"এই জমিন অ্যাখোন হামার, এই মাট্টি অ্যাখোন হামার। এ মাট্টিতে পুতা আছে হামার চৌদ্দপুরুষের লাশ । হাফনারা তো লিক্খা পড়হা জানা বাবু আছেন গো সাব ,হিসাব রেখেছেন কোনোহ---এ মাট্টি হামার মা , জান দিয়েংগা মাট্টি দেব না।"
“২৩ কেজি চা পাতা তুললে ৬৯ টাকা পাই! এই স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের মজুরি! তোমরা আমাদের উন্নয়ন শেখাও? ইউরোপ আমেরিকা পড়া উন্নয়ন শেখাও? আমরা আমাদের উন্নয়ন বুঝি না? আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটাবা তোমরা? ৪৪ বছর তোমরা উন্নয়ন দেখাচ্ছো। কঙক্রিটের রাস্তা আর বিল্ডিং এর উন্নয়ন। আমাদের মাটি নষ্ট করলা, বীজ ধ্বংস করলা, পানি-নদী সব শেষ করে তোমরা উন্নয়ন শেখাও? নিজের হাতে ১২৫ বছর চাষ করা আবাদী জমিতে আমার খাদ্য নষ্ট করে তোমরা কাগজের টাকা বানাবা। আমরা হবো তার মেশিন? হবিগঞ্জ উন্নয়ন বুঝে না, সব ঢাকা বুঝে? তোমাদের গলায় কাগজ ঠেসে ধরবো! সে তোমাদের উন্নয়ন পুঁথির কাগজ হোক আর টাকার কাগজ হোক। না পানি, না ভাত, তোমাদের শুষ্ক গলা কেবল কাগজ গিলবে, আরো শুষ্ক থেকে শুষ্ক হবে...!“
এ সপ্তাহে ঢাকায় যখন 'বিজয়' উৎসবে ভারতীয় জেনারেলরা বাংলাদেশীদের 'শেষযুদ্ধ'-এর বীরত্বপূর্ণ গল্প শোনাচ্ছেন আর 'জাতীয়' মিডিয়া যখন আবেগমথিত এসব কাহিনী বাজারজাত করছে তখন হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে নিজেদের আবাদি জমি রক্ষায় হাজার হাজার চা শ্রমিক এক নজির বিহীন গণজাগরণ মঞ্চ গড়ে তুলেছে। লাগাতার সাতদিন ধরে জমির উপর সেই প্রতিবাদ চলেছে। শ্রমিকরা সিলেটে মানববন্ধন করছে, স্মারকলিপি দিয়েছে। কিন্তু ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার ছাড়া আর কোন জাতীয় গণমাধ্যমে তার কোন উল্লেখযোগ্য ছাপ নেই। সাংবাদিকতা ক্রমেই বাংলাদেশের জন্য বিপদজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা সংবাদ হওয়ার যোগ্য তাকে তারা সংবাদই মনে করছে না।কর্পোরেট বানিজ্যে পরিণত হয়েছে আমাদের সাংবাদিকতা। কালো টাকা আর লুটেরা বণিকদের বাগানে জন্ম নেয়া মিডিয়া বরাবর এমনটাই করছে আর বস্তুনিষ্ঠতা,সততা,দেশপ্রেমের ধ্বজাতুলে নাচছে ! বামপন্থি-ডানপন্থিরাও প্রায় সকলে চা শ্রমিকদের এই যুদ্বে অনেকটা নীরব ভুমিকা পালন করছে।
আসলে আমরা এখনো খাবার পাই বলেই ভাবি না, টাকা, ফ্যাক্টরি, উন্নয়নে এগুলো খাওয়া যায় না। ধরুন কোন জাদু বলে দেশের কৃষকরা যদি সিদ্ধান্ত নেয় যে, 'তোমরা আমাদের সেবা করার নামে ২০ কোটি টাকার গাড়িতে চড়ো আর আমরা দিনে ১৮ ঘন্টা পরিশ্রম করেও ৩ বেলা খেতে পাই না। এবার আমরা যে ফসল ফলাব, তা জমিয়ে রাখব। প্রতিদিন ১ বেলা খাব। শাড়ি লুঙ্গি যা আছে তা দিয়েই চলব। সন্তানদের স্কুলে পাঠাব না। এবং আগামী ২-৪ বছর কোন ফসল ফলাব না। আমরা দেখতে চাই, গাড়ি -বাড়ি স্মার্টফোন ,টিভি- ফ্রিজ ,ইন্টারনেট খেয়ে তোমাদের পেট ভরে কিনা?' তখন আমাদের অবস্থা কি হবে !?
