বিগত কয়েক মাসের ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমগুলো অনুসরণ করলে দেখা যায়,ভারতীয় রাজনীতিতে গরুই এখন মুখ্য চরিত্র।সংবাদগুলো সব গরুময়!এতদিন জানতাম প্রাণী জগতের মধ্যে মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ।এখন মনে হচ্ছে,গরুই সর্বশ্রেষ্ঠ।নিরীহ প্রাণী গরুর কোন রাজনৈতিক মতাদর্শ বা ধর্ম নেই।কিন্তু গরুকে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিভেদের পাল্লায় চড়িয়েছে একদল সাম্প্রদায়িক মানুষ। এ বছরেই সেপ্টেম্বর মাস থেকে এখন পর্যন্ত ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা বিশ্লেষণ করলেই এর স্বপক্ষে প্রমাণ পাওয়া যাবে। ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম গরু রপ্তানিকারক দেশ এবং পঞ্চম বৃহত্তম ভোক্তা।ভারতের দুই তৃতীয়াংশ নাগরিকই মাংস খায়।কসাইখানাগুলোও চালায় হিন্দুরা এবং এক সময় হিন্দু ধর্মালম্বীরাই গরু জবাই করতেন (বলি দিতেন) এবং তার মাংস খেতেন।কিন্তু ব্রাক্ষ্মণ্যবাদী বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারতীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গরু আস্তে আস্তে হয়ে ওঠে রাজনীতির অন্যতম একটি অনুষঙ্গ।ঐতিহাসিকতার বিচারে গরু জবাই নিষিদ্ধের দাবিটি ছিল মুলত: ব্রাক্ষ্মণ্য শ্রেণীর দাবী।যে দাবীটি আদতে ধর্মীয় নয়,পুরোপুরি রাজনৈতিক। ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুদের কাছে গরু দেবতা। তাই ভারতে গো- হত্যা ও মাংস ভক্ষণ দুটোই নিষিদ্ধ করেছে বিজেপি সরকার।অথচ গো- হত্যা বন্ধের আইন মুসলিম, খ্রিষ্টান ও নিম্নবর্ণের হিন্দুদের স্বার্থবিরোধী। কেননা এসব জাতির মানুষের সস্তায় আমিষের চাহিদা পূরণ করে গরুর মাংস।
ব্রাক্ষ্মণ্য শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক বক্তৃতায় বলেছেন, ‘গরু নিধন সর্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে।এই নিধন বন্ধ করতে হবে। কিন্তু ২০১৪ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে তিনি কখনোই মুসলিম হত্যার ব্যাপারে মুখ খোলেননি। মনে হচ্ছে মোদির ভারতে একটি গরুর জীবন একজন মুসলিমের জীবনের চেয়ে বেশি মূল্যবান। মোদির রাজনৈতিক আনুগত্য পরিস্কারভাবে বোধগম্য। তিনি এক দশকের বেশি সময় ধরে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর সাথে জড়িত ছিলেন। যাদের প্রধান এজেন্ডাই হলো ১২৫ কোটি মানুষের ভারতকে পুরোপুরি ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করা। এই আরএসএস বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ হিন্দুদের মধ্যে বর্ণ বিভাজন সৃষ্টি ও সহিংসতায় উসকানি দিয়ে মুসলিমদের ওপর সব সময় দোষ চাপায়।