somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কোলে নেওয়ার সাধ

০৫ ই জানুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৫:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার মায়েরা দুই বোন। মাসীমার সাথেই বাবার প্রথম বিয়ে হয়, খুব ধূমধাম করে। কিন্তু দাদা হওয়ার সময় সূতিকা হয়ে মাসীমা মারা গেছিলেন। দাদা তখন আঁতুড়ে বাচ্চা। দাদাকে দেখার জন্যই বাবা রাজী হয়েছিলেন মাকে বিয়ে করতে।

১২ বছরের মার বিয়ে হয়েছিল লাল পাড় শাড়ি আর গাঁদার মালা গলায় দিয়ে। দাদু্ এই বিয়েতে রাজী ছিলেন না। মার জ্যাঠামশায় দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিয়েছিলেন। মরা দিদির অন্য সম্পত্তির সঙ্গে মাসীমার বাক্সটাও মার হয়েছিল। মাসীমার অনেক গয়না, শাড়ি তাতে ছিল। কিন্তু মা কয়েকদিনের জন্য বাপের বাড়িতে বেড়াতে গেলেই ঠাকুমা চাবিওয়ালা ডেকে বাক্সের চাবি বানিয়ে সে সব শাড়ি, গয়না বার করে নিলেন। বাবা জানতে পেরে মাকে কিছু গয়না বানিয়ে দিয়েছিলেন। এই গয়না দেওয়া নিয়েও ঠাকুমা প্রায়ই মাকে শুনিয়ে শুনিয়ে চেঁচামিচি করতেন।

একসময় আমাদের বাসায় ঠাকুমার চেঁচামিচিটা রোজকার ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সবটাই ছিল একতরফা। মা কোনো কথা বলতেন না, বাবাও থাকতেন চুপচাপ। আমি ছোটো হলেও মেয়ে, তাই হয়তো বুঝতে পারতাম আমার মা বাবার মধ্যে দূরত্বের একটা পাঁচিল তুলে দেওয়ার চেষ্টা চলছিল। তবু বাবাকে আমি সংসারের ব্যাপারে খুব একটা নাক গলাতে দেখতাম না টাকাপয়সা দেওয়া ছাড়া। আর মা বেশীরভাগ সময় কাটাতেন রান্নাঘরে নিঃশব্দে।

শ্যামবাজারের বাড়ীতে অতিথিদের আসা যাওয়া চলছিলই। ছোটোপিসিমা তো সপরিবারে এখানে এসে আগেই উঠেছিলেন ।এর কিছুদিন পরে ছোটোপিসিমার ভাগ্নে এখানে থেকে পড়াশুনো করবে বলে এখানে চলে এল। ওকে দিয়ে পিসিমা নিজস্ব আনেক কাজ করিয়ে নিতেন। এই সময় ছোটোকাকার একটা ছেলে হল। ওর চারদিন পরে ছোটোপিসিমারও একটা ছেলে হল। আমার কোনো ছোট ভাইবোন ছিল না যাদের আমি কোলে করতে পারি। ওদের কোলে করতে পেরে আমি খুব খুশি হলাম।

এর কিছুদিন পর ছোটপিসীমার তিন ভাসুরপো এসে জুটল এখানে থেকে তারা ব্যবসা করবে। তাদের জন্য মায়ের কাজ দেখলাম আরও বেড়ে গেল। বেলা তিনটের সময় ওরা ফিরে এলে ওদের খেতে দেওয়া মার কাজ ছিল। মা তখন সোডা কাচতে নীচে যেতেন। ওদের খেতে দিয়ে আমাকে বলতেন ওদের চাটনীটা দিয়ে দিস তো। আমি তখন পরিবেশন কিছুই করতে পারি না। আমি একজনের পাতে সব চাটনী দিতে গেলে মা হেসে বলতেন, আমাকে দে আমি দিয়ে দিচ্ছি। ঠাকুমা বলতেন, আমার মেয়ে বাপের বাড়ী এসেছে কোনো কাজ করবে না।

একদিন ছোটোপিসিমার বড় ভাসুর অনেক রাত্রে আমাদের বাড়ীতে এসেছেন। মা তাদের জন্য মাছ, মাংস রাঁধতে বসলেন। অনেক রাত্রি হয়ে যাচ্ছে দেখে পিসিমা ভাসুরের বিছানা করতে গেলে, ঠাকুমা পিসিমার ভাসুরকে বললেন, দেখেছেন এমন বউ এনেছি আমার মেয়েকে বিছানা করতে হল। পিসিমার ভাসুর তা শুনে বললেন আপনার বৌমা তো বসে নেই, সে তো আমার জন্য এতো রাত্রে রান্না করতে বসেছে। রান্না তো আপনার মেয়ের করা উচিত ছিল। অনেক ভাগ্য করে আপনি ছেলের বউ পেয়েছেন। তাকে রাখতে শিখুন। এই ভাবে চার বছর ধরে জ্বালাতন করবার পর ছোটোপিসিমা ভবানীপুরে বাসা করে চলে গেলেন।

