19 বছরের ছেলেটি জুবুথুবু হয়ে বসে আছে। জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে, হাত দেয়া যায় না। অল্প অল্প কাঁপছে। চামড়ার নিচে bleeding দেখা যায়। শেভ করেছে এখন ও দুই দিনও হয়নি। কলেজের এক গাদা ক্লাসমেট এসেছে দেখতে। সুন্দর করে চুল ছাটা। সেই চুলে মায়ের আংগুল কিলবিল করছে। এই মাকে ছেলের আগাম মৃত্যুর খবর দেয়ার চেয়ে খারাপ কিছু এ পৃথিবীতে আর নেই। প্রতিটি ডাক্তারকে হরহামেশাই এ অপরাধটি করতে হয়।
.
ছেলেটির মাকে রুমে ডাকা হল। বেশ কিছুক্ষন আমতা আমতা করে ডাক্তার বলল:: কয় ছেলে আপনার??
: তিন ছেলে বাবা।
.
:: আপনার স্বামী কি করে??
.
: ছোট ব্যবসা।
.
:: আপনার ছেলের কি রোগ হয়েছে, এর চিকিতসা কি আপনাকে কেউ বলেছে??
.
: নাহ। তবে শুনেছি bone marrow change করতে হবে। বিদেশে নিতে হবে। আমাদের এত টাকা নেই।
.
ডাক্তার সব বুঝিয়ে বলল। কোন রিয়াকশন নাই। কিছুক্ষন বসে থেকে চলে গেল। কোন ধরনের মা রে বাবা!! ছেলের মৃত্যু সংবাদে ও চোখে পানি নাই।
.
পাঁচ তলায় উঠার সময় সেই মাকে দেখলাম সিড়ির গোড়ায় বসে হাউমাউ করে কাঁদছে। ভিতরটায় ছ্যাৎ করে উঠল। মায়ের ভালবাসা নিয়ে হালকা চিন্তা করা উচিত হয় নি। বছরের পর বছর বাড়ির বাইরে থেকে বুনো হয়ে গেছি। চোখের সামনে মায়ের বয়সী কেউ আকুল হয়ে কাঁদলে ভিতরটা ফালি ফালি হয়ে যায়। মানুষের জীবন টা শুরু হয় কান্না দিয়ে। এরপর সারা জীবনে একবারও সেই কান্নাকে আর কেউ চায় না।
.
একবার মনে হল ছেলের অসুখ নিয়ে তার মাকে কিছু বলা উচিত হয় নি। কিন্তু এটাই নিয়ম। বিদেশে কোন রোগের 1% জটিলতা থাকলেও সেটি সরাসরি রুগীকে বলা হয়। আর এখানে তো ডাক্তার রুগীর মাকে বলেছে।
.
চার বছর আগে আমার এক আত্মীয় ঠিক এই বয়সে মারা গিয়েছিল Rhabdomyosercoma তে। রুগী আর রুগীর মা ছাড়া গ্রামের আর সবাই জানত রুগীর ক্যান্সার হয়েছে।
কিছুদিন আগে এক পরিচিত ডাক্তার কানাডা গিয়েছিলেন এক সেমিনারে। একজন আমেরিকান ডাক্তার উনাকে প্রশ্ন করেছিলেন:: শুনলাম, তোমাদের উপমহাদেশে যার ক্যান্সার হয় সে ছাড়া এলাকার আর সবাই জানে তার ক্যান্সার হয়েছে??
কথা টা মিথ্যা। রুগীর সাথে আরো একজন রোগের কথা জানে না। উনি হলেন ' মা' । আমাদের আবেগ বেশি, মায়ামমতা বেশি। বেচে থাকার আকুলতাও বেশি। মৃত্যুর আগাম পরোয়ানা শুনতে অভ্যস্থ নই। ক্যান্সার রুগীর কাছে ক্যান্সার শব্দটা লুকানো আমাদের চিকিতসা পলিসি। মৃত্যুর শেষ দিন পর্যন্ত রুগী জানে তার কিছুই হয় নি। কিছু গ্যাষ্ট্রিকের বড়ি খাইলে ভাল হয়ে যাবে। নাক দিয়ে রক্ত পড়লেও রুগী জানে তাকে ইন্ডিয়া নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। একবার যেতে পারলেই হল।
যার ইন্ডিয়া যাবার খরচ নেই তারো একভাবে কেটে যায়। কখনও খিলগাও ফ্লাইওভারের নিচে খানকায়ে পীরের মাদুলি। কখনও কুতুবদিয়ার গাউছুল আজমের পানি পড়া। সেরে যাবে, সব সেরে যাবে।
.
তারপর মানুষগুলো একসময় হেরে যায়। সব শ্বান্তনার গল্প ফুরিয়ে যায়। কিছুদিন গলাগলি করে কেঁদে আবার জীবন যুদ্ধে নেমে পড়ে।
.
শুধু আমরা স্বাক্ষী হয়ে থাকি একগাদা দীর্ঘশ্বাস আর ঘোরলাগা কান্নায়। আমাদের কথা গুলো জুড়ে থাকে কারো কারো চোখ ভেজা গল্পে। বেড়ে চলে আমাদের গল্প।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই আগস্ট, ২০১৬ রাত ১:৫৫