ভারতবর্ষের ইতিহাসে সংগঠিত এ যাবতকালের সবচেয়ে প্রাণঘাতী গুজরাট দাঙ্গায় নিহত কমপক্ষে ১০০০ মুসলিমের রক্তে যার হাত রঞ্জিত সেই নরেন্দ্র মোদি তার সারাজীবনের রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা থেকে মনে হয় একটুও বিচ্যুত হননি। তাই নরেন্দ্র মোদীর ব্রাক্ষ্মণ্য হিন্দুত্ববাদী ভারতে গো হত্যা নিয়ে মানুষ ক্রমশ হিংস্র থেকে হিংস্রতর হয়ে উঠছে। গো-হত্যা বন্ধ করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করার ঘোষণা দিয়েছেন দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং।অথচ হিন্দু ধর্মে বা হিন্দু সংস্কৃতিতে আদিকাল থেকে গো-মাংস ভক্ষণ চলে এসেছে।বৌদ্ধ যুগের আগ পর্যন্ত হিন্দুরা প্রচুর গো-মাংস ভক্ষণ করতো। ব্যাসঋষী স্বয়ং বলেছেন, 'রন্তিদেবীর যজ্ঞে একদিন পাচক ব্রাক্ষ্মণগণ চিৎকার করে ভোজনকারীদেরকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন,মহাশয়গণ! অদ্য অধিক মাংস ভক্ষণ করবেন না, কারণ অদ্য অতি অল্পই গো-হত্যা করা হয়েছে; কেবলমাত্র ২১ হাজার গো-হত্যা করা হয়েছে। (সাহিত্য সংহিতা-৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৪৭৬)। বৌদ্ধযুগের পূর্ব পর্যন্ত হিন্দুরা যে প্রচুর গো-মাংস খেতেন ডাঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ প্রণীত “বিফ ইন এনশেন্ট ইন্ডিয়া“ গ্রন্থে, স্বামী ভুমানন্দ প্রণীত 'সোহংগীত', 'সোহং সংহিতা, 'সোহং স্বামী' গ্রন্থগুলোতে, আচার্য্য প্রফুল্ল সেন চন্দ্র রায়ের 'জাতি গঠনে বাধা' গ্রন্থে উল্লেখ আছে। এসব গ্রন্থ থেকে জানা যায়, বৌদ্ধযুগের আগ পর্যন্ত গো-হত্যা, গো-ভক্ষণ মোটেই নিষিদ্ধ ছিল না। মধু ও গো-মাংস না খাওয়ালে তখন অতিথি আপ্যায়নই অপূর্ন থেকে যেতো।
প্রাচীনকালে ব্রাক্ষ্মণ্যবাদী হিন্দুরাও যে গো-মাংস খেতেন এটা নিশ্চিত করেছেন স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ। যার প্রমাণ :গরু-বৃষের মাংস [বেদ:১/১৬৪/৪৩],মহিষের মাংস [বেদ: ৫/২৯/৮],অশ্বের মাংস [বেদ:১/১৬২/৩] খাওয়া হত।আরও বলা হয়েছে পরস্বিনী গাভী মানুষের ভুজনীয় [বেদ:৪/১/৬]।গো-হত্যা স্থানে গাভী হত্যা হত[বেদ:১০/৮৯/১৪]। ইন্দ্রের জন্য গো-বৎস উৎসর্গ করা হয়েছে। [ঋকবেদ:১০: ৮৬: ১৪]। এমনকি উপনিষদ বলছে: ‘বেদজ্ঞান লাভ করতে হলে,স্বাস্থ্যবান সন্তান লাভ করতে হলে ষাঁড়ের মাংস খাওয়া জরুরি।” [সূত্র: বেদ; ২য়প্রকাশ, পৃ: ১৩, ৬৭; হরফ প্রকাশনী, কলিকাতা]।