শিরোনাম দেখে আপনারা যারা ভাবছেন, আমি একজন কট্টর ভারত বিরোধী মানুষ, প্লিজ, আমাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিন। আমি একজন কট্টর দেশপ্রেমিক মানুষ। তাই আমার ভারত বিরোধীতার অসংখ্য কারন আছে। আন্ত:নদী সংযোগ, বাণিজ্য ঘাটতি, সীমান্ত হত্যা, অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ, পার্বত্য অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদদ, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন সহ মরন ফাঁদ ফারাক্কা চালু করে জাতির প্রতি বছর অর্থনীতিতে ২৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি করা ,বাংলাদেশের ভূমি বিনে পয়সায় ব্যবহার করে নিজেরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক ভাবে এককভাবে লাভবান হওয়া,সীমান্তে মাদক ও ফেন্সিডিল কারখানা দিয়ে দেশের সবচেয়ে মেধাবী কয়েকটি প্রজন্মকে ধ্বংস করে দেয়া এবং ঢাকায় অপেক্ষাকৃত একটি দুর্বল সরকার প্রতিষ্ঠার মাত্র এক বছরের মাথায় তার সকল স্বপ্ন পূরণের পথে একধাপ এগিয়ে যাওয়া। এর প্রত্যেকটির ব্যাপারে একজন দেশপ্রেমিকের সোচ্চার হওয়ার অবকাশ আছে। কিন্তু এসব এড়িয়ে গিয়ে যারা ১৬ই ডিসেম্বর নিয়ে ভারতের উচ্ছাসের বিরুদ্ধে আমার অবস্থান নেওয়ায় ভারতের হয়ে মাতম করছেন তাদের জন্যই এই পোস্টের অবতারনা।
প্রিয় ভাইয়েরা-বোনেরা আমার ,এই ইস্যুতে আমি ভারতের বিরোধীতা করছি আমাদের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে। এক্ষেত্রে ছাড় দেব কিভাবে??!! ১৯৭১-এ ভারতের সাথে আমাদের কৌশলগত ঐক্য হয়েছিল। এর বেশী কিছু নয়। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ এই কৌশলগত ঐক্যকে দাসখত বলে মনে করলেও আমি তা মনে করিনা।বরং আমি মনে করি ১৯৭১-এর প্রেক্ষাপটে আমরা ভারতের কাছে যতটুকু ঋণী ভারতের আমাদের কাছে ঋণ তার থেকে কম নয়। হাজার বছরের প্রতিশোধ নেওয়ার মোক্ষম সুযোগটি ভারতকে আমরা করে দিয়েছি। এবং তা বোঝা যায় সে সময় দেয়া পার্লামেন্টে ইন্দিরা গান্ধীর -“হাজার সালকি বদলা লিয়া“ বক্তব্যে থেকে। আমাদের ছিলো স্বাধীনতার যুদ্ধ আর ভারতেরটা ছিলো আক্রমণের প্রতিক্রিয়া যুদ্ধ – বা প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধ। অর্থাৎ ভারত অংশ নিয়েছিল নিজেদের স্বার্থেই।বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ভারত অর্থনৈতিক, সামরিক, কৌশলগত ও আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক লাভবান হয়েছে। এ কারণে দেশটি তার নিজের স্বার্থে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ত হয়, আমাদের স্বার্থে নয়। আর বাংলাদেশের কারণেই ভারত পাকিস্তানের সাথে ৪টি যুদ্ধের মধ্যে শুধু এক বারই বিজয়ী হয়েছে।সুতরাং ১৯৭১-এ ভারতের মহানুভাবতারও খুব একটা জায়গা নেই। দেশের ভেতরে বিভিন্ন স্বাধীনতাকামী জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে কাশ্মীরীদের প্রতি ভারত সরকারের নির্মম আচরণই তার প্রমাণ।
মুক্তিবাহিনী এবং সারাদেশের মুক্তিকামী মানুষের নিরন্তর আঘাতে যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত, তখনি ভারত তাতে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। গঠিত হয় ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিয়ে “যৌথ কমান্ড“। ৩ ডিসেম্বর বিকেলে ভারতের বিভিন্ন বিমান ঘাটিতে আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এই যুদ্ধ চলে দুটো ফ্রন্টে। পূর্ব ফ্রন্টে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হয় মিত্রবাহিনী। আর পশ্চিম ফ্রন্টে শুধু ভারতীয় বাহিনী। পূর্ব ফ্রন্টে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পন করে। জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশ। তাই এই অংশের লড়াই লিবারেশন ওয়ার অব বাংলাদেশ বা বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ বলে উল্লেখিত । যার ব্যাপ্তি ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর। পশ্চিম ফ্রন্টে যুদ্ধ শেষ হয় ১৯ ডিসেম্বর। তাই ৩ ডিসেম্বর থেকে ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত দ্বিতীয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ (প্রথমটি ১৯৬৫ সালে) বলে উল্লেখিত।
তাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ মোটেও ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ নয়। এমনকি গৃহযুদ্ধও নয়। কারণ আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা এবং সরকার গঠিত হওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তানের অস্তিত্ব আনুষ্ঠানিকভাবেই বিলুপ্ত হয়। প্রসঙ্গত বলতে হয় গত শতকে শুধু বাংলাদেশই আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়। গোটা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের পর দ্বিতীয় এবং একমাত্র দেশ হিসাবে। তাহলে ভারতীয়রা কেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে তাদের দলিল দস্তাবেজে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ হিসেবে তাদের নাগরিকদের কাছে বার্তা পৌঁছাবে? কেন বর্তমান ভারতীয় ক্ষমতাসীন দল বিজেপির পেইজ সহ ইন্ডিয়ার অন্যান্য পেইজগুলো এটা ইন্দো-পাক যুদ্ধ বলে দাবী করে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উদযাপন করবে?! কেন ইন্ডিয়া টুডে বলবে, এইদিনে পাকিস্তান ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। কেন তাদের কোন কথায় বা লেখায় বাংলাদেশের নাম থাকবেনা,স্বাধীনতার কথা থাকবেনা,লক্ষ শহীদের আত্মদানের কথা থাকবেনা?!
