somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমাদের বাসাটা ছিল হাট

২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৮ রাত ১০:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শ্যামবাজারের বাসাটা ছিল হাট। মাঝে মধ্যেই দেশের লোক এসে উঠত। কখনও বেড়াতে, কখনও প্রয়োজনে। যারা আসত, তারা বেশ কিছু দিন থেকে যেত। তাদের কিন্তু যত্ন আত্তির কোনো ত্রুটি হত না। মা হাসিমুখে সবার জন্য রান্না করতেন। সবার শেষে নিজে খেতেন। কোনোদিন ডাল ঝোল থাকত। কোনোদিন কিছুই থাকত না। কতদিন মা আচার দিয়ে ভাত খেয়েছেন। বাবার পয়সা আর মার গতর দিয়ে সব চলত।

একবার বাবার ঠাকুমার ভাই আমাদের বাসায় এসে উঠলেন। তখন বোধ হয় তার সত্তর বছর বয়স। বুড়ো বেড়াতে এসেছিল কোলকাতায়। সকালে ঘুম থেকে উঠে খেত বেলের মোরব্বা, দুপুরের খাওয়ার পর বুড়ো আঁচাতো। মা আমায় জল ঢেলে দিতে বলতেন। আমি খুব উৎসাহ ভরে বুড়োর হাতে জল ঢেলে দিতাম। অতিথি সেবার জন্য নয়, আমার ঔৎসুক্য ছিল মুখ ধোয়ার সময় বুড়োর মুখ থেকে কি বের হয় সেটা দেখার জন্য। হাত দিয়ে টেনে বুড়ো বার করে আনতো দুপাটি বাঁধানো দাঁত, লাল রঙের মাড়িওয়ালা। আমি খুব অবাক হয়ে সেই দাঁত দেখতাম।

একবার মেজকাকা এক রুগী নিয়ে হাজির। বেশ উত্তেজনা বাড়িতে। মেজকাকা হোমিওপ্যাথ ডাক্তার, বেশ পসারও ছিল। এক মুসলমান রুগীর হাতে কাকাবাবু ইঞ্জেকশান দিতে গিয়ে ছুঁচ ঢুকিয়ে ফেলেছিলেন আর বার করতে পারছিলেন না। সে সময় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভেদ শুরু হয়েছে। মুসলমানরা কাকাবাবুকে হুঁশিয়ারী দিয়েছিল, ছুঁচ না বার করতে পারলে দেখাবে মজা। কাকাবাবু তাই রুগী নিয়ে শ্যামবাজারের বাসায় এসে হাজির। এসব ঘটনা আমাদের বাড়ীতে নতুন কিছু না, কিন্তু মুশকিল হল ইনি মুসলমান। রুগীর থাকার ব্যবস্থা হল নীচের তলার একটা খোঁপে। সঙ্গে তাঁর মেয়েও এসেছিল। ভাত পাঠিয়ে দেওয়া হত। ছোটোকাকার অনেক চেনা জানা ছিল ব্যবসার সূত্রে। ছোটোকাকা মেডিকেলে ভর্তির ব্যবস্থা করে দিলেন। কয়েকদিন থেকে ছুঁচ বার করে নিয়ে রুগী সহ মেজকাকা দেশে ফিরে গেলেন।

একবার একটা মেয়ে দেশ থেকে এল । তার নাম শিবানী। তার পেটে জল হয়েছিল, চিকিৎসা করানোর জন্য আমাদের বাড়ীতে এসেছিল। কথা হল, ছোটকাকা তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে দেবেন । তাকে পেয়ে আমরা খুব খুশী । তার সঙ্গে নানা রকম খেলা করতে লাগলাম। সে হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে খেলা করবে বলে চলে গেল। ছোটকাকা ফিরে এসে বলতে লাগলেন, ওর অবস্থা বিশেষ ভাল নয়। আমরা ঠাকুরের কাছে ওর জন্য জীবন ভিক্ষা চাইতে লাগলাম। অনেক রাতে ফোন বেজে উঠলো। মেয়েটারই মৃত্যু সংবাদ। মনের মধ্যে শুধু মেয়েটার মুখ ও কথা ভেসে উঠতে লাগল।

