somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এক মর্মস্পর্শী পরী আর ভূতের কাহিনী: ভূতেরাও মানুষ ছিলো! :(

২৪ শে মার্চ, ২০১৪ দুপুর ১২:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কত ফুল ফোটে আর ঝরে। সুমাইয়াও ঝরে গেছে। খুবই দীর্ঘ ছিল ওর ঝরে যাওয়া। লোভের আগুনে মিনিমাগনা জীবনগুলোর একটি ছিল সে। তাজরীনে বা রানা প্লাজায় যাঁরা হঠাৎ মরে বেঁচে গেছেন দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে, সুমাইয়া তাঁদের মধ্যে ছিল না। তাজরীনের আগুনের পরও মৃত্যুযন্ত্রণার ভয়াবহতা সওয়া ও দেখানোর জন্য বাড়তি কিছুদিন বেঁচে ছিল সে। বেঁচে ছিল একটি পূর্বঘোষিত মৃত্যুর দিনপঞ্জি ধরে তিলে তিলে শেষের দিনের অপেক্ষায়। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় সাভারের নিশ্চিন্তপুরে ওর যন্ত্রণার অবসান হয়। সেই গানটা মনে পড়ে: সারা নিশি জ্বলে কত দীপ নিভে যায়/ নিজে রে পোড়ায়ে ধূপ গন্ধ বিলায়। মুনাফা চুল্লির জ্বালানি এসব সুমাইয়াদের কথা কে আর মনে রাখে? মনে রাখলে অন্তত ক্ষতিপূরণ পেত, চিকিৎসায় সরকারি সাহায্য পেত। কিছুই না পেয়ে সুমাইয়া কেবল সরকার ঘোষিত মৃতশুমারির আরও একটি সংখ্যাই হয়ে গেল।

১৬ বছর বয়স হয়েছিল ওর। এই বয়সের কিশোরীর মন চৈতি হাওয়ার মতো ফুরফুরে হওয়ার কথা। কত কী প্রিয় হওয়ার কথা। দেলোয়ার হোসেনের তাজরীন কারখানায় কত কত রঙের সুতা-কাপড়-বোতাম-স্টিকার-লেইসের রংদার পোশাক সেলাই করত ও। অথচ ওর কোনো প্রিয় রং ছিল না। ও জানত যে মানুষ ৪০ বছরের বেশি বাঁচে না। ওর কোনো স্বপ্ন নেই; ওর মায়ের বয়স এখন ৩৩ কি ৩৪। ও জানত, ও বাঁচবে না, তবু মা যেন অন্তত ৪০ পর্যন্ত বাঁচে। ওর মায়ের একটা স্বপ্ন তবু ছিল। ইটভাটায় যতই তিনি রক্ত পানি করা খাটুনি খাটতেন, ততই স্বপ্নটা তীব্র হতো। বাচ্চামেয়েটি ওভারটাইম করে কিছু বাড়তি টাকা পেলে স্বপ্নটা সম্ভব মনে হতো। মায়ে-ঝিয়ে মিলে তারা ঘর তুলবে গ্রামে। দুজনে মিলে একদিন চলে যাবে রাক্ষসপুরী থেকে। এই শহরে আর ভাল্লাগে না। আগুনে আহত সুমাইয়ার মৃত্যুর পর সেই স্বপ্নটাও ধসে গেছে রানা প্লাজার মতো, পুড়ে গেছে তাজরীন ফ্যাশনসের মতো।

শেষের তিন মাসে ভাত খাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। দিনে সাত-আটটা মরফিনেও ব্যথা যেত না। ওকে বাঁচানো, অভিযুক্ত কারখানা-মালিক দেলোয়ার হোসেনকে বিচারের মুখোমুখি করার জন্য নৃবিজ্ঞানী সায়দিয়া আহমেদ, মাহমুদ সুমন এবং অ্যাক্টিভিস্ট শহিদুল ইসলাম, নাজনীন শিফা ও কামরুল হাসানের মতো মানুষেরা যত লড়েছেন, তার তিলমাত্রও যদি সরকার করত, তাহলে সুমাইয়ার জীবনটা অন্য রকম হতে পারত। তাজরীনে আগুন লাগার পর ধোঁয়ায় অন্ধকার কারখানায় মেশিনপত্রের সঙ্গে ধাক্কা খেতে খেতে ভাঙা জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে আহত হয় সে। খবর পেয়ে আশুলিয়ার ইটভাটা থেকে মা আসেন। সাহায্য না পেয়ে মেয়েকে নিয়ে বাসে গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ রওনা হন। বাসের ভেতরই; রক্ত থামাতে চার-পাঁচটি ওড়না ভিজে যায়। পরের ইতিহাস ভুল চিকিৎসায় জীবন আর সঞ্চয় হারানোর ইতিহাস।

