somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মায়ের হাতে লাল রঙের চুড়ি

১১ ই জুন, ২০২১ রাত ২:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



মাহিনের মা অসুস্থ।
তিনি বিছানায় শুয়ে আছেন। মাহিন মায়ের মাথায় পানি ঢালছে। তার খুব মন খারাপ। মা অসুস্থ থাকলে তার ভালো লাগেনা। নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়। মা বলেছিল, 'ছোট ছেলেদের কথা আল্লাহ খুব মনযোগ দিয়ে শোনে। তাদের কথা ফিরিয়ে দেয়না।' মাহিন প্রতিরাতে মনে-মনে আল্লাহকে ডেকে বলে, "হে আল্লাহ, আমার মা ছাড়া আমার আর কেউ নেই। মা বলেছে বাবা নাকি দুরে কোথাও চলে গেছে। কিন্তু আমার মনে হয় বাবা মাকে ছেড়ে দিয়ে অন্য কোনো মহিলাকে বিয়ে করেছে। আমি মায়ের কাছেই থাকি। মা'ই আমার সব। আমার মাকে তুমি সুস্থ করে দাও।"
মাহিন অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে। সামনেই জেএসসি পরীক্ষা। এসময় ভালো করে পড়াশোনা করতে হয়। কিন্তু মাহিনের সেই সুযোগ হয়ে উঠছেনা। মা অসুস্থ থাকলে দুনিয়ার সবকিছু তার অসহ্য মনে হয়। পড়াশোনায় মন বসেনা। মাহিন মায়ের মাথায় পানি ঢালতে ঢালতে বলল, "এখন কেমন লাগছে মা?"
"ভালো লাগছে রে বাবা। তুই আর বসে থাকিস না। সামনে তোর পরীক্ষা। মন দিয়ে পড়াশোনা কর। আমি তোকে ডাক্তার বানাব।"
মাহিন পড়ার টেবিলে চলে আসে। ইংরেজী বই খুলে মেলে রাখে। কিন্তু তার পড়ায় মন বসেনা। টেন্স, সেনটেন্স, ভয়েস- সব তার মুখস্থ। তবু আজ সে ট্রান্সলেশন করতে পারছেনা। বারবার বইয়ের পাতায় অসুস্থ মায়ের করুণ মুখখানি ভেসে ওঠে। মাহিনের ভালো লাগেনা। সে বইয়ের পাতায় মুখ লুকিয়ে কাঁদে। চোখের পানিতে ভিজে যায় বইয়ের পৃষ্ঠা। তবু কান্না থামেনা।
মা অন্যের বাসাবাড়িতে ঝি-এর কাজ করে। একদিনে তিনটে বাসায় রান্নার কাজ করে। বাবাকে সে কখনো চোখে দেখেনি। মাহিনের বয়স যখন তিন বছর, তখন বাবা তাদের ছেড়ে চলে যায়। মা তাকে কোলেপিঠে করে এত বড় করেছে। নিজের কষ্টগুলো আড়াল করে রাখে। মাহিনকে কিছুই বুঝতে দেয়না। কিন্তু সে সব বুঝে। বোঝার মত বয়স হয়েছে তার। কোরবানীর ঈদে মা তাকে নতুন শার্টপ্যান্ট কিনে দিয়েছিল। মাহিন মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, "মাগো, তোমার নতুন শাড়ি কোথায়?"
মা বলেছিল, "আমার শাড়ি কিনতে হবেনা। আমি যেখানে কাজ করি ওখানের মানুষরা খুব ভালো। তারা ঈদের উপহার হিসেবে আমাকে নতুন শাড়ি দিয়েছে। এই দেখ।"
মা তাকে শাড়ি দেখায়। মাহিন বুঝে ফেলে মা মিথ্যা বলছে। এটা নতুন শাড়ি না। ওবাড়ির মহিলার পুরনো শাড়ি- যা আর পরা হবেনা- তা'ই মাকে দিয়েছে। সে যেন কষ্ট না পায় সেজন্য মা মিথ্যা কথা বলেছে। তবু মাহিন কিছু বলেনা। মাকে বলতে পারেনা- "মাগো, আমি এই নতুন শার্টপ্যান্ট পরব না। ওগুলো তুমি ফেরত দিয়ে তোমার জন্য নতুন শাড়ি নিয়ে আসো।"
এভাবে একমাস কেটে যায়। মা একটু সুস্থ হয়ে ওঠে তো আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে। কোনো দিন কাজ করে, আবার কোনো দিন করেনা। মাকে ডাক্তারের কাছে যেতে বললে মা বলে- 'ডাক্তারের কাছে গিয়ে কী হবে? আমি সুস্থ আছি তো।" মাহিন এবারো বুঝতে পারে মা তাকে আবার মিথ্যা কথা বলেছে। মায়ের কাছে টাকা নেই বলে মা ডাক্তারের কাছে যায়না। মাহিন তবুও কিছু বলতে পারেনা। মায়ের প্রতি অভিমান হয় খুব। তার মনে প্রশ্ন জাগে- 'মায়েরা এত মিথ্যাবাদী হয় কেন?'
মাহিনের পরীক্ষা চলছে। আর মাত্র একটা পরীক্ষা বাকি। তারপরই সে নবম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হবে। সে জানে ডাক্তার হতে হলে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করতে হয়। সে নাইনে উঠে বিজ্ঞান বিভাগে চলে যাবে। মা তাকে ডাক্তার বানানোর স্বপ্ন দেখে। মায়ের স্বপ্ন যে করেই হোক পূরণ করবে সে। মা ছাড়া যে তার কেউই নেই।