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে যদি গরুর মাংস অথবা গো-হত্যার বিরুদ্ধে কোন গুরুতর বিধানও থাকতো, তবুও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষের উপর তাদের নিজস্ব খাদ্যাভ্যাসকে জোর করে চাপিয়ে দেবার দাবী কিছুতেই সমর্থনযোগ্য হতনা। কিন্ত প্রকৃত ঘটনা এই যে হিন্দুদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ এবং মহাকাব্যগুলিতে গো-হত্যা কিংবা গো-মাংস খাবার বিরুদ্ধে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই।এখন প্রশ্ন হলো-ধর্মীয় গ্রন্থে গো-মাংস ভক্ষণের প্রমাণাদি থাকার পরও ব্রাক্ষ্মণ্যবাদী হিন্দুরা গো-মাংস ভক্ষণ করে না কেন? কেবল মুসলমানরা গরুর মাংস খায় বলে? না। মূল কারণ আমি আগেই বলেছি- রাজনৈতিক। আপনাদের নিশ্চয় মনে আছে,ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্র নেপালে ভূমিকম্পের জন্য কংগ্রেসের ভাইস প্রেসিডেন্ট রাহুল গান্ধীকে দায়ী করেছিলেন বিজেপি এমপি সাক্ষী মহারাজ। ভূমিকম্পের মতো ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় নিয়ে সাম্প্রদায়িক এবং রাজনৈতিক রঙ দেয়ার চেষ্টা করা বিতর্কিত এই বিজেপি এমপির দাবি করেছিলেন, ‘গো-মাংস খেয়ে নিজেকে শুদ্ধ না করেই পবিত্র কেদারনাথ মন্দিরে যাত্রা করেছিলেন রাহুল গান্ধী। তারই ফলে নেপালে ভূমিকম্প হয়েছে!’ যদিও সে নিজে এবং তার দল বিজেপির কট্টরপন্থী, মুজাফফরনগর দাঙ্গার মূল হোতা ও শীর্ষ গরু হত্যাবিরোধী নেতা এবং বিভিন্ন উগ্রবাদী মন্তব্য করার জন্য ভারতজুড়ে ব্যাপক সমালোচিত সঙ্গীত সিং সোম নিজেই একটি গরুর মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানার মালিক! তার কারখানা থেকে বিভিন্ন দেশে গরুর হালাল মাংস রফতানি করা হয়।অথচ তিনি নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আইডিতে ভুয়া গরু জবাই করার গুজব ছড়িয়ে দাঙ্গা বাধান মুজাফফরনগরে।ওই দাঙ্গায় বহু মানুষ মারা যায়।স্ববিরোধিতার এরকম নজির ভারত ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও নেই!! উল্লেখ্য, গরুর মাংস খাওয়া নিয়ে বহু মুসলিমকে হত্যা ও সাম্প্রদায়িক নীতি এবং ভিন্নমতের প্রতি বিজেপি সরকারের অসহিষ্ণু নীতির প্রতিবাদে গত কয়েকদিনে ভারতের বহু উদারপন্থী লেখক সম্মানজনক সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার ফেরত দিয়েছেন।এবং এই পদক ফেরত দেয়ারও তীব্র সমালোচনা করেছেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের (ভিএইচপি) জাতীয় মুখপাত্র সুরেন্দ্র জেইন।
ব্রাক্ষ্মণ্য শ্রেণীর হিন্দু ভাইয়েরা আমার কথায় মন খারাপ করবেন না। আপনাদের ধর্মানুভুতিকে আঘাত করা আমার উদ্দেশ্য নয়। অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অনুভূতির প্রতি আমি সবসময় শ্রদ্ধাশীল।আমি যদি আপনাদের ধর্ম থেকে কোন ভুল অংশ কৌট করে থাকি, কোন বাক্য ব্যবহারে ধর্মের অসন্মান করে থাকি আমাকে দেখিয়ে দিন।