আন্তর্জাতিক খ্যাতি সমপন্ন সংবাদ পত্র বৃটেনের গার্ডিয়ানে প্রকাশিত সুচির একটি মুখাবয়ব
https://www.theguardian.com/world/2017/sep/13/aung-san-suu-kyi-myanmar-icon-rohingya
রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার আন্তর্জাতিক ভাবে কতটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে নিরাপত্তা পরিষদে এ সংক্রান্ত সর্বশেষ বৈঠকটি হয়ে যাওয়ার পরে। যদিও চীন জোরালো ভাষায় মিয়ানমারের প্রতি আন্তর্জাতিক কমিউনিটির সমর্থন চেয়েছে কিন্তু তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে । ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ব্রিটেনের ভূমিকা ছিল বলিষ্ট । নিপীড়িত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজনে ব্রিটেন মিয়ানমারের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করতেও পিছপা হবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। এখানেই বোধকরি গণতান্ত্রিক ইউরোপ আর একদলীয় চীনের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য। কিন্তু চীন কেন মিয়ানমারের এই বর্বরতায় সঙ্গী হচ্ছে তা ব্যাখ্যা করার জন্য আমাদেরকে খুব বেশী পিছনে যেতে হবেনা । আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের দোসর ও ১৯৭২ সালের ২১ আগস্ট জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদের বিরুদ্ধে চীনের ভেটো দেয়ার কথা কি সহজে ভুলা যায় । যাহোক, অনেক ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে চীন এখন বাংলাদেশের একটি অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী দেশ , চীনের সাথে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্য নীজেদের স্বার্থ অক্ষুন্ন রেখে যতটুকু প্রয়োজন ততোটুকু রাজনীতি বাংলাদেশকে তো করতেই হবে ।
তাদেরকে ভবিষ্যত ভোটব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশেই রেখে দেয়ার চেষ্টা করবে এবং (৩) যেহেতু বাংলাদেশে চীনপন্থী রাজনীতির একটি শক্তিবলয় আছে, তারা চীনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা-নিধন যজ্ঞে টু-শব্দটি করবে না। ফলে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার পড়বে বড় ধরনের বিপদে, তারা কোন দিক সামলাবে তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে আর এর ফাঁকে মিয়ানমার তাদের কাংক্ষিত রোহিঙ্গা নিধন কর্মটি শেষ করে ফেলতে পারবে। কিন্তু বাংলাদেশের শেখ হাসিনা সরকার বিষয়টিকে যে অতি দ্রুত একটি আন্তর্জাতিক ‘ইস্যু’ বানিয়ে ফেলতে সক্ষম হবে সেটি মিয়ানমার ভেবে থাকলেও তার পরিণতি সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলনা । মাত্র দিন কয়েক আগে মোদির মিয়ানমার সফরে সুচির সাথে আলোচনার পর ভারত যে এমন একটি ইউটার্ণ দিবে তা মিয়ানমার ভাবতে পারেনি আগে । গতকাল ১৫ সেপ্টেম্বর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যা, ধর্ষণ এবং অমানবিক নির্যাতনের হাত থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা মুসলমানদের ইস্যুতে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে বলে জানিয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। গত ১৫ ই সেপ্টেম্বর রাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এক ফোনালাপকালে এ সমর্থনের কথা জানান সুষমা স্বরাজ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ফোনালাপকালে সুষমা স্বরাজ জানান রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধ ও বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে দেশটির প্রতি দ্বিপাক্ষিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করছে ভারত সরকার। রোহিঙ্গা সমস্যা শুধু বাংলাদেশের নয়, এটি এখন আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক সমস্যায় রুপ নিয়েছে। সংবাদ সুত্র : https://www.corporatesangbad.com/newsid/93279
রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের পর রাশিয়া মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান নিয়ে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করতে অন্য দেশগুলোর প্রতি আহবান জানালেও ঘর-বাড়ি ছাড়া মানুষদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার পদক্ষেপ নিচ্ছে বলেও জানিয়েছেন । গত ১৫ ই সেপ্টেম্বর শুক্রবার রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নারী মুখপাত্র মারিয়া জাকারভ এমনই কথা বলেছেন । ঘরবাড়ী ছাড়া রোহিঙ্গাদেরকে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য মিয়ানমারের প্রতি কুটনৈতিক চাপ যে বাড়ছে তা বুঝাই যায় ।
মিয়ানমার বিষয়ে আন্তর্জাতিক মেরুকরণ কোন দিকে গড়াচ্ছে তা বুঝতে বিশেষ অসুবিধা হ ওয়ার কথা না । একদিকে চীন - রাশিয়া আর দিকে বৃটেন সহ ইউরোপিয় ইউনিয়ন , সৌদী , তুরস্ক , ভারত , আমিরকা এবং তার ঘনিষ্ট মিত্ররা কোন দিকে যাবে সেটা বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয় । মিয়ানমারের কাধে ভর করে চীনের এ অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার কর্ম প্রচেষ্টা তার বিপক্ষ গ্রুপ কিভাবে নিবে সেটা বুঝতে বেশী জ্ঞানের প্রয়োজন পরেনা । অতএব মিয়ানমারের হেলিকপটটারের পাখার ঝাপটানী দেখে যারা পুলকিত হচ্চেন তারা বিষয়টা আরো একটু গভীরে গিয়ে দেখতে পারেন । এ জন্যেই লোকে বলে পিপিলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে ।
আবার আসন্ন জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা ইস্যুটি তোলার ঘোষণা দেয়ার পর পরই মিয়ামনারের নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী নেত্রী আউং সাং সুচি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে এবার না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন, কারণ তিনি সেখানে গেলেই এবার তাকে ভয়ঙ্কর সব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। কিন্তু এভাবে পালিয়ে তিনি আসলেই কি বাঁচতে পারবেন ?
মিয়ানমার থেকে ভয়াবহ নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিয়ে যে এদেশে রাজনীতি হবে বা অতীতেও হয়েছে তা নতুন করে বলার বিষয় নয়। বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকলে আজকে রাজনীতিটা অন্যরকম হতো তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু যেহেতু তারা এখন বিরোধী দলে সেহেতু তারা বার বার রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতার কথা বলছে, তাদের সময়ে রোহিঙ্গা বিষয়ে কুটনৈতিক সফলতাতো আরো বড় প্রশ্নবাণে জর্জড়িত । এছাড়া আজ অবধি তাদের কোন নেতার পক্ষে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গিয়ে তাদের দুর্দশা স্বচক্ষে দেখার সময় ও সুযোগ হয়নি বলেই দেখা যায় । বিএনপি নেত্রী তার দলের ভাইস চেয়ারম্যান স্বাক্ষরিত একটি বিবৃতি দিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছেন । সম্ভবত চীন ও সৌদি আরবের কথা বিবেচনায় নিয়ে তিনি বেশী কিছু বলছেন না । চীন ও সৌদির সাথে বর্তমান সরকারেরও সম্পর্ক এখন ভাল , ধন্যবাদ দিতে হয় বিএনপিকে তারা পানি বেশী ঘোলা করছেন না ।
অপর দিকে রোহিঙ্গাদের জন্য আশ্রয় কেন্দ্র পরিদর্শন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন বাংলাদেশ মানবিক দিক বিবেচনা করে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু মিয়ানমারকে অবশ্যই রোহিঙ্গাদের সেদেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে নিয়ে তাদেরকে ফেরত নিতে হবে, এ প্রশ্নে বিশ্বের সকলেই একমত ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন রোহিঙ্গাদের অস্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য জায়গা করে দেয়া হয়েছে কিন্তু তাদের দীর্ঘমেয়াদী রাখা অবশ্যই বাংলাদেশের জন্য একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। তিনি জানান দেশের সাধারণ জনগন ও সরকারের প্রশাসন রোহিঙ্গাদের আশ্রয়, খাদ্য ও চিকিৎসা দেওয়ার জন্য দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন । এ সমস্ত কার্যক্রম এখন বিশ্ববাসীর প্রসংসা কুড়াচ্ছে ।
