঠিক করবো। সেই মিটিংয়ে যে সকল সিদ্ধান্ত আমরা নেই সেগুলো ছিল,
# প্রতি শুক্রবারে জুম'আর নামাযের খুতবার আগে ইমাম সাহেব আওয়ামী নৃশংসতা তুলে ধরবেন। এই নৃশংসতা প্রদর্শনের জন্য মসজিদের প্রধান ফটকের সামনে একটা ফটো গ্যালারী করা হবে এবং আন্দোলনে সহায়তার জন্য ডোনেশান নেয়া হবে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই ডোনেশান কার্যক্রমে শুধু দেশী না, উল্লেখযোগ্য পরিমানে বিভিন্ন দেশের মুসল্লীরাও অংশ নিয়েছিলেন!!!!
# দেশে রেমিটেন্স পাঠানো বন্ধ করা হবে। কারো পরিবারের যদি খুবই দরকার হয়, তাহলে দেশের একটা একাউন্ট থেকে টাকা দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে, তবুও এখান থেকে একটা পাউন্ডও দেশে যাবে না। অনেক ছাত্রই দেশ থেকে টাকা আনে। সেটাতে যদি ব্যাঘাত ঘটে, তাহলে এখানকার একটা একাউন্ট থেকে তাদেরকে জরুরী সহায়তা দেয়া হবে। মজার ব্যাপার হলো.........সম্ভবতঃ ২৭ তারিখে পলক হাত জোড় করে রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য কাতর অনুনয়-বিনয় করে। তার পরেই যারা জরুরী প্রয়োজনে টুকটাক পাউন্ড পাঠাচ্ছিল, তারাও পাঠানো বন্ধ করে দেয়!!!!
# ইওরোপের বিভিন্ন দেশে প্রবাসীদের সাথে যোগাযোগ করে আমাদের কার্যক্রম আর তাদের কার্যক্রমের হালচাল বিনিময় করা হবে। পর্যায়ক্রমে বিশ্বের অন্যান্য দেশের প্রবাসীদের সাথেও যোগাযোগ করা হবে।
# বিভিন্ন স্থানীয় আর আন্তর্জাতিক সংস্থায় যোগাযোগ করে বাংলাদেশের হাল-নাগাদ অবস্থা জানানো হবে।
# প্রতি রবিবারে বিভিন্ন চার্চের সামনে একটা ডেস্ক স্থাপন করে তার মাধ্যমে দেশের স্বৈরাচারের স্বরুপ উন্মোচন করা হবে।
আমাদের এই কার্যক্রম ৫ই অগাষ্ট পর্যন্ত চালু ছিল।
৫ই অগাষ্ট সকাল ৯:০০ টার দিকে খবর পেলাম, সেনাপ্রধান নাকি ভাষণ দিবে। পেটের মধ্যে গুড়গুড় অনুভূতি নিয়ে তারপর থেকেই আমি মোটামুটি লেগে থাকলাম বিভিন্ন উপায়ে খবর পাওয়ার জন্য। সকাল ৯:৩০ এ নিশ্চিত হলাম, হাসিনা আর নাই; মানে জম্বি হয়ে শ্বশুরবাড়িতে নাইওর গিয়েছে!!! অফিসে ফোন করে ক্রিসকে ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করে বললাম যে, বসরে বল আইজ আমি আইতে পারুম না, আমার ছুটি!!!! তারপর? তারপরে শুধুই পার্টি। বার-বি-কিউ পার্টি! মিস্টি খাওয়ার পার্টি!! কেউ কেউ তো রঙ্গীন পানীয় পানের পার্টিও ডেকে বসলো!!!
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
দুই স্বৈরাচার পতনের আন্দোলন খুব কাছে থেকে দেখার কারনে ভাবলাম, এদের মধ্যে একটু তুলনা করি। আমার অবজার্ভেশানে কিছু ইউনিক ব্যাপার নজরে এসেছে..........আপনারা চাইলে আরো কিছু যোগ করতে পারেন।
প্রথমতঃ এরশাদ পতনের আন্দোলন করে মুলতঃ রাজনৈতিক দল আর তাদের ছত্রছায়ায় থাকা ছাত্র সংগঠনগুলো। এখানে সাধারন জনগন পরবর্তীতে সম্পৃক্ত হলেও মূল নেতৃত্বে ছিল রাজনৈতিক নেতারা। আর হাসিনা পতনের আন্দোলন আক্ষরিক অর্থেই ছিল গণ-আন্দোলন। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এর নেতৃত্বে ছিল সাধারন ছাত্ররা আর সর্বস্তরের জনগনের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহন তো ছিল তুলনাহীন!!!