১২৫ বছর আগে হবিগঞ্জের চাদপুর, রামগঙ্গা আর বেগম খান চা বাগানের পতিত জঙ্গলময় জমি কেটে আবাদযোগ্য করেছেন, চা বাগানের প্রান্তিক শ্রমিক ও তাদের পূর্বপূরুষ,ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী: রাজবংশী, সাঁওতাল, মাঝি, রবিদাশ, ওরাওঁ সম্প্রদায়ের মানুষেরা । কয়েক প্রজন্ম ধরে ধান চাষ করছেন এ জমিতে। এখন বলা হচ্ছে সে জমি তাদের নয়। কাগজে কলমে সে ধানী জমি ডানকান ব্রাদার্সের কাছে লিজ দেয়া হয়েছে । তাই আপাতদৃষ্টিতে এই জায়গা ডানকানের হলেও সরকার এই জমি নিয়ে নিচ্ছে 'পতিত জমি' হিসেবে চিহ্নিত করে। ডানকানও সরকারের সংগে বিবাদে যাচ্ছেনা,কারণ লিজের শর্ত অনুযায়ী সরকার এরূপ জমি কোম্পানির কাছ থেকে নিয়ে নিতে পারে। তবে সরকার পতিত জমি বলে অধিগ্রহন করলেও বাস্তবে এটা পতিত জমি নয়। এই জমিতে চা শ্রমিকরা ১৫০ বছর ধরে চাষাবাদ করছে ।দাসোচিত জীবনে পড়ে থাকা চা শ্রমিকরা যে বাগানে দৈনিক ৬৯ টাকা অবিশ্বাস্য মজুরির হার সত্ত্বেও টিকে থাকতে পারছে তার কারণ এসব জমিতে কৃষি কাজের সুযোগ। সরকার বলছে এখানে স্পেশাল ইকনোমিক জোন (এসইজেড) হবে। তাহলে সে জমির উপর নির্ভরশীল চা শ্রমিক ও তাদের পরিবারগুলোর কি হবে? চা বাগানের সামান্য মজুরি দিয়ে তাদের চলবে কি করে? আর যারা চা শ্রমিক নয় কিন্তু জমির উপর নির্ভরশীল তাদেরই বা কি হবে? না, তাদের সম্মতি বা ক্ষতিপূরণেরও কোন প্রশ্ন নেই, কারণ কাগজে কলমে তো জমি তাদের নয়!!
কৃষি জমিতে শিল্প না করার কত কথা শোনা যায়, কিন্তু এক্ষেত্রে বোধ হয় তা প্রযোজ্য নয়। কারণ তারা চা বাগানের প্রান্তিক শ্রমিক , তারা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী: রাজবংশী, সাঁওতাল, মাঝি, রবিদাশ, ওরাওঁ, ভূমিজ,তারা প্রভাবশালী দখলদার না,তারা চা বাগানের শ্রম দাস না হলে, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী না হলে, সরকারকে তাদের সাথে আলোচনা করতে হতো, তাদের কথা শুনতে হতো । এখন তাদেরকে স্রেফ মিলকারখানায় চাকরির ফাপা প্রতিশ্রুতি দেয়াই যথেষ্ট। কিন্তু তারা তাতে ভুলবেন কেন, কয়েক প্রজন্ম ধরে চাষাবাদ করা জমির অধিকার ছাড়বেন কেন? শ্রমিকরা জানেন,এসইজেড শুরুতে সকল অভাবী এলাকায় কাজের প্রলোভন দেখিয়ে এলেও কৃষি জমি দখল নেয়ার পর জমি হারা মানুষদের কাছে কাজের প্রলোভন মায়া মরিচিকা হয়েই থাকে। তাই তারা সরকারি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে নেমেছে,ধর্মঘট শুরু করেছে, শ্লোগান তুলেছে-“আমার মাটি আমার মা, কেড়ে নিতে দেব না”।
সুদূর অতীত কাল থেকেই এসব অতি দরিদ্র সাধারন জনগণ প্রতারিত হয়ে আসছে। শাসক শ্রেণী নানা চটকদার কথা বলে জনগণের অর্থ লুট করে, জনগণের সম্পদ দখল করে , জনগনের লাশের উপর নিজস্ব স্বাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে।কলকাতার দাবী ছেড়ে দিলে ৩৩ কোটি টাকা পাওয়া যাবে,আর সেই ৩৩ কোটি টাকা দিয়ে ঢাকাকে নিউইওর্ক বানানো হবে; টিপাইমুখে বাধ দিলে পরিবেশ ও জীব বৈচিত্রের কোন ক্ষতি হবেনা; ভারতকে ট্র্যানজিট দিলে যা আয় হবে তাতে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর হবে; রামপালে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে ফ্লাই অ্যাশ বেচেই খুলনাবাসী একেকজন ওয়ারেন বাফেট হয়ে যাবে।