ছবি : নিজের তোলা
যাত্রা শুরুর গল্প
জাবেদ ভাইয়ের কাছে পড়া শেষে মাত্র বের হব। এরই মধ্যে ভাইয়ের কাছে পড়ে আর বান্ধবীদের সাথে আড্ডা মেরে সব ভুলে গেছি। ঠিক সেই সময়েই বাবা ফোন দিয়ে বলে, কিরে তুই কই? রেডি হইসোস??? তখন বাজে দুপুর ২ টা, আমি ভাইয়ের কাছে আসছি পড়তে আর বাবা বলে আমি রেডি কিনা! হায় আল্লাহ্! প্ল্যান ছিল আমি ব্যাগ গুছিয়ে বিকাল ৫ টায় বাবাদের বাসায় চলে যাবো আর সেখান থেকে ৬ টার মধ্যে রওনা দিব। গিয়ে পৌঁছাব সদরঘাট এবং সেখান থেকে লঞ্চে করে যাত্রা শুরু করব শরীয়তপুরের উদ্দেশ্যে! সারা রাতের জার্নি এবং সকালবেলা সেখানে পৌঁছাব এই রূপ প্ল্যানের কারণ আমার ছোট চাচী কখনোই বাস কিংবা গাড়িতে করে কোথাও যেতে পারেন না। উনি একদম সিরিয়াস অসুস্থ হয়ে যান এবং লঞ্চে করে আমি কখনোই কোথাও যায়নি, এমনকি ঢাকার বাইরেও আমার তেমন একটা কোথাও যাওয়া হয়নি। শুধুমাত্র সিলেট ছাড়া। সেখানে আমার এক খালাতো বোন থাকেন। প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার পর আমি প্রায় সাত বছর পর ঢাকার বাইরে গ্রামের কোন পরিবেশে বেড়াতে গিয়েছিলাম! এরপর থেকে আমার তেমন কোথাও বেশি একটা যাওয়া হয়নি।যদিও তখন আব্বা আম্মার সাথে প্রায় চার দিনের জন্য বেড়াতে গিয়েছিলাম কিন্তু সে সময়টাও ছিল বেশ মনে রাখার মত! যাইহোক মূল কথায় ফিরে আসি। প্ল্যান অনুযায়ী সময়টা চেঞ্জ হওয়ায় এবং বাবার ফোনে আমি কিছুটা অবাক হয়ে গিয়েছিলাম!
তারপর আমি বললাম- না, আমিতো এখনো রেডি হইনি।
- তোরে কি খালি খালি বকা দেই?
- তোমরা এক সপ্তাহের জন্য যাবা আমি এতদিন কেমনে থাকবো!!
তখন বাবা আমাকে বললেন," প্ল্যান একটু চেঞ্জ হয়েছে। আজ আমার একটা জরুরী কাজ পড়ে গেছে। তো আজ রাতে নয় আগামীকাল শুক্রবার রাতে আমরা রওনা হব এবং শনিবার সকালে গিয়ে সেখানে পৌঁছাব। এখনো তোর কাছে একদিন সময় বাকি আছে।চিন্তা করে তারপরে বল তুই যাবি কিনা?"
এই কথা শুনে মনের অজান্তেই যেন আমি একদম ফুল রিচার্জ হয়ে বাবাকে বললাম তার মানে একদিন কমে গেল!! মাত্র ৬ দিন থাকবে তোমরা!!
বাবা বলছেন হ্যাঁ আগামী শুক্রবার ইনশাআল্লাহ আমরা ঢাকায় থাকবো।
তারপরও অনেক কনফিউজড আমি যাব কিনা ৬ দিনের জন্যে। তারপর আমি বাবাকে বললাম আচ্ছা ঠিক আছে বাসায় গিয়ে দেখি তারপর তোমাকে জানাচ্ছি আজ রাতের মধ্যে. .
তারপর আমি বাসায় গিয়ে মাত্র ঢুকছি ঠিক সেই সময় আব্বু আমাকে বলতেছেন তোর মেজ চাচা চাচিও যাবেন তোর ছোট বাবার সাথে শরীয়তপুর! খবরটা পেয়ে যেন আমি আরো উজ্জীবিত হয়ে গেলাম!! খুশির ঠেলায় এক লাফ দিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে আব্বুকে বলতেছিলাম, এ্য্য্য্য্য.... আমিও যাবোওওওও.....!!! তখন আব্বা আম্মা দুজনে একসাথে বলে উঠলেন যা, তোকে তো আমরা যেতেই বলতেছি, মানা তো করিনি . . তুই নিজেই তো যেতে চাচ্ছিস না. . . ওখানে এই আছে সেই আছে... আলীর(আমার ছোট চাচা) বিয়ের পরে গিয়েছিলাম ইত্যাদি ইত্যাদি...