আমি সংশোধন করে নিবো। কিন্তু নিজে ধর্মগ্রন্থ না পড়ে শুধুমাত্র ধর্মীয় উষ্কানি আর গুজবের ভিত্তিতে একজন মানুষকে সাপের মত পিটিয়ে হত্যা করা, এটা কিছুতেই সমর্থন যোগ্য নয়।হিন্দু ধর্ম মতে গো -মাংস খাওয়া যাবে কি যাবেনা সেটা আপনাদের ইন্টারনাল ব্যাপার। তা একজন মুসলমানের চর্চার বিষয় নয়। তাহলে আপনারা কেন মুসলমানদের গরুর মাংস খাওয়ার ব্যাপারে ইন্টারফেয়ার করবেন? আপনার ধর্ম মতে গরুর মাংস খাওয়া যাবে কি যাবে না তা নিয়ে যা-ই লেখা থাকে থাকুক,তবে তা শুধু আপনার ধর্মের মানুষের জন্যই প্রযোজ্য হবে, অন্য ধর্মের মানুষ কি খাচ্ছে কি খাচ্ছে না তার দিকে দৃষ্টি দেবার তো দরকার নেই।যার ধর্ম সে পালন করবে অন্য ধর্মের মানুষের উপর তা চাপিয়ে দেওয়া অন্যায়। আপনি যেমন অন্য ধর্ম মতে চলতে চাইবেন না তেমনি অন্য ধর্মের মানুষেরাও আপনার ধর্ম মতে চলতে চাইবে না, সিম্পল ব্যাপার। এই প্রসংগে কেউ কেউ গরু আর শুকরের তুলনা করছেন। আপনাদের যত ইচ্ছা শুকরের মাংস খান। অন্যদের গরুর মাংস খেতে দিন। তারা তো আর আপনাদের গরু চুরি করে খাচ্ছেনা। আপনাদের চোখে গরু ভক্ষন আর মুসলমানদের চোখে শুকর ভক্ষন দু‘টো আলাদা ব্যাপার। আপনাদের কাছে গরু পবিত্র, তাই নিজেরা তো খান-ই না, অন্য ধর্মের কেউ-ও যদি ভক্ষন করে তবে সেটাকেও মেনে নিতে পারেন না । অন্য দিকে ইসলাম ধর্মে শুকর অপবিত্র বলে খাওয়া নিষিদ্ধ । কিন্তু অন্য ধর্মের কেউ যদি খায় তাতে মুসলমানদের কিছু যায় আসেনা। কখনো শুনেছেন শুকরের মাংস খেয়েছে বলে মুসলমানেরা লাঠি নিয়ে ধাওয়া করেছে কিংবা পিটিয়ে মেরে ফেলেছে কাউকে? তাই এই দুটোকে এক করে দেখা হাস্যকর!! যার যা ইচ্ছে খাবে, যার ধর্ম পালন করার সে করবে, যে করবেনা তাকে জোর করে লাভ হবেনা, ধর্ম হল একটা বিশ্বাস যেটা মন থেকে আসতে হয়, মুখ থেকে নয়,জোর করে নয়। জোর করে আর যাই হোক ধর্ম হয়না।
একটা গল্প বলে শেষ করছি।স্বামী বিবেকানন্দের সাথে দেখা করতে এসেছেন ‘গোরক্ষিনী সভার’ এক সদস্য ,হাতে একখানা গরুর ছবি।জানালেন দেশের সব ‘গোমাতা‘দের কসাইয়ের হাত থেকে রক্ষা করা ,রুগ্ন,অকর্মন্য গরুর সেবা করাই সবার ব্রত।স্বামী বিবেকানন্দ বললেন,সে ঠিক আছে।কিন্তু মধ্য ভারতে দুর্ভিক্ষে ন‘লাখ লোক মারা গেছেন,তাদের সাহায্যে আপনারা কিছু করছেন না?লোকটি বললেন,না,তারা শুধু গরুদের জন্যই কাজ করে থাকেন।তাছাড়া দুর্ভিক্ষ হয়েছে লোকের কর্মফলে,তারা কী করবেন ? বিবেকানন্দ বললেন,তবে তো এ-ও-বলা যায় যে,গোমাতারাও নিজ কর্মফলেই কসাইয়ের হাতে মরছেন ! থতমত লোকটি বললেন, তা বটে,তবে কী,শাস্ত্রে বলে,গরু আমাদের মাতা।সহাস্য বিবেকানন্দের জবাব:তা বটে,নইলে এমন কৃতি সন্তান আর কে প্রসব করবেন?
মঙ্গলবার,১৪ অক্টোবর ২০১৫
লণ্ডন, ইংল্যাণ্ড ।