মুখে এতদিন নানা কথা বললেও এই প্রথম ফেইসবুকসহ কয়েকটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধের প্রতিক্রিয়া লিখেছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের অবৈধ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম এমপি। তিনি লিখেছেন,“লেখাটি আমি, ‘প্রতিমন্ত্রীর জায়গা থেকে লিখছি না”, লিখছি এ দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে- যে দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালোবাসে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেই কিন্তু- চাঁদে কারো মুখ দেখার গুজবে প্রাণ হারিয়েছে বহু মানুষ, আবার একটি পোস্টের কারণে (সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে) বৌদ্ধ বিহারে চলেছে হামলা- আমরা সব ভুলে গেছি।“ লিংক :http://www.banglanews24.com/fullnews/bn/444188.html
তার লেখা মিডিয়ায় আসতে না আসতেই বগুড়ার শিবগঞ্জে শিয়া মসজিদে গুলিতে মুয়াজ্জিন নিহত ও তিনজন আহত হয়েছেন। এখন তিনি কি বলবেন-ফেইসবুক বন্ধ রেখে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমানো গেছে!!?? আমরা ঠিক বুঝতে পারছিনা,ফেইসবুক বন্ধ রেখে তিনি ঠিক কোন প্রক্রিয়ায় আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছেন!!??
তারানা হালিম পাকা অভিনেত্রী।তিনি ভুলে যাওয়ার অভিনয় করলেও, আমরা ভুলিনি। আমাদের মনে আছে, চাঁদে মুখ দেখার গুজব সাতকানিয়ার মসজিদের মাইক হতে ছড়ানো হয় এবং পরে যা মোবাইলের ফোন কলের মাধ্যমে জনে জনে ছড়িয়ে পড়ে।কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনার বদলে তারানা হালিমরা তখন কিভাবে দলীয় নেতা কর্মীদের উস্কে দিয়েছেন,পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছেন তা আমাদের স্মৃতিতে এখনো জ্বলজ্বল করলেও তিনি তা ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেছেন। এবং এই ঘটনায় ফেইসবুক সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধের কথা বলেছেন,মাইক বা মোবাইলের ফোন বন্ধের কথা বলেননি। জনাবা তারানা হালিমের কাছে যদি তথ্য থাকে তাহলে,কারা কিভাবে ফেইসবুক ব্যবহারের মাধ্যমে তান্ডবগুলোর পরিকল্পনা, আয়োজন, সমন্বয় করেছে সে সব তথ্য দিন।কিন্তু কোন তথ্য না দিয়ে এরকম আজগুবি হাওয়া-হাওয়া হাইপথিসিস টানলে মন্ত্রী মর্যাদার তার এবং তার দলের পুঁচকে একজন রাজনৈতিক কর্মীর বিশ্লেষণী ক্ষমতার মাঝে তো কোন পার্থক্য থাকেনা !
একই কথা খাটে বৌদ্ধ বিহারে হামলার ঘটনায়। লোকে বলে,দুর্জনের ছলের অভাব হয়না। শুধুমাত্র রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমনের জন্য যখন আওয়ামী লীগ,ছাত্রলীগ,যুবলীগের কর্মীরা একত্র হয় ঠিক তখন মিথ্যে একটি পোস্ট তৈরি করে বৌদ্ধ বিহার অভিমূখে মিছিল করে স্থানীয় আওয়ামী নেতারা ধর্মানুভূতিতে আঘাতের ধুয়ো তুলে বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা চালায়। এই ছলের আয়োজন তারা নিজেরাই করেছিলো।ফেইসবুক না থাকলেও এই ঘটনা তারা ঘটাতই! এমনি ছিল হাই-কমান্ডের নির্দেশ! তারানা হালিম তো এমনটা বলবেনই,কারন তিনিও তো সেই একই ঝাঁকের কই!!
লেখায় তিনি দাবী করেছেন,ফেইসবুক বন্ধ করায় মানুষ বেঁচেছে। আসলে অনেক বেশি মানুষ মরেছে। ‘জরুরী রক্তের প্রয়োজন’, ‘একজন পরিত্যাক্ত নবজাতককে বাঁচান’ এই রকম ফিডগুলো বন্ধ থাকায় অনেকেই জরুরী রক্তের অভাবে মরেছে,সহযোগীতার অভাবে মরেছে। তিনি লিখেছেন—‘প্রতিমন্ত্রীর জায়গা থেকে লিখছি না”, লিখছি এ দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে...”। এ কথাটি কেন লিখেছেন? এ দেশের একজন সাধারণ নাগরিক কি ফেইসবুক বন্ধ করার মত ক্ষমতা রাখেন? মহা ফ্যালাসি ! উন্নত দেশগুলোতে কোন মন্ত্রী এমন ফ্যালাসি ক্যালাসি করলে ফট করে মন্ত্রীত্ব চলে যায়! ভাগ্যিস তিনি বাংলাদেশের মন্ত্রী!