এখন যাওয়ার জন্য মন উড়ু উড়ু করতে শুরু করল। কারণ ছোট চাচা মেজ চাচা একসাথে যাওয়া মানেই দুই চাচী আমার সাথে থাকবেন এবং গুড়া-গাড়ি মিলে ভাই বোন আমরা মোট পাঁচজন!!সো আনলিমিটেড ফান এন্ড এঞ্জয়!!!
ঘরে ঢুকে আমি তারপরও ভাবছি আমি যাব কিনা যাব-যাব না ,যাব-যাব না... এই আমার চলছেই। তারপর সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজের পর ঠিক সাতটার দিকে বাবা বাসায় আসলেন আব্বার সাথে কথা বলতে। আব্বু তখন বাইরে যাবেন। বলেন ভাই বসেন কথা আছে। তারপর হাসতে হাসতে আমাকে ২-৪ টা বকা দিয়ে বলতেছেন তুই ভালোমতো বল তুই যাবি কি যাবিনা। পরে আব্বু বলতেছে খোকন(মেজ চাচা) যাবে শুনে খুশিতে লাফায় উঠতেছে এখন বলতেছে যাবে!! এরপরে দুএক দফা আমার এই কনফিউশনের গুনগান গাইলেই ভাবী দেবর মিলে তার পর বাবা আর আব্বা মিলে আমার ছোট ট্রলিটা বের করে দিয়ে সেটার একটা ভাঙ্গা চাকা ঠিক করে দিতে লাগলেন আর এইদিকে আমি তো খুশি!! একটা সময় চা খেয়ে বাবা এবং আব্বু বাইরে চলে গেলেন।
রাত নয়টা দশটা বেজে গেল মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি যাব কিন্তু তারপরও আমার মনের দ্বিধা যেন সরতেই চাচ্ছে না!! এই দ্বিধাদ্বন্দেই রাত এগারোটা বেজে গেল!! রাতের খাবার কমপ্লিট এবং আমি দ্বিধাদ্বন্দ নিয়ে মায়ের সাথে ব্যাগ গোছাতে শুরু করলাম! এদিকে লেগে আছে সর্দি, রাতে ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে গেলাম। সকালে ঘুম ঘুম চোখে উঠে ব্রেকফাস্ট সেরে ওষুধ খেয়ে আবারও ঘুম!! শরীরে হালকা জ্বর জ্বর ভাব। এই অবস্থাতেই মাকে কিছু কাজ গুছিয়ে দিয়ে যাচ্ছি যেন যে কয়দিন বাসায় না থাকবো সে কয়দিন আমার মায়ের কোন কিছুতে অসুবিধা না হয়। দুপুর বেলা যখন কাজ সেরে ফ্রেশ হলাম তখন অনুভব করলাম জ্বর মোটামুটি আমার গায়ে জেকে বসেছে এবং ঠান্ডা বেড়ে গেছে। নিজেকে সুস্থ করার জন্য দুপুরে ওষুধ খেয়ে এক প্রকার জোড় করেই ঘুমালাম। ওষুধ খাওয়ার কারণে ঘুম বেশি পাচ্ছিল। এপাশ-ওপাশ করে শুয়ে মাত্র ১৫ মিনিটে পাওয়ার নেপ নিয়ে যখন বিকাল ৪ঃ০০ টার দিকে উঠলাম তখন অনুভব করলাম গায়ে জ্বর এখনো হালকা আছে। এখনই রেডি হয়ে ও বাড়িতে চলে যাওয়ার কথা কিন্তু আমার কোন কিছুই যেন ভালো লাগছে না। দ্বিধাদ্বন্দ্ব এখনো কাজ করছে অসুস্থতার জন্য। এদিকে আমার মা আমাকে নিয়ে একটু টেনশনে পড়ে গেছেন আবার এও বলছেন যদি সেখানে যাস তাহলে মনটা ভালো হয়ে যেতে পারে। পরে তখন আর এই ঠান্ডা জ্বর থাকবে না। ঠিক এই সময় বাবার ফোন কিরে তুই এখনো আসিস নি কেন ? বললাম বাবা আমি তো আসতাম কিন্তু আমার এখন জ্বর এসে গেছে। কি করব বুঝতে পারছি না। বাবা তখন হেসে আমাকে বলল তুই এখন কি করতে চাস বলতো? তোর নিয়তটা কি? আমি একদম সহজ ভাবে বললাম বাবা আমি তো আসার জন্য ব্যাগও গুছিয়েছি। শুধুমাত্র রেডি হয়ে চলে আসবো কিন্তু আমার যে হালকা হালকা জ্বর এবং ঠান্ডা! এটাই ভাবছি ওখানে গিয়ে আবার না অসুস্থ হয়ে যাই। বাবা আমারে বলে ব্যাগ গুছিয়ে সব কিছু রেডি মানে তুই এখন খালি আয়, জ্বরের গুল্লি মারি! অসুখ হলে দেখা যাবে!! আমি আবারও খুশিতে টগবগিয়ে উঠলাম!! হ্যাঁ, যা হবে দেখা যাবে!!
