গোধুলী বেলায় দলবেঁধে ঘরে ফেরা দোয়েল-কোয়েল-বাবুই পাখির ঝাঁক আর চোখে পড়ে না। কাশবনে কিচির মিচির শব্দও আর শোনা যায় না, বসন্তকালে কোকিলের কুহু কুহু গানও আর সেরকম শোনা যায় না। অপরুপ সৌন্দর্য্যরে বাংলার প্রকৃতি মাতিয়ে রাখতো দোয়েল, কোয়েল, শালিক, ময়না ও বাবুই পাখির কলতান। কিন্তু এসব চিত্র এখন বিরল।
আবহাওয়া ও জলবায়ু পরির্তণ, বাসযোগ্য বৃক্ষ নিধন, খ্যাদ্য সংকট, ফসলী জমিতে অতিমাত্রায় রাসায়নিক স্যার ও কিটনাশক ব্যবহার, প্রাকৃতিক দূর্যোগ এবং পাখি নিধনকারীদের তান্ডবে বিলুপ্তির পথে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের বাহক নানা প্রকার পাখি। পাখিদের জন্য অনকুল পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং গ্রাম বাংলার হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে নানা প্রচেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে পাখি প্রেমিকরা।
এরই একটি ব্যতিক্রমী চিত্র দেখা গেছে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার বেলতৈল ইউনিয়নের আগনুকালী নামক গ্রামে। পাখি প্রেমিক মামুন বিশ্বাস ও ইমনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এ গ্রামটিতে ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে পাখির অভয়াশ্রম। নিজ অর্থায়নে আরো ৪/৫ পাখি প্রেমিকের সহায়তায় তিনি পাখিদের জন্য ঘর-সংসার গড়ে দিচ্ছেন। গত ৪ মাসে ৩৫০টি গাছে মাটির কলস বেঁধে দিয়েছেন। দেশীয় পাখিগুলো যাতে ওই কলসীতে নিজ নিজ আশ্রয় খুঁজে নেয়। ইতিমধ্যে এ কাজে বেশ সফলতা অর্জন করেছেন তারা। বেশ কয়েকটি মাটির কলসীতে পাখিরাও এসে আশ্রয় নিয়েছে। প্রজনন প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। মামুন ও ইমনের অক্লান্ত পরিশ্রমে তাদের এই সাফল্যে গ্রামবাসীসহ আশপাশের লোকজন মুগ্ধ হয়ে পড়েছে।
সরেজমিন ঘুরে উদ্যোক্তা ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, রাস্তার ধারে, পুকুরের পাড়ে, জমির পাশে, বিভিন্ন বাসা বাড়ীর গাছের ডালসহ গ্রামটির আনাচে কানাচের বিভিন্ন গাছের মগডালে কলসী বেঁধে দেয়া হয়েছে। ফলে এ গ্রামটি এখন পাখিদের অভয়াশ্রমে পরিণত হয়েছে। এছাড়াও আশপাশের লিছিমপুর, রায়পাড়া, সিকদার পাড়া, মধ্যপাড়া, সাতবাড়ীয়া, ভেন্নাগাছি, লক্ষীপুরসহ ১০টি গ্রামকেও এর আওতায় এনে গাছে কলসী সেট করার প্রক্রিয়া চলছে।
এ গ্রামের যুবক শাহীন আলম জানান, প্রথম দিকে মামুন ও ইমনকে গ্রামবাসী পাগল বললেও এখন সকলেই এ কাজে উৎসাহ দিয়ে নানাভাবে সহযোগীতা অব্যাহত রেখেছে।
সুজন ও নবী জানান, মাটির কলসীগুলোতে শালিক পাখি বাসা বেঁধেছে, বেশ কয়টিতে বাচ্চা ফুটেও বের হয়েছে। তবে অন্য প্রজাতির পাখিদের মধ্যে দোয়েল পাখি ওই কলসীগুলোতে যাতায়াত করলেও স্থায়ীভাবে বাস করছে না।
একই গ্রামের যুবক কামরুল জানান, প্রথমে মামুন তার নিজ বাড়ির গাছে পাচটি কলস বাঁধেন। কিছুদিন যেতেই এসব কলসে আশ্রয় নেয় শালিক পাখি। মামুন আর ইমন অবাক হয়ে দেখতে থাকেন পাখিদের ঘর-সংসার, বংশবৃদ্ধি। নিজেদের সাফল্যে মুগ্ধ হন এ দুইজন। এরপর শুরু হয় গ্রামে কলস লাগানোর কাজ।
উদ্যোক্তা মামুন বিশ্বাস জানান, পাখি প্রকৃতির একটি অন্যতম সম্পদ। পাখিদের অবাধ বিচরণ নিশ্চিত করা না গেলে ধীরে ধীরে সব প্রজাতির পাখিই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ইতিমধ্যেই আমাদের দেশ থেকে ৪৭ প্রজাতির দেশীয় পাখি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তাই গত বছরের ডিসেম্বর মাসে গাছে গাছে প্লাস্টিকের বক্স সেট করা মাধ্যমে পাখির অভয়ারন্য সৃষ্টির উদ্যোগ নেই। তবে প্লাস্টিকের বক্সে সফলতা না পাওয়ায় চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে মাটির কলসী স্থাপনের কাজ শুরু করা হয়। এতে অনেক সাফল্যও অর্জিত হয়। শালিক পাখি বাসা বাঁধলেও অন্যান্য পাখির মধ্যে দোয়েল আসা যাওয়া করছে। অন্য জাতের পাখির আবাস্থল গড়ার লক্ষ্যে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করা হয়েছে।
মামুন আরও জানান, পাখি সংরক্ষণ, প্রজনন ও নিরাপদ বাসস্থান গড়ে তোলার লক্ষ্যে ’দি বার্ড সেফটি হাউজ’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সরকারী ও বেসরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেলে শাহজাদপুর উপজেলা জুড়ে পাখির নিরাপদ বাসস্থান গড়ে তুলবেন বলে তিনি জানান।
