দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এমন ভয়াল সময় আর কখনও আসেনি প্যারিসে।বাগদাদ কিংবা বৈরুতের রাস্তায় যে হামলা নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার, সেই হামলা প্রত্যক্ষ করেছে প্যারিস।প্যারিস আমার প্রিয় শহর।প্যারিসের এই দুর্ভাগ্যের জন্যে আমি মর্মাহত।প্যারিসে সন্তান হারা প্রতিটা মায়ের আহাজারি আর মা হারা প্রতিটা সন্তানের কান্না আমাকে চরম ভাবে ব্যথিত করেছে। তবে এই ব্যথা আমার জন্য নতুন নয়। আমি প্রতিদিন কয়েক বার ফিলিস্তিন, ইরাক, সিরিয়ায় নিহত মানুষের জন্যও এ ধরণের বেদনা অনুভব করি। সাদা -কালো , মুসলিম -অমুসলিম, ধনী -দরিদ্র সবার কান্নার দাম ,সবার রক্তের দাম আমার কাছে সমান। দেশ, জাতি, বর্ণ, নির্বিশেষে প্রত্যেকটি ঝরে যাওয়া জীবনের মূল্য আমার কাছে সমান।তাই বিশেষ কোন রক্তকে বেশি সম্মান বা প্রাধান্য দিতে শুধুমাত্র প্যারিসের ঘটনায় সমবেদনা প্রকাশ করতে মার্ক জাকারবার্গের আ্হ্বানে সাড়া দিয়ে ফরাসী পতাকায় প্রো-পিক বর্ণিত করতে পারলামনা বলে দু:খিত। সিরিয়া ,ইরাক ,লিবিয়া বা আফগানিস্থানের লাখো মানুষের মৃত্যু যাদেরকে কখনো সেই সব দেশের পতাকায় নিজ ছবি বর্ণিত করতে প্রণোদনা জাগায় না।বিশ্বের প্রতিটি মানুষের জীবনহানি যাদের সমানভাবে কাঁদায় না, তাঁদের আজকের মানবতাবোধ মেকি এবং আন্তসারশূন্য।প্যারিসের ঘটনায় আমি শোকাভিভুত হয়েছি অন্তর থেকেই। অন্যায় ভাবে প্রাণ নেওয়া প্রতিটা নরপশুর মতো এই হামলাকারীদেরও আমি সমান ভাবে ঘৃণা করি। আজকের দিনের সমস্ত ঘৃণা শুধু তাদের জন্য।এই ঘোর অমানিশা কাটানোর একটাই উপায়,আর তা হলো পরাশক্তিগুলোর শক্তির খেলা বন্ধ করা। এই সহজ সত্যকে উপেক্ষা করে যতদিন মিথ্যা বাকোয়াজী দিয়ে ঘোলা পানিতে আগ্নেয়াস্ত্র আর তেল, গ্যাসের ব্যবসা চলবে ,ততোদিন চলতেই থাকবে এই অমানিশা আর অকাতরে প্রাণ যাবে নিরীহ মানুষের।
অনেকেই আইএস বা আল কায়েদার দিকে আঙ্গুল তুলেছেন। এক সিরিয়ান অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীর পাসপোর্ট নাকি ঘটনাস্থলে পাওয়া গেছে।আজকাল অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা পাসপোর্ট পকেট এ নিয়ে হামলা করে ,এটা জানা ছিলনা।সিরিয়াতে সরাসরি আক্রমনের জন্য তাদের একটা অজুহাত দরকার ছিল। আর এর ফলে আবার যুদ্ধের বৈধতা তৈরি হবে।দেশে দেশে মুসলিমরা,কত খারাপ এটা আবারও প্রমাণ হবে। ইসলাম ধর্মকেও কাঠগড়ায় দাড় করানো যাবে। আর এই ঘটনার সাথে মুসলিমদের জড়িয়ে দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে লুটপাটকেও হালাল করা যাবে। অথচ ১০ কোটি রেড ইন্ডিয়ান,৬ লাখ এবরেজিন,৩ লাখ নর্ডিক পেগান হত্যা করা হয়েছে ভ্যাটিকানের নির্দেশে। বসনিয়া হার্জিগোভিনিয়ায় ৮ হাজার মুসলমানকে হত্যা করেছে খ্রিস্টান সার্ব বাহিনী।কিন্তু এর জন্য কেউ কি খৃষ্ট ধর্মকে কাঠগড়ায় দাড় করিয়েছেন? ইরাকে ১২ লক্ষ নিরীহ মুসলমান হত্যা কিংবা হিরোশিমা- নাগাসাকির জন্য খৃষ্ট ধর্মকে দায়ী করেছেন? বাবরি মসজিদ ধ্বংস ও ২ হাজার মুসলমানকে হত্যা এবং পরবর্তীতে গুজরাট রায়টে আরো ২ হাজার মুসলমানকে হত্যা হয়েছে কিন্তু কই, কেউ তো হিন্দু ধর্মকে দায়ী করেননি ! ইসরায়েলী ইহুদি জায়নিস্টরা প্রায় প্রতিদিন পাখির মত ফিলিস্তিনি মুসলমানদের হত্যা করছে,কিন্তু তার জন্য কেউ কি ইহুদি ধর্মকে দায়ী করেছেন? অহিংস বানী প্রচারকারী বৌদ্ধরাও মুসলমান হত্যায় পিছিয়ে নেই; কিন্তু কই, তার জন্য কেউ তো বৌদ্ধ ধর্মকেও দায়ী করেননি !সন্ত্রাসী ও জঙ্গি সব সমাজেই আছে, তারা যদি হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান কিংবা ইহুদী হয় তাহলে তাদের ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে কেউ টানাটানি করেনা। ব্যাতিক্রম শুধু মুসলমান আর তার ধর্ম ইসলাম!