লক্ষ শহীদের আত্মদানের বিনিময়ে অর্জিত যে স্বাধীনতা কেন তার এতবড় অপমান!? কেন আমার দেশের শহীদদের এতবড় অবমাননা!? আমি এর বিরোধিতা করায় আপনারা যারা ভারতের হয়ে মাতম করছেন,তারা দয়া করে বলুন, ভারতের কাছে এই ধৃষ্টতার জবাবদিহিতা চাইবার মত স্বাধীনতা কি আমাদের আছে? ভারত দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র সাম্রাজ্যবাদী দেশ, এই দেশটির সঙ্গে যেকোনও ধরনের সম্পর্ক বহুভাবে চিন্তা করার অবকাশ থাকে। এ অঞ্চলে একমাত্র ভারতই প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য সার্বভৌমত্বের হুমকি হয়ে আবির্ভুত হয়েছে। স্বাধীন দেশ সিকিমকে টপকরে গিলে ফেলেছে। ভুটান থেকেও নেই। মালদ্বীপকে করোদ রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। তাদের কোনও সেনাবাহিনী রাখতে দেয়নি। শুধু পুলিশ, সেই পুলিশই মালদ্বীপে ভারতের ইন্দনে সামরিক ক্যু সংঘটিত করে।নেপালের কোনও সামুদ্রিক বন্দর না থাকায় তারাও ভারতের ওপর অনেকখানি নির্ভরশীল। দিল্লি সরকারের আজ্ঞা পালনে কিছুটা ব্যত্যয় ঘটলে, নেপালের আমদানি-রফতানি বন্ধ করে দেয় ভারত !! তাই সাধু সাবধান!!
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ যুদ্ধের সমাপ্তি ত্বরান্বিত করেছে এবং আমরা তা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করি। তার মানে এই নয় যে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে কেউ ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ দাবি করবে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে অপমান করে কেউ দাবি করবে তারা এই দেশের জন্ম দিয়ে গেছে, আর আমরা বসে বসে আঙ্গুল চুষেছি, তখন চুপ করে থাকবো? নোবডি পয়েন্টস দ্য ফিঙ্গার এট আওয়ার লিবারেশন ওয়ার। কেউ ম্যানিপুলেশন করতে পারে না আমাদের ইতিহাস। কড়া প্রতিবাদ চাই রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে।রাষ্ট্রের সব থেকে উপরের মহলের প্রতিবাদ।আমার জায়গা থেকে আমি এর প্রতিবাদ করছি। ৯ মাস পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পর ভারত যখন প্রচার করে এটা ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধ,এটা আমার অহমে আঘাত দেয়। তাই আমার মনে হয় না আর মিন মিন করার কোনো উপায় আছে। ইতিহাস বর্গা দেই নাই, যে যার খুশি মত তা বদলাবে।আমরা হতে পারি খুব ছোট্ট একটা দেশ, কিন্তু আমাদের অহম ভারতের ভূমির আয়তনের থেকেও বড়।’
নোট: আমাদের পূর্ব পুরুষেরা ব্রিটিশ কলোনি ধংস করেছে; পাকিস্তানী কলোনি ভেঙ্গে দিয়েছে।কিন্তু বাংলাদেশকে ক্রমশ:ই কলোনিতে পরিণত করা ভারতকে আজকের আমাদের প্রজন্ম বরদাস্ত করে কিভাবে?!
শুক্রবার ১৮ ডিসেম্বর ২০১৫
লণ্ডন, ইংল্যান্ড ।