somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এটম বোমা আবিস্কারের ইতিহাস ( পর্ব-৮)

০৭ ই আগস্ট, ২০১৩ রাত ১০:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রথম পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা
পারমাণবিক বোমা নির্মাণের উদ্দেশ্যে ব্রিটেনের ‘ টিউব এলয়েজ’ সংস্থা গঠিত হয় ১৯৪১ খৃষ্টাব্দে । আর একই উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ম্যানহাট্রান প্রকল্প প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে । এই যে এক বছরের ব্যবধান তার মধ্যে বিশ্ব পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে । ১৯৪১ সালে যুক্তরাষ্ট্র মিত্র শক্তির অন্যতম শরিক হিসাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আসরে অবতীর্ণ হয় । যুদ্ধে যোগ দেওয়ার আগে পরমাণু অস্ত্র সম্বন্ধে যুক্তরাষ্ট্র সরকার এবং অধিকাংশ আমেরিকান বিজ্ঞানীদের মনোভাব ছিল ‘ ধরি মাছ না ছূই পানি ’ এই প্রবাদ বাক্যের মত । কিন্তু হঠাৎ পার্ল হারবারে জাপানীদের কাছে পর্যদুস্ত হওয়ার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মনোভাবে আমুল পরিবর্তন ঘটে । তারা পারমানবিক অস্ত্র তৈরির প্রকল্পকে সামরিক ভিত্তিতে গ্রহণ করে এবং এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত সম্পদ নিয়োগ করে । যে তত্ত্বীয় ও প্রায়োগিক জটিলতার দরুণ কয়েক বছ পূর্বেও পরমাণু অস্ত্র তৈরির সম্ভাবনায় অনেক শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীও ছিলেন আস্থাহীন ইতি মধ্যে সেই পরিস্থিতির দ্রৃত রূপান্তর ঘটেছিল । যে সব বাধা বিপত্তির কারণে এই সব প্রাথমিক দ্বিধাদ্বন্দ দেখা দিয়েছিল ম্যানহাট্রান প্রকল্প শুরুর আগেই সেই সব বাধা বিপত্তির নিরসন হয়েছিল । সুতরাং পরমাণু অস্ত্র তৈরিতে সাফল্য লাভের জন্য তখন যে দুটি প্রয়োজন মুখ্য হয়ে উঠেছিল সেগুলো হল দৃঢ় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও পর্যাপ্ত সম্পদ সরবরাহের নিশ্চয়তা বিধান । ব্রিটিশ সরকার এই দুটি প্রয়োজন মেটাতে সমর্থ হয় নি । ব্রিটেন যা পারে নি যুক্তরাষ্ট্র সরকার উৎসাহের সাথেই সেই কাজটি সম্পন্ন করলেন । আর এ উদ্দেশ্যেই সৃষ্ট হল সেই বিখ্যাত অথবা কুখ্যাত প্রকল্প যার নাম ’ম্যানহাট্রান প্রকল্প ‘ । অনেক কাঠ খড় পোড়ানোর পর অবশেষে ১৯৪৫ খ্রীষ্টাব্দে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটানোর প্রস্ততিপর্ব শেষ হয় । এখন প্রয়োজন শুধু সরেজমিনে পরীক্ষার । প্রথম পারমাণবিক বোমা পরীক্ষার ছদ্ননাম দেওয়া হল ট্রিনিটি । এই নাম করণ থেকেই বোঝা যায় যে ম্যানহাট্রান প্রকল্পের কর্ণধার জেনারেল গ্রোভস ও তার উপদেষ্টাদের মানবিক অন্য যে সব গুণের ঘাটতি থাক , কিন্তু রসবোধের অভাব ছিল না । খৃষ্টান ধর্ম মতে ট্রিনিটি শব্দের অর্থ পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্নার তিন রুপ সমন্বিত ঈশর । লস আলামাস থেকে ১২০ মাইল দুরে অবস্থিত আলামোগোরজে বিমান বেসকে এই পরীক্ষার জন্য উপযুক্ত স্থান হিসাবে অনুমোদন করলেন জেনারেল গ্রোভস । যদিও নিরাপত্তার কারণে এই স্থানটি ছিল যথেষ্ট দুরবর্তী এবং বিচ্ছিন্ন , তথাপি ইতরজনের বিভ্রান্তির জন্য একটি বানোয়াট কাহিনী প্রচার করা হল যে এই বিমান বেস এ সংরক্ষিত জিনিসপত্রে এক অপ্রত্যাশিত বিষ্ফোরণ ঘটে গেছে । প্রথম পারমাণবিক বোমার জন্য প্রয়োজনীয় প্লটোনিয়াম জুলাই মাসের প্রথমেই লস এলামসে পৌচ্ছেছিল । ১২ জুলাই দুপুরে মহামুল্যবান এই বস্তুটিকে আলামোগোরডোতে স্থানান্তর করা হয় । কয়েক ঘন্টা পরেই অপারমাণবিক অংশসমুহকে বহন করে এক সারি গাড়ির মিছিল গন্তব্য স্থলের দিকে রওনা হল । গন্তব্য স্থানটি হল সেই জনমানবশূণ্য মরু অঞ্চল যেখানে