মুসলমান ধর্মবিশ্বাস আর “জিহাদ্ শব্দটাকে সবচাইতে বেশী ভুল ব্যাখ্যা করা হয়।অথচ ইসলাম ধর্মে অমুসলিমদের সাথেও সহনশীল হতে বলা হয়েছে।অমুসলিমরা যে সমস্ত ঈশ্বরের পূজা করেন তাদেরকে গালি দিতেও নিষেধ করা হয়েছে। যেখানে গালি দেওয়াই নিষেধ সেখানে অমুসলিমদেরকে জিহাদের নাম দিয়ে হত্যা করার প্রশ্নই উঠেনা।ইসলাম ধর্মে আরও বলা হয়েছে ,যে ব্যক্তি কোন নিরাপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করলো সে যেন দুনিয়ার সমস্ত মানুষকে হত্যা করলো। আর যে ব্যক্তি কারো জীবন রক্ষা করলো সে যেন দুনিয়ার সমস্ত মানুষের জীবন রক্ষা করলো্ । প্রকৃতপক্ষে যারা জিহাদের নাম দিয়ে অমুসলিমদের হত্যা করছে তারা মূলত ইসলামের মূলনীতিকে মানেন না। কারণ ইসলাম জিহাদের যে শিক্ষা দিয়েছে সেটা হল আত্মরক্ষার জন্য শত্রুর আক্রমণের বিপরীতে লড়াই করা।আর এই ধরনের লড়াইয়ে বেশ কিছু নিয়মও মানতে হয় । যেমন যুদ্বক্ষেত্রে কোন নারী ও শিশুকে আঘাত না করা, গাছ না কাঁটাসহ আরো কিছু নিয়ম।তাছাড়া পৃথিবীতে মুসলমান আছে ৩০০ কোটির উপরে।ইসলামের অপর নাম যদি সন্ত্রাস হয় এবং মুসলমানরা সবাই যদি সন্ত্রাসী হয় তাহলে মুসলমান হত্যা করে কোন ধর্মের মানুষেরই পৃথিবীতে টিকে থাকার কথা না! প্যারিসের ঘটনায় মূলত ধর্মের কোন ভুমিকাই নেই, ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি হচ্ছে, স্বার্থ উদ্ধার হচ্ছে।তেল ব্যবসা, অস্ত্র ব্যবসা এসবই এই যুদ্ধের আসল কারন। মধ্যপ্রাচ্যে যেদিন তেল গ্যাস ফুরিয়ে যাবে সেদিনই এই যুদ্ব বন্দ্ব হবে। সেখানে আর কোন রকম বিশৃঙ্খলা, যুদ্ধ বা বোমাবাজি হবেনা।
এইমাত্র শুনলাম, আইএস নাকি এই ঘটনার দায় স্বীকার করেছে! আমি বুঝিনা ,আইএস যদি প্যারিসে গিয়ে হামলা করতে পারে তাহলে ঘরের কাছে বাশার বা মালিকীর বিরোদ্বে কেন তারা কিছুই করতে পারছেনা! আমেরিকা, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া জোট সিরিয়ায় আইএসের সাথে লড়াই করে আসছে গত এক বছর ধরে, অথচ এই এক বছরে আইএস এই তিন দেশের কোথাও বড় ধরনের কোন হামলা করেনি।কিন্তু যখনই রাশিয়া সিরিয়ায় আইএস মারার নাম করে মার্কিন মিত্রদের আস্তানা গুড়িয়ে দিচ্ছে তখনই আইএস ফ্রান্সে হামলা করে বসলো।এখন সবাই মিলে বৈঠক করবে , তারপর মানবজাতির বৃহত্তর কল্যানে তারা সিরিয়াকে,ইরাক কিংবা লিবিয়া বানাবে। রাশিয়াকেও সাইজ করা যাবে। আসলে এই হামলা টুইন টাওয়ার হামলার মতো মার্কিনদের পাতানো খেলা ছাড়া আর কিছুই নয়।
টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর আল কায়েদা দায় স্বীকার করেছিল, কিন্ত বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছিল এটা ছিল আমেরিকারই কাজ, আল কায়েদার নয়। প্যারিসের এই হত্যাকান্ড কেন ঘটানো হয়েছে আর নাটের গুরু আসলে কারা তা বুঝতে সামান্য কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। পশ্চিমা বিশ্বের পরবর্তী পদক্ষেপ এবং চূড়ান্তভাবে এর বেনেফিশিয়ারী কে হয় তার মাধ্যমেই বেরিয়ে আসবে প্যারিসের ঘটনার আসল রহস্য।কিন্তু ততদিন পর্যন্ত এর দায় মুসলমানদেরই বহন করতে হবে, অতীতের সব ঘটনার দায় যেমনটা তাদের বহন করতে হয়েছে। ইউরোপে বসবাস করা মুসলমানদের জীবন আরও একটু কঠিন হয়ে পড়লো। এমন উন্নত একটা দেশে এতটা নিরাপত্তার অভাব বোধ করতে হবে,তা কখনও ভাবিনি। এনলাইটেনমেন্ট পৃথিবীর সব ধর্মকে পাল্টে দিতে পারলেও ইসলামকে পারবেনা। এই বিষয়টা পশ্চিমারা যেদিন বুঝবে সেদিন হয়তো বোঝাপড়ার একটা ক্ষেত্র তৈরি হবে।
রবিবার ১৫ নভেম্বর ২০১৫
লণ্ডন, ইংল্যান্ড ।