আমার বাবা সিনেমা থিয়েটারে অভিনয় করতেন। মিনার্ভা, স্টারের নিয়মিত শিল্পী ছিলেন। সন্ধানে, দাসীপুত্র ও আরো কয়েকটা সিনেমাতেও অভিনয় করেছিলেন। বাবা কাগজের একটা টুকরোয় লিখে দিতেন কজন যাবে, আমরা সেই কাগজটা দিয়েই বাবার অভিনীত থিয়েটার, সিনেমাগুলো দেখতাম। থামাও রক্তপাত, শাহজাহান, বামন অবতার এইসব বইগুলো দেখেছি। তাছাড়া স্টারে দেখেছি শ্রীকান্ত, ডাকবাংলো, রিজিয়া এইসব বইগুলো। আমাদের বাড়ীর সবাই এইসব বইগুলো দেখেছি একমাত্র মা ছাড়া।একবার স্টারে কি একটা বই চলছিল আমার এখন মনে পড়ছেনা বাবা বার বার করে পিসীমাদের বলে গেলেন মাকে নিয়ে যেতে কিন্তু সময় কালে দেখলাম পিসীমা তাঁর এক বন্ধুকে সঙ্গে নিলেন আর মা যথারীতি রয়ে গেলেন বাড়িতে। আমার মনে হচ্ছিল বাবা যেন অভিনয় করতে করতে বারবার এদিকে তাকিয়ে মা কে খুঁজছিলেন ।বাবা বাসায় ফিরে মা কে ডেকে না যাওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন।মা দেখলাম মুখ ফুটে কিছুই বললেন না।আমার মনে হল মাকে না নিয়ে যাওয়াতে বাবা দুঃখ পেয়েছেন।

একবার বাদকুল্লা থেকে খবর এল দাদু অসুস্থ। কোলকাতার ডাক্তার দেখানর জন্য বাগবাজারে এসে উঠেছেন গ্রামের এক পড়শীর বাড়ি। আমি অবাক হলাম, কত প্রয়োজনীয় আত্মীয় অনাত্মীয় আমাদের বাসায় আসে অথচ আমার নিজের দাদু তার মেয়ের বাসা থাকতে অন্যের বাসায় উঠেছেন, দেখলাম বড়ির কেউ এই বিষয়টায় তেমন আমল দিল না, যেন এটাই স্বাভাবিক। আমার কিন্তু ব্যাপারটা ভালো লাগলোনা। কিন্তু মা যখন বললেন তোকে নিয়ে বাবাকে দেখতে যাবো, তখন বেশ খুশী হলাম। ঠাকুমাও মত দিয়ে দিলেন মাকে বাড়ী থেকে বের করার আনন্দে।বাবা মার হাতে কিছু টাকা দিলেন দাদুকে দেবার জন্য। দাদু আমাদের দেখে খুব আনন্দ করতে লাগলেন। মা জিজ্ঞাসা করলেন ‘বাবা কেমন আছ?’ দাদু বললেন আমার রাজরোগ হয়েছে রে, এ সারবার নয়। দাদুর পেটে আলসার হয়েছিল, দুধ ছাড়া কিছু খেতে পারছিলেন না, চেহারা কেমন হয়েগেছে, আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমরা কিছুক্ষণ দাদুর কাছে থেকে বাসায় ফিরে এলাম।

এই সময় ছোটোকাকার ব্যবসায় বেশ মন্দাভাব দেখা দিয়েছিল। ছোটোকাকার অনেকগুলো টাইপ মেশিন ছিল। দেখতাম আনেকে আমাদের বাড়ীতে এসে টাইপ মেশিনে কাজ করতো। কি কাজ হতো অতো সব বুঝিনা। বনানী বলে একটা মেয়ে ছোটোকাকার কাছে কাজ করতো, তাকে আমরা চিনতাম। একদিন বনানী আমাদের বাড়ীতে এসে পিসিমাকে বলল, ছোড়দা একটা টাইপ মেশিন চাইছেন, আমার সাথে পাঠিয়ে দিতে বলেছেন। পিসীমা কি কাজ করছিলেন, বনানীকে বললেন অ ছোড়দা পাঠিয়েছে তা যাও ঘর থেকে নিয়ে যাও। বনানীও সবচেয়ে ভাল টাইপ মেশিনটা নিয়ে চলে গেল। পরে ছোটোকাকা বাড়ী এলে, পিসীমা বললেন ছোড়দা বনানী এসে বলছিল তুমি টাইপ মেশিন চেয়েছ। আমি তাকে একটা মেশিন দিয়েছি। ছোটোকাকা বললেন মেশিনটা গেল, বনানী তো আনেকদিন আমার কাজের সাথে যুক্ত নয়। বনানী মেয়েটাকে আমার খারাপ লাগতো না কিন্তু তার এই কীর্ত্তি দেখে আমি অবাক হলাম। লালাবাজারের বড়বাবু বসন্ত ছিল ছোটোকাকার বন্ধু। ছোটোকাকা খবরটা জানালেন কিন্তু তারা চেষ্টা করেও মেশিন উদ্ধার করতে পারলেন না।

ছোটোকাকীমার সদ্য একটা ছেলে হয়েছে, গায়ের রঙ টা চাপা কিন্তু মুখটা খুব সুন্দর। ছেলেটা হয়েছিল মেডিকেলে। বড়রা সবাই দেখতে যাবে। আমিও তাকে দেখবার জন্য বায়না ধরলাম। আমি তখন বছর দশেকের, খুব রোগা ছিলাম। সকলে বোঝাতে লাগল বড়দের ছাড়া ছোটোদের হাসপাতালে ধুকতে দেয়না। কিত্নু আমি নাছোড়বান্দা। শেষে সবাই হার মেনে ছিল, আমার এখন মনে আছে ছোটোকাকীমার একটা শাড়ী পরে বড় সেজে আমি হাসপাতালে গিয়েছিলাম। আমার কেবলই মনে হত আমার কোনো ছোটো ভাইবোন হয়না, হলে বেশ ইচ্ছামত কোলে নিতে পারতাম। ছোটোকাকীমার ছেলেকে ইচ্ছেমত কোলে করা যায়না।

ঠিক এমনই সময় মেজকাকীমা দেশ থেকে বেড়াতে এলেন এখানে ছেলে মেয়েদের নিয়ে। ছোটোছোটো ভাইবোন গুলোকে কোলে নিয়ে আমি আমার সাধ মেটালাম।

১১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×