এই উদ্দেশ্যে একটি ১০০ ফুট ধাতব টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছিল । এই টাওয়ারের গোড়ায় স্থাপিত একটি তাবুর মধ্যে পরদিন বিচ্ছিন্ন অংশসমুহকে যথাযথভাবে সন্নিবিষ্ট করা হল । সন্ধ্যার মধ্যেই সব কিছুর প্রস্ততি সম্পর্ণ হল , বাকি রইল শুধু বিষ্ফোরক সলতেটি ঢোকানো । পরের দিন সকালে বোমাটিকে টাওয়ারের উপর একটি প্ল্যাটফর্মে উত্তোলন করা হল । বিকাল ৫টার মধ্যে সব প্রস্ততি সমাপ্ত হল । পরীক্ষার সময় নির্ধারিত হল ১৬ জুলাই সূর্যোদয়ের সাড়ে চার ঘন্টা পূর্বে অর্থাৎ রাত আড়াইটার সময় । ১৫ জুলাই মধ্য রাত্রির কিছু পূর্বে এই সময় পরিবর্তন করা হয় । রাত তিনটার সময় গ্রোভস এবং ওপেনহাইমার লক্ষ্য করলেন যে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন । যার কারণে সময় আবারও পিছিয়ে দিলেন । সময় চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত হল সকাল সাড়ে পাঁচটা অর্থাৎ সূর্যোদয়ের এক ঘন্টা আগে । যে পাঁচজন লোক টাওয়ারে বসে শেষ মুহূর্তের কাজগুলি সমাধা করছিলেন তাদেরকে সকাল পাঁচটায় স্থান ত্যাগ করার জন্য আদেশ দেওয়া হল । প্রত্যেকেই তারা নেমে এসে নিজ নিজ গাড়িতে চড়ে বিপজ্জনক এলাকা ত্যাগ করলেন । টাওয়ার এবং তার উপরে অবস্থিত বস্তুটি আলোকিত করার জন্য বিরাট ফ্লাডলাইট জ্বালানো হল । টাওয়ার থেকে মাত্র সতের হাজার গজ দূরে অবস্থিত মূল শিবির । জেনারেল গ্রোভস এই শিবিরে ফিরে আসার দশ মিনিট পর চূড়ান্ত গণনা শূরু হল । সময়ের ব্যবধান যতই কমতে লাগল মিনিট থেকে এসে সেকেন্ডে ঠেকল , আশঙ্কা-উদ্বেগের পরিমাণ সেই তালে লাফিয়ে লাফিয়ে দ্রুত লয়ে বাড়তে লাগল । নিমিষের মধ্যে যা ঘটতে যাচ্ছে তার প্রলঙ্করের সম্ভাবনা সম্বন্ধে এই শিবিরের সকলেই সচেতন ছিলেন । বিজ্ঞানীরা অনুভব করছিলেন যে তাঁদের হিসাব নিকাস সঠিক , আর বোমাটির বিস্ফোরণ তাই অবধারিত । কিন্তু একই সাথে প্রত্যেকের মনের গহনে বেশ জোরালো সন্দেহও লুকিয়ে ছিল । রেডিওতে গণনা যখন ১০, ৯, ৮ এ ভাবে শূণ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন একটি খুঁটিতে ভর করে তিনি কাঠের মত নিশ্চপ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন । নিস্তব্ধ ঘরটিতে ”এখন ” শব্দটি উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথেই কয়েকটি মধ্যাহ্ন সূর্যের আলোর সমান দ্বীপ্তিতে বিদ্যুৎ চমকের মত উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো গোটা মরুভুমি , প্রায় দু’শ মাইল পর্যন্ত দেখা গেল জলন্ত বহ্নিশিখার আলো । এটার রঙ সোনালী , রক্তবর্ণ , বেগুনী , ধুসর এবং নীল । এই আলো নিকটবর্তী পর্বতমালার প্রতিটি শৃঙ্গ , শৈলশিরা এবং তুষারস্তুপের ফাটলকে এমন সুস্পষ্ট ও সুষমার সাথে প্রদীপ্ত করেছিল যা অবর্ণনীয় । প্রত্যক্ষ দর্শনেই যা শুধু কল্পনীয় । মহান কবিরা যে সৌন্দর্যের শুধু স্বপ্ন দেখেছিলেন , এ সেই সৌন্দর্য । কিন্তু তাদের বর্ণনায় এ সৌন্দর্যের রুপ ধরা পড়ে নি । পৃথিবীর এই প্রথম পারমাণবিক বিষ্ফোরণ প্রত্যক্ষ করতে যে সব বিজ্ঞানীরা উপস্থিত ছিলেন তাদের সবারই মোটামুটি একই ধরণের প্রতিক্রিয়া হয়েছিল । ওপেনহাইমার স্মৃতিচারণ করেছেন , “উপস্থিত ব্যক্তিদের কেউ কেউ হেসেছিলেন, কয়েকজন কেঁদে ফেলেছিলেন, তবে বেশীরভাগ ছিলেন স্তব্ধ । পরবর্তী কয়েক ঘন্টায় সংগৃহীত উপাত্ত থেকে জানা গেল যে রকমটি আশা করা হয়েছিল তার চেয়ে অনেক বেশী জোড়ালো হয়েছে বিষ্ফোরণ । গ্রোভস সমরমন্ত্রী স্টিমসনকে জানালেন যে ১৫০০০ থেকে ২০০০০ টন টি. এন. টি –র সমতুল্য বিষ্ফোরণ ঘটেছে । যে ইস্পাতের টাওয়ারটির সাথে বোমাটি বেধেঁ দেওয়া হয়েছিল সেটি প্রচন্ড উত্তাপে বাষ্পীভূত হয়ে গেছে ।
৬টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×