শাহজাদপুর উপজেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ আব্দুল হাই জানান, মামুন নিজ উদ্যোগে আগনুকালী গ্রামসহ আশপাশের গ্রামগুলোতে পাখির জন্য আবাস্থল তৈরী করছেন। এটি একটি মহতী উদ্যোগ এ বিষয়ে উপজেলা প্রাণি সম্পদ বিভাগ প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে।
শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার শামীম আহম্মেদ জানান, পাখির জন্য অভয়াশ্রম সৃষ্টির ব্যক্তিগত এ উদ্যোগ খুবই প্রশংসনীয়। এ বিষয়ে তাদেরকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এছাড়াও অন্যান্য গ্রামেও যাতে এ ধরণের উদ্যোগ নেয়া হয় সেজন্য উপজেলা প্রশাসন থেকে তাদের উৎসাহতি করার পাশাপাশি সহায়তাও করা হবে।
শাহজাদপুরের পরিচিত মুখ মামুন বিশ্বাস
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার শিল্প, সাহিত্য, সাংস্কৃতিক ও সুশিল সমাজের পরিচিত মুখ সাংবাদিক মামুন বিশ্বাস। গ্রামের সবুজ পরিবেশে বেড়ে ওঠা প্রাণোচ্ছল এক তরুণ মামুন শাহজাদপুর উপজেলার আগনুকালী গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মাহবুবুল হোসেন আগনুকালী পশ্চিমপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক।
মামুন বিশ্বাস স্থানীয় আগনুকালী পশ্চিমপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে খাষসাতবাড়ীয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ৮ম শ্রেণী ও সিরাজগঞ্জ টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও পরবর্তীতে এইচএসসতে ভর্তি হওয়ার পর এলাকার বিভিন্ন সংগঠনের সাথে জড়িত হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে আর পড়াশুনায় মনোনিবেশ করতে পারেনি। দূরন্ত প্রকৃতির ছেলে মামুন ছোটবেলা থেকেই এলাকার যুবকদের নিয়ে নিজ গ্রামে ভাল কিছু করার স্বপ্ন দেখতো। এরই ধারাবাহিকতায় এলাকার ছোট ভাইদের সহযোগিতায় পাখিদের নিরাপদ আশ্রয়স্থলের নিজ উদ্যোগে গড়ে তোলেন ‘দি বার্ড সেফটি হাউস’ নামে একটি সংগঠন। পাখি প্রেমিক মামুন বিশ্বাস ও ইমনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আগনুকালী গ্রামটিতে ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে পাখির অভয়াশ্রম। নিজ অর্থায়নে আরো ৪/৫ পাখি প্রেমিকের সহায়তায় তিনি পাখিদের জন্য ঘর-সংসার গড়ে দিচ্ছেন। গত ৪ মাসে ৩৫০টি গাছে মাটির কলস বেঁধে দিয়েছেন। দেশীয় পাখিগুলো যাতে ওই কলসীতে নিজ নিজ আশ্রয় খুঁজে নেয়। ইতিমধ্যে এ কাজে বেশ সফলতা অর্জন করেছেন তারা। বেশ কয়েকটি মাটির কলসীতে পাখিরাও এসে আশ্রয় নিয়েছে। মামুন ও ইমনের অক্লান্ত পরিশ্রমে তাদের এই সাফল্যে গ্রামবাসীসহ আশপাশের লোকজন মুগ্ধ হয়ে পড়েছে।
মামুনের এই কাজে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ দিয়েছেন তার পিতা মাহবুবুল হোসেন ও বড় ভাই মুক্তা বিশ্বাস। এদের কাছে তিনি চির কৃতজ্ঞ।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী মামুন বিশ্বাস ২০১০ সালে ঢাকার ক্রাইম নিউজ-এ শাহজাদপুর প্রতিনিধি হিসেবে সাংবাদিকতা জীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে দৈনিক শহর গ্রাম, দৈনিক দেশেরপত্রের শাহজাদপুর প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে দৈনিক ভোরের পাতার জন্মলগ্ন থেকে শাহজাদপুর উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে সুনামের সাথে কর্মরত রয়েছেন। সদাহাস্যেজ্জ্বল ও মিষ্টিভাষী এই তরুণ সাংবাদিক সামাজিক অবক্ষয় ও অপসাংস্কৃতির আগ্রাসনরোধে নির্ভীক কলম সৈনিক হিসেবে নিজেকে মেলে ধরেছেন।
সাংবাদিকতা সৌখিন হিসেবে বেছে নিলেও মামুন বিশ্বাস একজন ব্যবসায়ী। তিনি ইতিমধ্যে ব্যবসায়ী হিসেবে শাহজাদপুরে যথেষ্ট পরিচিতি লাভ করেছেন। পাশাপাশি শাহজাদপুরের বিভিন্ন সামাজিক ও েেপশাগত সংগঠনের সাথে জড়িত রয়েছেন। তিনি নিজ গ্রামে গড়ে উঠা মেধাবী বিকাশ ফাউন্ডেশনের অর্থ সম্পাদক, নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) এর সদস্য, মানবাধিকার শাহজাদপুর শাখার সদস্যসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন।
ব্যক্তিগত জীবনে দুই ভাই এক বোনের মধ্যে মামুন সবার ছোট।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ২:৪০