তাজরীনে আগুন লাগার তিন দিন আগের একটি ছবি আছে ওর, মুঠোফোনে তোলা। ১৮ ঘণ্টা কাজ করেও পরির মতোই ছিল সে। গত রোজার ঈদের আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বেডে যাকে দেখি, সে আর সেই ছোট্ট পরিটি নেই। সে তখন নিজেরই প্রেতমূর্তি। বাঁ চোখটি ক্রমশ ঠেলে বেরিয়ে আসছে। দৃষ্টি নিভে যাচ্ছে, শরীর শুকিয়ে কাঠ, মাথার ভেতর চলছে অসহ্য যন্ত্রণা। তার দরকার ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে যাওয়া। কিন্তু বিজিএমইএর মেডিকেল অফিসার একপ্রকার বাধ্য করেন ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হতে। অথচ সেখানে ওর অসুখের কোনো চিকিৎসা নেই। মাথার মধ্যে ‘ক্যানসারাস টিউমার’। চিকিৎসকেরা বলে দিয়েছেন, কিছু করার নেই। কিছু যখন করার থাকে না, তখনো তো অসহ্য যন্ত্রণা থেকে বাচ্চামেয়েটি পরিত্রাণ চায়। পরিত্রাণ চায় ওর মাথার ভেতরের আগুনের পোকাগুলো থেকে। ওর বিশ্বাস, তাজরীনের সেই মরণসন্ধ্যায় আগুনের পোকাগুলো ওর মাথায় ঢুকে গিয়েছিল। আসলেই দেলোয়ার হোসেনের মতো মালিকদের লোভের আগুনের পোকাই ওর মতো শ্রমিকদের কুরে কুরে খেয়ে শেষ করে দেয়নি কি?

সায়দিয়াদের সুমাইয়াকে বাঁচাতে ব্যর্থ হলেও ওদের নিরন্তর আরজিতে আদালত কান পাতেন। দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর তাজরীন ফ্যাশনসে মালিকপক্ষের সুস্পষ্ট অবহেলায় আগুন লাগে। প্রাণ বাঁচানোর ব্যবস্থা না থাকায় ১১১ জনের তাৎক্ষণিক মৃত্যু ঘটে। সেই ঘটনার ঠিক এক বছর তিন মাস পর দেলোয়ার হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়। নিয়তির করুণ লীলা, ঠিক সেদিনই চিকিৎসকেরা জানান, সুমাইয়ার সময়শেষ।

৬ মার্চ সুমাইয়া খাতুন মায়ের সঙ্গে চলে যায় সাভারের সেই নিশ্চিন্তপুরে। ওর মতো আরও ৩০-৪০ জন আহত শ্রমিক সেখানে স্বেচ্ছাসেবীদের দয়ায় বসবাস করতেন। সেখানেই সুমাইয়া শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করে। বড়লোকের হয় মহাপ্রয়াণ, মাঝারিরা মৃত্যুবরণ করে, আর সুমাইয়ারা অকাতরে ঝরে যায়। অন্যদিকে রানা প্লাজার রানা একটি মামলায় জামিন পেয়েযান।
সুমাইয়ার কাহিনি এখানেই শেষ। কিন্তু দেলোয়ার হোসেনের কাহিনি এখনো চলছে। সরকারি তদন্ত রিপোর্টে গ্রেপ্তারের সুপারিশ থাকার পরও যে ক্ষমতাবলে বছরের বেশি সময় তিনি অধরা ছিলেন, সেই ক্ষমতার দৌড়ও শেষ হয়নি। শ্রম ও জীবনের চূড়ান্ত ব্যবস্থাপক আসলে রাষ্ট্র ও সরকার। তারা চাইলে মালিকেরা নিয়ম মানবেন, শ্রমিকেরও জীবন বাঁচবে— শিল্পটিও টিকবে। সুমাইয়াদের মৃত্যুর দায় তাই রাষ্ট্রেরও।

শ্রমবাজারের নামে যে দাসের বাজার চলছে, সেই বাজারে মানুষের জীবনের দাম কতটুকু হে রাজাধিরাজ?

source
৫টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×