শুরুতেই বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ঘটে যাওয়া কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক-সামরিক ঘটনাবলীর উপর দৃষ্টি দেয়া যাক;
• ২০০৯ থেকে ২০১১ এর মধ্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাথে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর মধ্য “টাইগার শার্ক-১”, “টাইগার শার্ক-২”, “টাইগার শার্ক-৩” এবং “টাইগার শার্ক-৪” নামক চারটি সামরিক মহড়া অনুষ্ঠিত হয়।
• ২০১০ সালে ফেব্রুয়ারি থেকে মধ্য মার্চ পর্যন্ত তথাকথিত “পোর্ট কল” এর নামে বঙ্গোপসাগরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি যুদ্ধজাহাজের নৌ মহড়া অনুষ্ঠিত হয়।
• গত ১৯ এপ্রিল’২০১২ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের রাজনৈতিক ও সামরিক বিষয়ক মন্ত্রী অ্যন্ড্রু জে শ্যাপিরোর নেতৃত্বে ১১ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে এসে দ্বিপক্ষীয় নিরাপত্তা সংলাপে অংশ নেয়।
• অবশেষে গত ৫ই মে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফর।
• গত ১লা জুন মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী লিওন প্যানেট্টা সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত একটি নিরাপত্তা সংলাপে ঘোষণা দেয় যে, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০২০ সালের মধ্য তাদের নৌবাহিনীর ৬০ শতাংশ এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সরিয়ে নিয়ে আসবে”।
• গত ১লা সেপ্টেম্বর মার্কিন মেরিন কোরের ৪০-৪৫ জনের একটি দল সেপ্টেম্বরে ঢাকায় এসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি দলের সাথে মাসব্যাপী যৌথ অনুশীলন চালায়।
• একই মাসে হাওয়াই দ্বীপে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য সামরিক সংলাপও অনুষ্ঠিত হয়।
• সর্বশেষ গত ১০ই অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সামরিক প্রধান অ্যাডমিরাল স্যামুয়েল জে লকলিয়ারের বাংলাদেশ সফরে আসে। সফরকালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের স্বার্থ গত প্রবল আগ্রহের কথা ব্যক্ত করেন।
গত দুই বছর ধরে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য অনুষ্ঠিত উপরোক্ত কূটনৈতিক সংলাপ এবং সামরিক মহড়াগুলি ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করলে খুব সহজেই অনুধাবন করা যায় যে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক এখন নতুন এক মাত্রায় রূপ নিয়েছে এবং বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে একটি “হাই ভ্যালিউ জিও-পলিটিক্যাল প্লেস” এ পরিণত হয়েছে। অ্যাডমিরাল স্যামুয়েল জে লকলিয়ার তার সফর কালেও যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সামরিক সম্পর্ককে বহুমাত্রিক বলে আখ্যায়িত করেন। আমরা সকলেই জানি, বিশ্বের পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলি কখনই তাদের জাতীও স্বার্থ ছাড়া কোন কাজ করে না। তাই জনমনে প্রশ্ন আসা অস্বাভাবিক নয় যে, “হটাত বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের এমন আঁতেলীয় সম্পর্কের প্রকৃত কারণ কি?