তিনি বহুদেশের নিরাপত্তার কারণে ইন্টারনেট বন্ধ করার কথা লিখেছেন, কিন্তু তিনি হয়তো জানেন না, নর্থ কোরিয়ার নিজস্ব ইন্টারনেট আছে ।আর আমাদের দেশের শতকরা একশ ভাগ মানুষ কিউবা বা নর্থ কোরিয়ায় মত হতে চায় না, এটা নিশ্চিত বলতে পারি। চীন এর ফেইসবুক বন্ধের কথা যদি বলেন,তবে তার জানা উচিত চীনের কারণটা নিরাপত্তা না, কারণটা বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক। আর চীনে ফেইসবুক বন্ধ থাকলে কী হবে, ওদের দেশের নিজস্ব সোশ্যাল নেটওয়ার্ক আছে আর এই সোশ্যাল নেটওয়ার্কগুলো যতটা উন্নত, ফেইসবুক এখন পর্যন্ত ততটা উন্নত নয়।
আর পুলিৎজার পুরষ্কার পাওয়া সেই ছবির গল্প তিনি কোথায় পেয়েছেন,তা একমাত্র তিনিই জানেন।তিনি লিখেছেন,পুলিৎজার পুরস্কার পাওয়া এক চিত্রগ্রাহক একটি ছবি তুললেন ক্ষুধার্ত এক শিশু এবং তার মুখোমুখি একটি শকুনের। ছবি হিসাবে অসাধারণ। তার সামনে ২টি বিকল্প ছিল- হয় তিনি ছবিটি তুলবেন, নয়তো শিশুটিকে দ্রুত তুলে নিয়ে নিকটবর্তী হাসপাতালে যাবেন। তার কাছে প্রথম বিকল্পটি আকর্ষণীয় মনে হলো। তিনি তুললেন অসাধারণ ছবিটি। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে শিশুটি মারা গেল। চিত্রগ্রাহক পেলেন “পুলিৎজার পুরস্কার”। কর্মের এক বিরল স্বীকৃতি। কিন্তু বিবেক তাকে তাড়া করলো সর্বক্ষণ- “যদি তখন ছবি না তুলে শিশুটিকে তিনি নিয়ে যেতেন নিকটবর্তী অস্থায়ী চিকিৎসাকেন্দ্রে, অন্তত বাঁচাবার চেষ্টা তো করতে পারতেন”! অনুশোচনায় আত্মহত্যা করলেন তিনি।হায় স্যালুকাস! যেখানে আজ পর্যন্ত দুনিয়ার কেউ জানে না শিশুটির পরিনতি কি হয়েছিলো,সেখানে তিনি কিভাবে জানলেন শিশুটি মারা গিয়েছিলো!এই বাচ্চাটার বাবা-মা বাচ্চাটাকে সেখানে রেখে কাছেই একটা রিলিফের ফুড ট্রাক থেকে খাবার সংগ্রহ করেছিল। এই ফাঁকে শকুনটা নেমে এসেছিল। ফটো জার্নালিস্ট কেভিন কার্টার কাছাকাছিই বসেছিলেন। শকুনটা নেমে আসার পর কয়েকটা ছবি তোলে শকুনটাকে তিনি তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এরপরও প্রশ্ন উঠেছে কেন সে বাচ্চাটাকে ধরেনি? কারণ ছোঁয়াচে রোগের কারণে ঐ সময়ে সাংবাদিকদের উপর নিষেধাজ্ঞা ছিলো কোন বাচ্চাকে হাত দিয়ে ধরার। কেভিন এই ছবির জন্য পুরষ্কার পেয়েছিল এটা সত্যি হলেও এই ছবির ঘটনার জন্য সুইসাইড করেছে এটি সত্য নয়। অত্যাধিক দুর্বল সেই শিশুটির ছবি তুলে সেখানে প্রায় বিশ মিনিট বসেছিলেন মাদকাসক্ত ও নানা মানসিক সমস্যায় জর্জরিত চিত্রগ্রাহক কেভিন কার্টার। তার আত্মহত্যার সাথে উপরোক্ত ঘটনার কোন সরাসরি যোগসূত্র নেই।কেভিনের সুইসাইড নোটই যার প্রমাণ।“I am depressed … without phone … money for rent … money for child support … money for debts … money!!! … I am haunted by the vivid memories of killings and corpses and anger and pain … of starving or wounded children, of trigger-happy madmen, often police, of killer executioners … I have gone to join Ken [recently deceased colleague Ken Oosterbroek] if I am that lucky.”