আর এখন এই হাল সময়ে যুক্ত হয়েছে চা শ্রমিকদের উচ্ছেদ করে অর্থনৈতিক অঞ্চল হলে সেই অঞ্চলে প্রচুর কর্ম সংস্থান হবে,চা শ্রমিকেরা শুধু ৬৯ টাকা নয়,এর দশ গুন আয় করতে পারবে। এরকম স্বপ্ন দেখিয়ে ,এভাবে মুলা ঝুলিয়ে প্রাচীন কাল থেকেই শোষক শ্রেনী নিজেদের কায়েমী স্বার্থ হাসিল করছে। ঢাকার চার পাশ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মন্ত্রী, এমপি,রাজনীতিবিদ,আমলা ,ব্যবসায়ীরা শত শত একর জমিতে বাগান বাড়ি বানিয়েছে। পর্যটনের জন্য বিখ্যাত কক্সবাজার ,টেকনাফ ,কূয়াকাটা,সুন্দরবনের আশেপাশের অঞ্চলের শত শত একর জমিও তাদের দখলে। অর্থাৎ অল্প কয়েক জনের হাতে বিপুল পরিমান জমি।এবং এর একটা বড় অংশই সরকারি খাস জমি। অথচ নিজেদের দখলে থাকা হাজার হাজার একর অনাবাদি জমি বাদ দিয়ে যে শ্রমিকদের দিনপ্রতি মজুরি মাত্র ৬৯ টাকা,যে জমিতে ধান চাষ করে শ্রমিকরা কোনো রকমে পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকে সেই জমিতে তাদের চোখ পড়েছে। দখলে রাখা শত শত একর জমির উপর গড়া বিলাস বহুল বাগান বাড়িতে সরকারের চোখ পড়ছেনা! অর্থাৎ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার নামে, গরীবের দখলের জমি নিয়ে ধনীক শ্রেনীকেই দেয়ার পরিকল্পনা চলছে। কারণ আমাদের তথাকথিত সরকার এই ধনীক বা লুটেরা শ্রেণীরই প্রতিনিধিত্ব করে, সাধারন জনগনের প্রতিনিধিত্ব করেনা, তাদের স্বার্থ দেখে না।ইতিমধ্যে দখলে থাকা হাজার হাজার একর অনাবাদি জমি বাদ দিয়ে,নানা প্রলোভন দেখিয়ে মহেশখালীর বছরে তিনবার আবাদি কৃষি জমি কয়লা বিদ্যুতের জন্য সরকার অধিগ্রহণ করে ফেলেছে।যে জমিগুলোতে ধান,লবন,চিংড়ি মাছের প্রজেক্ট একসাথে হত। এক বিঘা জমি কম করে হলেও পাচ লক্ষ টাকার কৃষি উৎপাদন হত।এরকম ৩,০০০ হাজার একর কৃষি জমি সরকার দখল করে নিয়েছে এন্টি এনভায়রনমেন্টাল কয়লা বিদ্যুতের জন্য। যারা সরকারের এই অন্যায় -অনৈতিকতার বিরুদ্ধে কথা বলছেন, তাদেরকে 'উন্নয়ন বিরোধী ' বলে গালাগালি করার জন্যে একদল পোষ্য দালাল তৈরি করা হয়েছে।
অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা আমাদের জন্য জরুরী, অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলা হোক।কিন্তু সেটা কিছুতেই আবাদি জমি নস্ট করে নয়।মন্ত্রী,এমপি সহ প্রভাবশালীদের দখলে থাকা হাজার হাজার একর খাস জমি উদ্বার করে সেই জমিতে স্পেশাল ইকনোমিক জোন (এসইজেড) করা হোক। আরেকটি নন্দী গ্রাম না হয়ে হবিগঞ্জ সংকটের একটি নায্য ও সম্মানজনক সমাধান হোক। সহজ সরল গরীব এই সাধারন মানুষের বিরুদ্ধে জুলুম প্রকৃতি সহ্য করবে না। সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হোক।
পুনশ্চ: দুর্বলের প্রতিরোধ বেশীদিন টিকেনা। এই প্রতিরোধ ও বেশি দিন টিকবে না যদি না আমরা সবাই তাদের পাশে দাড়াই। আসুন আমরা সবাই তাদের পাশে দাড়াই।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:৫৫