দ্বিতীয়তঃ হাসিনা পতনের আন্দোলনে নারীদের সম্পৃক্ততা ছিল অভূতপূর্ব। বাংলাদেশের নারীরা যে কতোটা ভয়ডরহীন, তা এই আন্দোলন না দেখলে আমার জানাই হতো না। এরশাদ খেদানোর সময়টাতেও মেয়েরা আন্দোলনে শামিল হয়েছিল, তবে তারা ছিল প্রধানতঃ ছাত্রী; আরো নির্দিষ্ট করে বললে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী।
তৃতীয়তঃ এরশাদ তার শাসনকালে আন্দোলন দমাতে বিভিন্ন পর্যায়ে যে হত্যাকান্ড-নির্যাতন চালিয়েছে, সেটা হাসিনার তুলনায় বলতে গেলে কিছুই না। হাসিনা তার শাসনামলে অগনিত সংখ্যায় গুম-খুন-নির্যাতন তো চালিয়েছিলই, শেষ পর্যায়ে এসে রীতিমতো গণহত্যা চালিয়েছিল। আর তার প্রবর্তিত ''আয়নাঘর'' তো ছিল হিটলারের কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্পের চাইতেও ভয়াবহ!!!
চতুর্থতঃ হাসিনা পতনের আন্দোলনে প্রবাসীদের অংশগ্রহন ছিল উল্লেখ করার মতো একটা বিষয়, যেটা এরশাদের সময়ে দেখা যায় নাই।
পঞ্চমতঃ হাসিনা বিরোধী আন্দোলনে প্রযুক্তির ব্যবহারের একটা বিশেষ ভূমিকা ছিল।
ষষ্ঠতঃ এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে আন্দোলনকারীদের মোকাবেলায় ছিল পুলিশ-বিডিআর-সেনাবাহিনী। হাসিনার বেলায় এই বাহিনীগুলো তো ছিলই, সাথে ছিল আমাদের দেশের গর্ব ছাত্রলীগ আর যুবলীগের বিশালসংখ্যক সোনার ছেলেরা।
সপ্তমতঃ এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে প্রতিরোধকারীদের মূল অস্ত্র ছিল ইট-পাটকেলের সাথে ককটেল আর কাটা রাইফেল। তুলনায় হাসিনা বিরোধী আন্দোলনে শুধুই ইট-পাটকেলের ব্যবহার ছিল। দুই ক্ষেত্রেই প্রথমদিকে সেনাবাহিনী স্বৈরাচারের পক্ষে থাকলেও পরে তাদের সমর্থন প্রত্যাহারের পরেই স্বৈরাচারের পতন হয়।
নিঃসন্দেহে ক্ষমতার লোভ আর পৈশাচিকতার দিক দিয়ে এরশাদ হাসিনার কাছে শিশু ছিল!!!!
সবশেষে দোয়া করি, বাংলাদেশের ইতিহাসে হাসিনাই যেন শেষ স্বৈরাচার হয়। আমার জীবদ্দশায় যেন আরেকটা স্বৈরাচার পতনের আন্দোলন দেখতে না হয়। একজন মানুষের লোভ আর লালসার কাছে দেশের সাধারন জনগনকে এভাবে বলি হতে দেখা শুধু অপরিসীম বেদনারই না, একই সঙ্গে এটা দেশকে পিছিয়ে দেয় কয়েক দশক। এখন থেকে অনওয়ার্ড আমরা শুধু দেশের এগিয়ে যাওয়াই দেখতে চাই, কারো জমিদারী কায়েমের কারনে পিছিয়ে যাওয়া নয়!!!!
স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশ আবার জেগে উঠবে নতুন প্রত্যাশায়..............জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে এটাই হোক আমাদের সবার একমাত্র লক্ষ্য!!!!!
পুনশ্চঃ
পোষ্টটা হাসিনার শ্বশুরবাড়ি গমনের দিনটাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য লেখা।
আমার এই পোষ্টটা জুলাই আন্দোলনের সকল শহীদ আর আহত যোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করছি। তাদের জন্য অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে প্রার্থনা। তাদের ত্যাগ ছাড়া এই অর্জন সম্ভব হতো না। আর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি আমার বন্ধু আর সহকর্মী ক্রিস এবং বস রিচার্ডের প্রতি, যাদের সক্রিয় সমর্থন আর সহযোগিতা না পেলে আন্দোলনের সময়গুলোতে আমার পেশাগত কাজে বিঘ্ন ঘটিয়ে এদিক-সেদিক সময় দেয়া একেবারেই অসম্ভব ছিল।
ফটোঃ নেট থেকে নিয়ে আমার খানিকটা ক্যারিকেচার করা।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই আগস্ট, ২০২৫ রাত ৮:৫৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