এর উত্তর খোঁজার জন্য কয়েকটি বিষয়ের উপর দৃষ্টি দেয়া যাক;
- চীনের ক্রমাগত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, যা এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের একক অধিপত্য বিস্তার এবং এই অঞ্চলকে ঘিরে মার্কিন স্বার্থ এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অন্তরায় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
- চীনকে কূটনৈতিক ভাবে দুর্বল করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে তাদের স্বার্থ রক্ষা করবে এমন বন্ধু রাষ্ট্র বৃদ্ধি করার চেষ্টা চালাচ্ছে।
- এই অঞ্চলে সমুদ্র পথে চলাচলের উপর নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি, বিশেষ করে মালাক্কা প্রণালী নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে চীনকে কোণঠাসা করা। কারণ মালাক্কা প্রণালীই একমাত্র সমুদ্রপথ যা চীন ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আগমনের জন্য ব্যাবহার করে।
- সর্বোপরি এশিয়ায় পুরো বিশ্বের মোট মুসলিম জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের বসবাস। মুসলিমদের উপর অবৈধভাবে সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ায় অধিকাংশ মুসলিমের মার্কিন বিরোধী মনোভাবের কারণে এই অঞ্চলের মুসলিমদের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা মার্কিন পরিকল্পনার অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছে।
উপরোক্ত ফ্যাক্টরগুলি এই অঞ্চলে মার্কিন আধিপত্য বিস্তারের জন্য পূর্বশর্ত হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। এই অঞ্চল ঘিরে তাদের বৃহৎ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বাংলাদেশের সাথে তাদের দ্রুত সম্পর্ক উন্নয়ন অত্যন্ত জরুরী। এর অন্যতম কারণ প্রথমত বঙ্গোপসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দরের উপযোগিতা। ফলশ্রুতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই অঞ্চলে সামরিক ঘাটি করার আকাঙ্ক্ষা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। একই সাথে এই অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ সম্পদের আধিক্য এবং আমাদের দেশের উত্তোলনের অপারগতার সুযোগে তেল, গ্যাস, কয়লা প্রভৃতি খনিগুলির উপর যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। সেই সাথে এই অঞ্চলে মার্কিন গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি এবং অনাগত সমস্যাগুলিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ব্যাবহার করার প্রয়াস। ঠিক যেমন ন্যাটো তালেবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সহযোগিতার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ব্যাবহার করে। তাই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্য গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির জন্য একের পর এক যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সামরিক মহড়া অনুষ্ঠিত হচ্ছে। অ্যাডমিরাল স্যামুয়েল জে লকলিয়ার তার সফর কালে বলেন, “আপনার দেখতে পাচ্ছেন, এই অঞ্চলে শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের তৎপরতা বেড়েছে। আমি মনে করছি এবং আশা করছি, তা অব্যাহত থাকবে।” অর্থাৎ এটা এই অঞ্চলে তাদের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার একটি অংশ মাত্র। হয়তো ধীরে ধীরে তারা সামরিক ঘাটি প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে চলেছে যা এই অঞ্চলে মার্কিন আধিপত্য বিস্তারে একটা মাইলফলক হবে।
দ্বিতীয়ত এই অঞ্চলটিতে বিশ্বের মোট মুসলিম জনসংখ্যার অর্ধেকের বসবাস। এই বৃহৎ মুসলিম জনগোষ্ঠী অতীতে অনেক বড় একটা সময় রাজনৈতিক ইসলাম তথা ইসলামী খিলাফতের অধীনে ছিল। তাই এই অঞ্চলের মুসলিমদের কাছে বিশ্বব্যাপী ইসলামী খিলাফতের ধারণা অপরিচিত নয়। অপরদিকে এই অঞ্চলের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলির সীমাহীন দুর্নীতি এবং জনগণের মৌলিক অধিকারের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা জনগণকে গণতন্ত্র বিমুখী করে তুলছে। একই সাথে যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিম বিরোধী আচরণ এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মত অনৈতিক যুদ্ধ তাদের উপর চাপিয়ে দেয়ার ফলে মুসলিমদের মধ্য মার্কিন বিরোধী মনোভাব বেড়েই চলেছে এবং এর সমাধান হিসেবে মুসলিমদের মধ্য বিশাল একটা অংশ ধীরে ধীরে বিশ্বব্যাপী ইসলামী খিলাফতের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। সুতরাং এটা বলা অবান্তর হবে না যে এই অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মুসলিমদের সম্মিলিত ইসলামী খিলাফতের আগমনের সম্ভাবনাকে সামনে রেখে তাদের পরিকল্পনা সাজাচ্ছে এবং এই অঞ্চলের মুসলিম সেনাবাহিনীর মধ্য তাদের মূল্যবোধ ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে মুসলিম সেনাবাহিনী তাদের নিজস্ব ইসলামী মূল্যবোধ হারিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যবোধ ধারণ করবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের শত্রুকে নিজের শত্রু ভাবতে শিখবে। এইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এই অঞ্চলের মুসলিমদের সম্মিলিত ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাকে রুখে দেয়া অনেক সহজ হবে।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে অক্টোবর, ২০১২ রাত ১:০২