বাবার বন্ধু ননী মল্লিকের ছেলে নীরোদদা ডাক্তারী পড়বে বলে আমাদের বাড়ীতে এসে হাজির। কয়েকদিন থাকার পর ছোটকাকা ওকে নিয়ে গিয়ে মেডিকেল কলেজে ভর্তি করে হস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। এর কিছুদিন পরে ননী জ্যাঠা এসে হাজির। ওর মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। তার জন্য গহনা লাগবে। বাবার কাছে কিছু টাকা চান। বাবা পাঁচ ভরি সোনার দাম দিয়ে দিলেন। জ্যাঠা তার বন্দুকটা বাবাকে দিতে চেয়েছিলেন। বাবা বলেছিলেন, তোর মেয়ে আর আমার মেয়ে কি আলাদা। কিছু দিয়ে আমার কাছ থেকে কিছু নিবি এটা ঠিক নয়।

পরে ছোটকাকীমার মামাতো ভাই এসে আমাদের বাড়ীতে ছিলেন। সেও এসেছিল ছোটোকাকা যাতে ডাক্তারী পড়বার ব্যবস্থা করে দেয়।
সেও কিছুদিন পর মেডিকেলে ভর্তি হয়েছিল। শুনেছি সে বিদেশে গিয়ে বড় ডাক্তার হয়ে ফিরে এসেছিল।

ছোটোকাকা কাজের মধ্য দিয়ে সবার উপকার করতেন। যেখানে কোন বিয়ে হত ছোটোকাকা প্রাণ দিয়ে খাটাখাটুনি করতেন। কেউ মারা গেলে তাদের বাড়ীতে গিয়ে ছোটোকাকা সাহায্য করতেন। বাবা রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে ঠাকুমার পা ধোয়া জল খেতেন। অফিস থেকে ফেরবার সময় রাবড়ী,সন্দেশ এই সব নিয়ে আসতেন বাবা। বাবা ঠাকুমাকে কিছুতেই খুশী করতে পারতেন না। সব সময় তিনি আমার মার দোষ ধরবার চেষ্টা করতেন। সব সময় বলতেন, বড় হতে শখ হয়, কাজ করতে শখ হয় না । কাকীমাদের খুব ভালোবাসতেন। আমি শুধু মনে মনে ভাবতাম, আমি যদি কাকীমার মেয়ে হতাম তাহলে খুব ভালো হত, মায়ের নিন্দা শুনতে মোটেই ভালো লাগত না।

মেজ কাকীমা কিন্তু মাকে খুব ভালবাসতেন। ঠাকুমার অন্যায় কথাবার্তার প্রতিবাদ করতেন।

এই সময় ছোটোপিসেমশায় ঢাকা থেকে চলে এলেন। তিনি কোন বাসা পাচ্ছেন না বলে আমাদের বাড়ীতে এসে হাজির। তিনি কয়লাঘাটা অফিসে রেলে কাজ করতেন। বাবার ঘরটায় তাদের থাকার ব্যবস্থা হল। পিসিমা, পিসেমশায় তাদের এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে এসে হাজির। তিনি আমাদের ওখানে চার বছর ছিলেন, তিনি জামাই চালে কাটিয়ে গিয়েছেন। মার কাজ আরও বেড়ে গেল। পিসেমশাইয়ের অফিসের ভাত,অফিস থেকে ফিরে এসে রোজ বিকেলে আটখানা লুচি,আলুভাজা,মাছভাজা ও মিষ্টি দিয়ে টিফিন সারতেন।

ছোটোপিসিমা ভাই এর সংসারে ভাই এর পয়সা যাতে খরচ না হয়, তারজন্য আমরা স্কুল থেকে ফিরে এলে আম-তেল ডাল দিয়ে ভাত মেখে গোল করে একটা করে আমাদের হাতে দিতেন। পিসিমার পরে ভীষণ রাগ হত আমাদের খাবারের এই ব্যবস্থা দেখে। পিসিমা রেলের রেশনটা আমাদের দিতেন। রেশনে খুব ভাল ঘি দিত। আর অন্যান্য জিনিস ভালো ছিল। পিসিমা সপ্তাহে একদিন করে চার আনার বাদাম কিনতো। আমাদের সবাইকে চারটে করে বাদাম দিত।

পিসিমার ছোটো ছেলে আর আমার ছোটো ভাই একই বয়সের ছিল। পিসিমার ছেলের নাম ছিল কিশোর। ওর বাবাকে ও বাবুলে বলে ডাকত। আমার ভাই এর নাম ছিল গৌর। পিসেমশায় খাবার প্লেটে মিষ্টি রেখে গেলে ওরা দুজনে খাবার জন্য ঝগড়া করত। একদিন কিশোর হঠাৎ গৌরের কপালে দা দিয়ে কোপ মারল। ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরতে লাগল।


সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৮ রাত ১০:৩২
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×