আজ মাহিনের পরীক্ষা শেষ হয়েছে। সবগুলোই ভীষণ ভালোভাবে দিয়েছে। মা তাকে বারবার বলেছে- 'বাবা, পরীক্ষার সময় মাথা ঠান্ডা রাখবি। কখনো অস্থির হবিনা। তাড়াহুড়ো করবিনা। আর কখনো ভয় পাবিনা। দেখবি, পরীক্ষা খুব ভালো হবে।"
মায়ের কথা মাহিন অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। এজন্য পরীক্ষাও খুব ভালো হয়েছে। এবার একটা ভালো ফলাফলের অপেক্ষা শুধু।
মাহিন আজ বেশ খুশি। মা তাকে পরীক্ষার সময় প্রতিদিন পঞ্চাশ টাকা করে দিত। মাহিন একদিনও খরচ করেনি। সবটাকা জমিয়ে রেখেছে। জমানো টাকা দিয়ে সে মায়ের জন্য লাল রঙের চুড়ি কিনেছে। মায়ের হাত সেই কবে থেকে খালি। মায়েদের হাতে চুড়ি না থাকলে তাকে মা বলে মনেই হয়না। মাহিন মনে মনে খুব অস্থির হয়ে পড়েছে। মা যখন চুড়িগুলো দেখবে তখন কতই না খুশি হবে! নিশ্চয়ই তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে দেবে। দৃশ্যটা কল্পনা করে তার চোখে পানি চলে আসে। মাহিন উত্তেজনায় আর থাকতে পারছেনা। সে দৌড়ে বাড়িতে চলে এলো।
মা বিছানায় শুয়ে আছে। মাহিনকে দেখেই তিনি উঠে বসেছেন। বললেন, "পরীক্ষা কেমন হলো বাবা?"
মাহিন উত্তেজনায় কথা বলতে পারছেনা। তার ঠোঁট কাঁপছে। বুক ঢিবঢিব করছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি হৃদপিণ্ডটা মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসবে। মাহিন কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, "ভা-ভালো হ-হয়েছে মা। ভা-ভাত খাব।"
মা বুঝতে পারলো মাহিন উত্তেজিত। তিনি বললেন, "কী হয়েছে তোর? কাঁপছিস কেন?"
"কি-কিছু হয়নি তো মা।"
"তাহলে এমন তোতলানো কথা বলছিস কেন?"
"জানিনা।"
"তোর হাতে কী এটা?"
মাহিন আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলোনা। খবরের কাগজ দিয়ে মোড়ানো লাল রঙের চুড়িগুলো মায়ের হাতে দিয়ে বলল, "তোমার জন্য চুড়ি এনেছি মা। তুমি পরীক্ষার সময় যে টাকাগুলো দিতে তা জমিয়ে চুড়ি কিনেছি। নতুন চুড়ি। সূর্য্যের আলোয় চকচক করে।"
মা অবাক হয়ে গেলেন ছেলের এমন কান্ড দেখে। তিনি চুড়িগুলো হাতে নিলেন। খবরের কাগজগুলো ছিঁড়ে ফেললেন। তারপর দেখা গেলো লাল রঙের একডজন নতুন চুড়ি। মা চুড়িগুলো হাতে নিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। এতবেশি অবাক হয়েছেন যে কোনো কথা বলতে পারছেন না।
মাহিন বলল, "মা, তোমার হাতে চুড়ি নেই দেখে আমার ভালো লাগেনা। তাই এনেছি। এসো, আমি তোমায় চুড়িগুলো পরিয়ে দিই।"
এই বলে মাহিন মায়ের হাত থেকে চুড়িগুলো নিল। তারপর ছয়টা ছয়টা করে দু'হাতে বারোটা চুড়ি পরিয়ে দিল। মা কিছু বলতে পারছেন না। তিনি হতভম্বের মত ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন।
মাহিন বলল, "মা, জানালা খুলে বাইরে হাত রাখো। দেখবে সূর্য্যের আলোয় কেমন চকচক করে।"
মা জানালা খুললেন না। মাহিনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। কাঁদতে-কাঁদতে বললেন, "আল্লাহ তোরে অনেক বড় করুক বাবা। তুই অনেক বছর বেঁচে থাকবি। আমার মাথায় যতগুলো চুল আছে ততগুলো বছর তুই বেঁচে থাকবি।"
মাহিন কিছু বলতে পারলো না। মায়ের কান্না দেখে সেও বাচ্চাদের মত ভেউ-ভেউ করে কেঁদে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতেই মায়ের হাতের দিকে তাকালো। মায়ের হাতে লাল রঙের চুড়ি। ইশ, কী সুন্দর!


বিবাগী শাকিল
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুন, ২০২১ রাত ২:০৪
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×