যখন ছোট ছিলাম, তখন গ্রামের মাঠে ঘুড়ি ওড়াতাম।
মাঝে মাঝে আমাদের বন্ধুদের মাঝে ঘুড়ি ওড়ানোর
প্রতিযোগিতা হতো। ঘুড়ি-প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের
জন্য আমরা নতুন ঘুড়ি কিনে আনতাম। কোটচাঁদপুর
বাজারে তখন ঘুড়ির দাম ছিল তিন টাকা থেকে ছয়
টাকার মধ্যে। বন্ধুরা হই-হুল্লোড়
করে বাজারে গিয়ে রীতিমত দরদাম করে দোকানির কাছ
থেকে ঘুড়ি কিনতাম। তারপর বাজার
থেকে বাড়ি ফেরার সময় সবাই বলাবলি করতাম,
দোকানদার ঘুড়ি বিক্রি করে লাভ করতে পারে নি।
আমরা ঘুড়ি কিনে জিতছি!
ধান কাটার মৌসুম শেষ হলে বড়বামনদহ গ্রামের বিলের
মাঠ ফাঁকা থাকত। ঐ ফাঁকা মাঠে ঘুড়ি ওড়ানোর
মজাই ছিল আলাদা। যেদিন স্কুল ছুটি থাকত সেদিন
আমরা বিলের মাঠের নিয়ন্ত্রণ নিতাম। মাঠের এ
প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত আমরা ২০-২৫ জন বন্ধু দূরত্ব
বজায় রেখে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াতাম। তারপর এক-
দুই-তিন বলার সাথে সাথে সবাই ঘুড়ি ওড়ানো শুরু
করত। মজার ব্যাপার হলো, আমাদের
ঘুড়ি প্রতিযোগিতায় কেউই এককভাবে প্রথম হতো না।
কারণ মাগরিবের আজান দিলেই আমরা প্রতিযোগিতার
সমাপ্তি ঘোষণা করতাম। আর তখনো দেখা যেত দশ-
বারো জনের ঘুড়ি আকাশে উড়ছে।
এখন আর আমাদের ঘুড়ি ওড়াতে ভালো লাগে না।
কারণ এখন আমরা বাল্য ও কৈশোর
পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণ করেছি। আমার সেই
বাল্যবন্ধুদের সাথে মাঝে মাঝে দেখা হয়। জীবনের
কঠিন বাস্তবতায় তারা আজ এক একজন এক একদিকে।
কেউ ফল বিক্রি করে, কেউ চায়ের দোকানদার, কেউ
চাকরি পেয়েছে, আবার কেউবা এখনো পড়াশোনা করছে।
তবে যে যেখানেই থাকি, বাল্যকালের সেই মধুর
স্মৃতিগুলো সবসময়ই হৃদয়ে নাড়া দেয়।
যখন গ্রামে বেড়াতে যায় তখন মাঝে মাঝে সেই বিলের
মাঠেও যায়। সেখানে এখন আর কেউ ঘুড়ি ওড়ায় না।
গত বার গ্রামে গিয়ে এক বন্ধুর সাথে দেখা হয়েছিল।
সে এখন ক্ষেতে কাজ করে। তার সাথে দেখা হতেই
তার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখি তার চোখে পানি।
কোনো কথা না বলে আমাকে সে বুকে জড়িয়ে ধরে।
বাল্যবন্ধুরা মিশে থাকে আত্মার সাথে। ছোটবেলায়
ঘুড়ি আকাশে উড়িয়ে দিতাম, সে ঘুড়ি এত দূরে চলে যেত
যে তা মাঝে মাঝে চোখের আড়াল হয়ে যেত।
লাটাইয়ের সুতা টান দিয়ে সে ঘুড়িকে আবার
ফিরিয়ে আনতাম। এত ছোট থাকতেও পেরেছি, আর এখন
নিজের জীবনঘুড়িকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি না।
মাঝে মাঝে মনে হয় আমার
বাল্যবন্ধুরা পাশে থাকলে সবকিছুই পারতাম। যখনই
কষ্টে থাকি, হতাশায় ভুগি, চলার পথে ব্যর্থ হই, তখন
সেই বন্ধুদের কথা খুব মনে পড়ে। আমার দিনমজুর বন্ধু,
আমার ফলবিক্রেতা বন্ধু, আমার চায়ের দোকানদার
বন্ধু—তোরাই আমার প্রকৃত বন্ধু! আমার দুঃসময়ের
বন্ধু! আমি তোদের কাছে ঋণী।