ছোটবেলায় কোরবানির ঈদ মানেই ছিলো সেকি এক বিশাল ব্যাপার। স্কুল ছুটি হত ঈদের ২/১ দিন আগে, আর ঐদিনই বিকেল বেলা যাওয়া হত হাটে। হাটে যাবার আগে সেকি টানটান উত্তেজনা, কখন আব্বা অফিস থেকে আসবেন আর কখন হাটে নিয়ে যাবেন??? কি কেনা হবে, গরু নাকি খাসি??? আব্বা অফিস থেকে আসার সাথে সাথে আমরা দুই ভাই রীতিমত আব্বার উপর ঝাপিয়ে পড়ে বলতাম, "চল চল এক্ষণ চল!!!" আব্বা কোনরকমে কাপড় পালটে আমাদের নিয়ে যেতেন হাটে।
হাটে প্রতিটা মুহূর্ত প্রাণ দিয়ে উপভোগ করতাম। কখনো কোরবানির পশুটি ভালো করে ঘুরে ঘুরে দেখা, কখনো বা দরদাম করা, আবার দরদাম শেষে হাটের অস্থায়ী অফিসে যেয়ে হাসিল কাটা। খুব যখন ছোট ছিলাম, তখন গরুর হাটে ঢুকতে ভয় লাগত, তাই আব্বা আমাকে খাসির হাট পর্যন্তই নিয়ে যেতেন আর ভাইয়াকে নিয়ে ঢুকতেন গরুর হাটে।
বেশির ভাগ সময়ই আমাদের কেনা হত একটা গরু ও দুইটা খাসি। আমি আবার খাসিগুলোর নামও দিয়ে দিতাম, ববি আর পুটু। সবচেয়ে উত্তেজনার ব্যাপার ছিলো হাট থেকে কোরবানির পশুগুলোকে হাটিয়ে বাসায় নিয়ে আসা। আর আসার পথে লোকজন যখন দাম জিজ্ঞাসা করবে তখন কে কার আগে তা বলতে পারবে, আমি নাকি ভাইয়া? মজার ব্যাপার ছিলো, যত সময় যেত তত দাম কমিয়ে বলতে থাকতাম আমরা দুইজন। শেষে বাসার কাছাকাছি আসতে আসতে বলা হত, "ভাই, পয়সা নেই নাই মাগনা দিসে (হা হা হা)"। এভাবেই কখনো আজিমপুর হাট, কখনো কমলাপুর হাট, কখনোবা বনানী হাট আর শেষের দিকে উত্তরে স্থায়ী হবার পর আজমপুর হাট থেকে শুরু হত আমাদের "আনন্দ যাত্রা"।
একবার মনে আছে, ১৯৮২ সাল, আব্বার বেতন কিংবা বোনাস সময়মত না হওয়াতে আমাদের কোরবানী করতে হয়েছিল ভাগে, নানার সাথে। জীবনে ওই একবারই মনে হয় হাটে যাওয়া হয়নি। ক্লাস টু তে পড়তাম তখন, কি যে কষ্ট পয়েছিলাম তা মনে হয় ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। আজ সেই কষ্টটা কেন যেন আবার বুকটা ছিড়ে ফেলছে।
ইংল্যান্ডে আজ পবিত্র কোরবানির ঈদ, ফজরের নামাজ পড়ে লেখাটি লিখছি। বাইরে এখনো অন্ধকার, একটু পরেই গোসল করে ঈদের নামাজের জন্য রওয়ানা হবো। এখানে হাটে যাবার কোনো আনন্দ নেই, ফিশপন্ড এর ইউনিভার্সাল বুচার এ কোরবানির অর্ডার দিয়ে এসেছি, রাতে মাংস ডেলিভারি দেবে। আগে নামাজে যাবার আগে আব্বা আম্মার পায়ে ধরে সালাম করা হত, আর এখন? আব্বা চলে গেছেন না ফেরার দেশে। নামাজে যাবার আগে আম্মাকে ফোন দিবো। হয়ত ধরবেন, হয়ত ধরবেন না।
তারপরও আজ কোরবানির ঈদ, ত্যাগের মহিমায় আলোকিত হবার দিন। মহান আল্লাহর কাছে সকল অপরাধ এর ক্ষমা হবার দিন। ছোট বেলায় যেটা ছিলো নিছক আনন্দের, বড় হয়ে শিখেছি কোরবানির আসল মানে যা হচ্ছে: ত্যাগ।
সেই ত্যাগের আনন্দেই উদ্ভাসিত হোক সবার জীবন। দেশে বিদেশে যে যেখানেই আছেন, সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা।
ইদ মুবারক।