আসলে এ কাহিনী বলে তিনি নিজেকে এক মহীয়ান স্তরে নিয়ে যাওয়ার ব্যার্থ চেস্টা করে অনুযোগ করেছেন,আমরা বড় বেশি কঠিন, কঠোর হয়ে গেছি- তাই মানুষের জীবন বাঁচানোর চেষ্টাকারীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছি,ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করছি!
আহারে! মানুষের জীবন বাঁচানোর অজুহাতে তারা যদি আরও কোন মৌলিক অধিকার হরণ করেন তবুও আমাদের তাদেরকে বাহবা দেওয়া উচিত্।চুপ করে থাকা উচিত।তবে তিনি মায়াকান্নার ভান করে প্রকারান্তরে এ কথা স্বীকার করে নিয়েছেন যে, অবৈধ সরকার ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের নির্দেশেই তিনি আমাদের গলা টিপে ধরেছেন! যাহোক, আমরা জানি স্বৈরাচারী সরকার সবসময়ই গনমানুষের কণ্ঠে ভীত থাকে। তারাও নানা রকম ভীতিতে আছেন। না হলে ইন্টারনেট আজ যেখানে চিন্তা ও বিতর্কের এক ব্যাস্ত জনপথে পরিনত, তারুণ্যের চিন্তার মুক্তির দারুন সব পর্ব যখন ঘটে যাচ্ছে, পুরো বিশ্বের সাথে আমাদের তারুন্য যখন একীভূত হচ্ছে, সেখানে পুরো ইন্টারনেট জুড়ে সরকারী নিয়ন্ত্রন, কণ্ঠরোধে মাথা ব্যাথা সারাতে মাথা কেটে ফেলারই তো নামান্তর। জঙ্গীদের নিজস্ব আভ্যন্তরীণ নেটয়ার্কের কোন সীমা নেই। সরকার ভাইবার বন্ধ করেছেন, জঙ্গীরা হয়তো টেলিগ্রাম,স্কাইপে করেছে। ‘লাইন’,গ্রুপমি, ‘কিক’,‘কাকাওটক’,চ্যাট-অন, উইচ্যাট নামে আরও কত কি যে রয়েছে! নিরাপত্তা বাহিনী আর কতগুলি বন্ধ করবে? তার চাইতে নিরাপত্তা বাহিনীকে আধুনিক প্রযুক্তিতে প্রশিক্ষিত করা ভাল না! আমরা এতই অভাগা যে, টেলি যোগাযোগের মত একটা গুরুত্বপুর্ন জায়গায়, আইনের ডিগ্রী আর অভিনয় করার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একজন মানুষ কে দেখতে হয়!!
অবৈধ মন্ত্রী তারানা হালিম তার অভিনয় কুশলতার চুড়ান্ত ব্যাবহার করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করার নাটক না করে যে মাধ্যম ব্যবহার করে সরকারী দল বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ধরে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করছেন, গুম করছেন,বিচারের নামে প্রহসন করছেন,সারাদেশে সন্ত্রাস,ঘুষ,দুর্নীতি আর লোটপাটের উতসব করছেন অবিলম্বে সেসব মাধ্যম বন্ধ করলে ভাল হয়।সামজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধের যে অজুহাত তিনি দিয়েছেন তা যে কতটা অসার বগুড়ার শিবগঞ্জে মসজিদের অভ্যন্তরে মর্মান্তিক হামলা চালিয়ে হত্যার ঘটনাই তার প্রমান। দেশে যতদিন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না আসবে ততদিন এসব ঘটনা ঘটতেই থাকবে। এটাই বাস্তবতা। তারানা হালিম আর তার অবৈধ সরকারের উচিত যত শীঘ্র এ বাস্তবতা অনুধাবন করা । এর আগে পাকিস্তানে হলেও বাংলাদেশে কোনো মসজিদে পরিকল্পিতভাবে হামলার ঘটনা ঘটেনি, নামাজ পড়া অবস্থায় হামলার ঘটনাও বোধহয় এই প্রথম।আর মুয়াজ্জিনের হত্যার ঘটনা তো একেবারে অকল্পনীয়। পাকিস্তানেও নতুন করে এ ধরনের ঘটনা আর ঘটছেনা। পাকিস্তানকে তো কথায় কথায় তারানারা খুব গালি দেন।কিন্তু ঠিক ই তারা সবদল মিলে খোলামেলা আলোচনায় একটা রাজনৈতিক পরিসর গঠন করে এবং একটা বৈধ সরকারের অধীনে এইসব সহিংসতা,বোমাবাজি কমাতে কমাতে স্থিতিশীলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আর আমরা ক্রমশ: পাকিস্তানের পুরনো সহিংসতা আর বোমাবাজির জীবনে ঢুকছি। সামনের দিনগুলো কি ভয়াবহ হতে যাচ্ছে চিন্তা করতেই গা শিউরে উঠছে।
শুক্রবার ২৭ নভেম্বর ২০১৫
লণ্ডন, ইংল্যান্ড ।