রেডি হয়ে 5 মিনিটেই আব্বাকে নিয়ে চলে গেলাম বাবাদের বাড়িতে। ঘরে ঢুকতেই আমার মেজ চাচা আমাকে দেখেও না দেখার ভান করে ছোট চাচাকে বলতেছেন মাগো মা!! সুইটি মনে হয় আজকে আর আসবেই না। ওর আম্মা মনে হয় কান্নাকাটি শুরু করে দিছে। এই কথা শুনে এই ঘর ওই ঘরের সবাই একজোট হয়ে হাসতে শুরু করলাম। আমার চাচীরা হাসতেছেন এবং ভাই বোনেরা কাছে এসে হাসতে হাসতে বলল তুমি ফাইনালি আসছো!!! মুহূর্তেই যেন ঘরটা চাঙ্গা হয়ে গেল!! আমিও আমার ঠান্ডা জ্বর ভুলে গেলাম নিমিষেই। আব্বা এবং বাবারা ড্রয়িং রুমে বসে গল্প করছেন আর এদিকে কাচ্চাবচ্চা সমেত আমার চাচীরাও রেডি হচ্ছেন। আমরা ভাইবোনেরা বসে গল্প করছিলাম।অবশেষে সবকিছু ঠিকঠাক করে বাড়িঘর তালা দিয়ে আমরা ঘর থেকে বের হলাম রাত ৮ঃ০০ টায়। কাচ্চা বাচ্চা সমেত মানুষ আমরা মোট ৯ জন এবং হাতির মত মোটা মোটা ব্যাগ ছয়টা!! আমার নিজের একটা ছোট ট্রলি, বোনের নিজস্ব বিশালাকার স্কুল ব্যাগ, ছোট মা আর ছোট
ভাই ফাহিমের জন্য একটা মস্ত বড় ট্রলি, ছোটবাবার আলাদা একটা মিডিয়াম সাইজের ব্যাগ, মেঝো মা আর মেজ বাবার আলাদাই বড় একটা ট্রলি, গুরা দুইটা ভাই বোনের জন্যই আলাদা মিডিয়াম সাইজের একটা ব্যাগ, আর আমাদের লেডিসদের আলাদা আলাদা পার্সের হিসাব তো বাদই দিলাম। অবস্থাটা এমন ব্যাগের সাইজ এবং সংখ্যা দেখে মনে হইতেছে বাড়িঘর ছেড়ে চিরতরে চলে যাচ্ছি দূর দেশে!! এসব প্রয়োজনে জিনিসপত্র বাড়তি তেমন ছিলনা।
বাসার নিচে গাড়িতে করে রওনা দিলাম সদরঘাটের উদ্দেশ্যে। আমি চলে গেলাম মেজো বাবা এবং মেজ মায়ের সাথে , যাবার সময় একটা হৈ হৈ রৈ রৈ ভাব। রাস্তা ফাঁকা. . মনের ভিতরটা আমার ঢিপ ঢিপ করতেছে! না জানি কখন আবার মেজ মা আর পুচকি বোনটা ওয়াক করে দেয়! দুই চাচী আর দুই বোন গুলোকে নিয়ে এই একটা ঝামেলা!! এদের জন্য কোন জায়গায় গাড়িতে করে যাওয়া যায় না!! দূরের পথ হলে তো কথাই নেই একেক টারে নিয়ে টানাটানি করা লাগে। এজন্যই লঞ্চের ব্যবস্থা!! নয়টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম সদরঘাট। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সবাই একত্রিত হয়ে একসাথে এন্টার করলাম ভিতরে। আমার নিজের ট্রলি শুধুমাত্র বাসা থেকে বাবাদের বাসা পর্যন্ত টানতে হয়েছে। এরপরে আমার ব্যাগ চলে গেছে আমার ছোট ভাই ফাহিম এবং বোন অর্নির তত্ত্বাবধানে। আমার ছোট বোনটার অবস্থা তো সেই লেভেলের হাস্যকর ছিল! পিছনে দুকাঁধে ভর করে ঝুলছে তার বিশাল আকার স্কুল ব্যাগ,ডান দিক থেকে বাঁ দিকের তীর্যক হয়ে পাশে ঝুলছে তার ছোট্ট ব্ল্যাক পার্স , এবং ডান হাতে আমার ট্রলি নিয়ে সেই সোয়্যাগ নিয়ে হেটে যাচ্ছে। ওর অবস্থাটা দেখে পিছন থেকে ফাহিম আর আমি হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাইতেছি। আমার মুখে মাস্ক থাকার কারণে হাসিটা এত বেশি বোঝা যায়নি। একমাত্র আমি ছাড়া প্রত্যেকের হাতেই একটা করে ব্যাগ না হয় পুচকি দুইটা ভাই বোনের যেকোনো একজন। গাট্টি বস্তা সমেত একটা রাজকীয় রাজকীয় ভাব নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি!! মানুষজন আমাদের ফিটফাট অবস্থা দেখে হা করে তাকায় আছে। বোঝাই যাচ্ছে খুব সহজে ফ্যামিলি ট্রিপ. . !!!
ছবি: ভিডিও থেকে স্ক্রিনশট নিয়ে
ঘাট থেকে চওড়া কাঠে ভর করে এন্টার করলাম লঞ্চের ভিতর. . আগে থেকে সবকিছু ঠিকঠাক করা ছিল লোক এসে টিকিট আর কেবিনের চাবি দিয়ে গেল বাবার হাতে . . সোজা চলে গেলাম দোতলায় ১৬ এবং ১৭ নম্বর কেবিন রুমে. . ১৭ নম্বর রুমটা মেজো চাচাদের. . নিজেদের সব ব্যাগ পত্র রেখে সবাই এসে ১৬ নম্বর কেবিনে বসলাম. . আর বাবারা গেলেন রাতের খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করতে. . কিছুক্ষণ পরে বাবারা রাতের খাবার অর্ডার দিয়ে এবং হাতে করে পানির বোতল আর বেশ কিছু স্নাক্স নিয়ে ফিরে আসলেন. . এবার আমরা কেবিন থেকে বের হলাম এবং বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাহিরের দৃশ্য উপভোগ করছিলাম. . . ঘাটে কিভাবে মানুষজন চলাফেরা করছে, যাত্রী কিভাবে লঞ্চে এন্টার করছে, পাশের লঞ্চের অবস্থা, কোন লঞ্চ কোথায় যায় সবকিছুর চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে নেমে পড়লাম আমরা তিন ভাই বোন বারান্দায় দাঁড়িয়ে. . আর ওইদিকে পিচ্চি দুইটা তো ড্যাপড্যাপ করে তাকিয়ে খালি এদিক ওদিক দেখে . . . অন্ধকারে বুড়িগঙ্গার ভিউটা দেখতে খারাপ লাগছিল না। আশেপাশে লাইটিং ছিল অনেক। এর ই মধ্যে মোমেন্টগুলোকে ভিডিওতে বন্দি করে নিলাম! ফিরে এলাম কেবিনে। চলছে নাস্তা, গল্প গুজব আর ভিডিও কল। লঞ্চ ছাড়বে রাত সাড়ে দশটায়। এখন শুধু লঞ্চ ছাড়ার অপেক্ষা!
(যাত্রা শুরুর গল্প এ পর্যন্তই, এর পরের পর্ব "গন্তব্যের উদ্দেশ্যে" শীঘ্রই প্রকাশ করা হবে। সাথে থাকুন। সবাইকে ধন্যবাদ)
- দেয়ালিকা বিপাশা