তবে একটি কথা থেকেই যায় তা হল বাংলাদেশের ওপর এত বড় একটি বিপদ নেমে এসেছে, তাও প্রতিবেশী দেশের কাছ থেকে, এত বড় একটি ভয়াবহ বন্যা কাটাল বাংলাদেশ, আর এই সময় বাংলাদেশের একটি বড় রাজনৈতিক দলের নেত্রীর মাসের পর মাস লন্ডনে পড়ে রয়েছেন, বাংলাদেশ বলেই এরকম একটি জাতিয় দুর্যুগময় সময়ে একটি বড় রাজনৈতিক দলের এমন রাজনীতি এদেশের মানুষকে সহ্য করতে হয়, অন্য কোন দেশ হলে এমন কর্মের জন্য তাদেরকে জনগনের কাছে জবাবদিহী করতে হত এতক্ষনে । খবরে দেখা গেল তাদের একটি ত্রান বহরে বাধা দান করায় তারা নীজদেকে গুটিয়ে নিয়েছেন , মাঝায় এত কম জোর নিয়ে কি রাজনীতি চলে, জনগন সাথে থাকলে এর থেকেও অনেক বড় বাধাকে অতিক্রম করা যায় , এর ভুরি ভুরি প্রমান রয়েছে অতীতে ।
মিয়ানমার থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে নিয়ে, আন্তর্জাতিক রাজনীতি প্রসঙ্গে আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে তাদেরকে নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে থাকা কিছু সুযোগ সন্ধানী রাজনৈতিক পক্ষগুলোর চেহারাও উন্মুক্ত হয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে । অবস্থা দেখে বুঝা যাচ্ছে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারীরা দিশাহারা হয়ে পড়ছে । নিত্য নতুন প্রোপাগান্ডার সচিত্র কৌশল প্রয়োগ করছে বিভিন্ন সামাজিক মিডিয়াতে । তবে ভবিষ্যতে যারা এদেশে রোহিঙ্গা-রাজনীতি করতে আসবেন তাদেরকে জনগণ চিহ্নিত ও প্রতিহত করতে পারবেন সহজেই । আজকে এই সত্যও উন্মোচিত যে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে এদেশের চীনপন্থীরা হয় নিশ্চুপ, নয় তাদের সেই পুরনো ইসলাম কার্ড খেলছেন আর চীনপন্থী রাজনীতিবিদগন রোহিঙ্গা ইস্যুতে দেশের মাঠ গরম রাখছেন সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতার ধোঁয়া তুলে । ক্ষমতার মসনদে আসীন হওয়ার জন্য দেশে বিদেশে বিভিন্ন কুটনৈতিকদের কাছে তারা যে পরিমাণ মাথা কুটেছেন অতীতে সেরকম একশতাংশও যদি তারা করতেন তাহলেও দেশের জনগন কিছুটা হলেও আশ্বস্ত হতো রোহিঙ্গা ইস্যুতে । দেশের প্রয়োজনের সময় দলমতের উর্ধে উঠে তিনবারের প্রধানমন্ত্রী দেশের একটি বড় রাজনৈতিক দলের নেত্রী সোচ্চার ভুমিকা পালন করবেন এটা জাতি আশা করতেই পারে , এখানে ছোতোনাতু অভিযোগ তুলে পিছনে পড়ে থাকা কোন মতেই কাম্য নয় । সরকারের ব্যর্থতার কথা বলার পাশাপাশি নীজেদের কথা তুলে ধরে সে অনুযায়ী গঠণমুলক কর্মপস্থা গ্রহন করাই অধিক যুক্তিযুক্ত । ঘরবাড়ী হতে বিতারিত নির্যাতিত রোহিঙ্গাদেরকে তার নীজ দেশে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য মিয়ানমাররের উপর অআন্তর্জাতিক কুটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে প্রয়োজনীয় নিরাপদ পরিবেশ তৈরী করার লক্ষ্যে দেশবাসীর ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের কোন বিকল্প নেই । দেশবাসী এ বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকলে কোন শক্তিই রোহিঙ্গাদেরকে নীজ দেশে ফিরে যাওয়া হতে বিরত রাখতে পারবেনা ।
রোহিঙ্গা ইস্যুটি নিয়ে কার কি উদ্দেশ্য সেটা পরিস্কারভাবে ধরা পরে প্রোপাগান্ডার স্টাইল তথা খোদ বাংলাদেশকেই কটাক্ষ করে মহল বিশেষের বলা কথাবার্তার ধরণ দেখে, যার নমুনা দেখা যাচ্ছে কিছু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ফেসবুকে ।
যাহোক, মোদ্দা কথা হল রোহিঙ্গা ইস্যুতে এই মহুর্তে জাতির ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন । ছোট খাট কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে তিলকে তাল না বানিয়ে প্রোপাগান্ডামুলক তথ্য পরিবেশন না করে, রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে জাতিকে বিভক্ত করা পুর্বক রোহিঙ্গাদের আশ্রয় কর্মকান্ডকে প্রলম্বিত না করে তাদেরকে নীজ দেশে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখাই হবে এখনকার সময়ের কাজ ।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে অক্টোবর, ২০১৭ রাত ২:৪৯