রাজনৈতিক সম্পর্কের দিক থেকে তারা দু‘জন ছিলেন গুরু -শিষ্য। মুক্তিযুদ্ধকালীন দু‘জনেই দু দেশে অন্তরীন ছিলেন। এবং প্রায় কাছাকাছি সময়েই স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেছিলেন।শিষ্যের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস আছে ,পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাস আছে কিন্তু গুরু‘র কিছুই নেই। শিষ্যকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে সব কিছু থেকে গুরুকে মুছে ফেলার নিরন্তর চেস্টা চলছে!!
৪৭-এ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা, ৪৯-এ আওয়ামী মুসলিম লীগ তথা আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা, ৫২-এ ভাষা আন্দোলন, ৫৪-এ যুক্তফ্রন্টের বিজয়, ৫৭-এ কাগমারী সম্মেলনে পাকিস্তানকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে প্রথম স্বাধীনতার মন্ত্র উচ্চারণ, ৬৯-এ গণআন্দোলন, ৭০-এ নির্বাচন বর্জনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার এক দফা ঘোষণা,৭১-এ মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন,স্বাধীনতা পরবর্তীতে গণতান্ত্রিক আন্দোলন, ৭৬ সালে ফারাক্কা লংমার্চের মাধ্যমে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের বীজ বপন, কোথায় নেই তিনি !! অথচ স্বাধীন বাংলাদেশের সব কিছুতেই আজ তিনি অবহেলিত,নির্বাসিত!!
আজ তাকে বাদ দিয়ে যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর জাতীয়তাবাদের কথা বলে মুখে ফেনা তুলছেন তারা মূলত: আত্মপ্রবঞ্চক। তাদের এ একপেশে আয়োজন সমগ্র জাতিকে হতবাক ও বিস্মিত করেছে।স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা,রাজনীতিবিদ ও গণআন্দোলনের নায়ক, উপমহাদেশের মেহনতি মানুষের কন্ঠস্বর,বৃটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রনায়ক ও পাকিস্তানের শোষণের বিরুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রধান প্রবক্তা মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এ অঞ্চলের সকল নির্যাতিত মানুষের অবিসংবাদিত নেতা।এবং বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক নেতাদের গুরু।জাতীয় জীবনে সকল সমস্যায় যিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।তাকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের কোনো ইতিহাস নির্মাণ সম্ভব নয়।
যারা এই অপচেস্টা করছেন তারা বোধহয় মওলানা ভাসানীকে নিয়ে বহুল প্রচারিত গল্পটা জানেন না বা কখনও শোনেননি-
ইংরেজ বেনিয়াদের শাসন আমল। সারা বাংলায় বন্যার প্রকোপে ধান পাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যা পরবর্তি প্রচন্ড অভাব। বিশেষ করে পূর্ববাংলায় অভাবের পরিমাণ বেশি। মানুষ না খেয়ে অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। এমতোবস্থায় মওলানা ভাসানী অনেকগুলো মহাজনী বড় বড় নৌকা বোঝাই সাহায্য সহযোগীতা নিয়ে এসে হাজির। নৌকার বহর চাপিয়েছে সন্তোষ জমিদার বাড়ি থেকে দুইমাইল পশ্চিমে চাড়াবাড়ি ঘাটে। একটি নৌকায় ভাসান চর থেকে নিয়ে এসেছে সাদা ভুটিয়া ঘোড়া। নৌকা থেকে ঘোড়া নামিয়ে ঘোড়ায় চরে সন্তোষের রাজার বাড়ির দক্ষিণ পার্শ্বের রাস্তা দিয়ে রওনা হয়েছে করটিয়ার জমিদার ওয়াজেদ আলী খান পন্নীর বাড়িতে।
রাজার বাড়ির সামনে পৌছতেই হইহই রইরই করে পাইক, বরকন্দাজ, লাঠিয়ালরা এসে ভাসানীর ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরল। তার কারণ, রাজার বাড়ির সামনে দিয়ে প্রজাদের ঘোড়ায় চরে যাওয়া নিষেধ। লাঠিয়ালরা তাকে ঘোড়া থেকে নেমে হেঁটে যেতে বলল। মওলানা ভাসানী বললেন, এটা কার নির্দেশ?
লাঠিয়াল সর্দার বলল, এটা রাজার নির্দেশ।
ভাসানী মুচকী হেসে বললেন, তোমার রাজাকে যায় কও ভাসান চরের মওলানা ঘোড়ায় চইরাই যাইবো।
একজন লাঠিয়াল দৌড়ালো রাজার কাছে, রাজা রাজ প্রাসাদের দোতালায় বারান্দায় বসা ছিলেন। তাকিয়ে দেখে একে তো যবন, তার উপর লুঙ্গি ফতুয়া পড়া দাড়ি পাগড়িওয়ালা মুসলমান মোল্লা। রাজা চোখ রাঙিয়ে লাঠিয়ালকে বলে দিলেন, যে হুকুম তাই পালন করা হোক।
লাঠিয়াল দৌড়ে এসে বলল, রাজার হুকুম ঘোড়া থেকে নেমে যেতে হবে।
লাঠিয়ালের কথা শুনে মুহুর্তেই মওলানা অগ্নিমুর্তী ধারণ করে গর্জে উঠলেন। বজ্রকণ্ঠে ধমক দিয়ে বললেন, তোর রাজারে যায়া কইস মওলানা ভাসানী পায়ে হাইটা সেই দিন যাইবো যেদিন এই রাজবাড়িতে বেগুনের টাল (বাগান) করবার পারবো। বলেই ঝটকা টান মেরে লাঠিয়ালের হাত থেকে লাগাম খুলে নিয়ে ঝড়ের বেগে ঘোড়ায় চড়ে চলে গেলেন। মওলানার কান্ড দেখে সারা রাজবাড়ি হইচই শুরু হয়ে গেল। রাজার মাথায় যেন বজ্রাঘাত হলো। রাজা মওলানাকে ধরার জন্য হুলিয়া জারী করে দিলেন। কিন্তু ধরতে পারলেন না।
মওলানা ভাসানী তার বজ্রকণ্ঠের ঘোষিত সেই কথা ঠিকই বাস্তবায়ন করলেন। রাজার সমস্ত সম্পত্তি ছিল ওয়াক্ফ সম্পত্তি। একসময় মওলানা ভাসানীর হাতে চলে আসে সম্রাট আওরঙ্গজেবের সইমোহরাংকিত তাম্রপাত্রে লিখিত সেই দলিল। ময়মনসিংহ আদালতে রাজার বিরুদ্ধে মামলা করলেন। মামলায় রাজা পরাজিত হয়ে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে গেলেন। মওলানা ভাসানী রাজবাড়িতে বেগুনের টাল করলেন। তারপর পুরো রাজবাড়ি পায়ে হেঁটে বেড়ালেন। সন্তোষের সেই রাজবাড়িটি বর্তমানে মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
এভাবেই যারা মওলানা ভাসানীকে অপমান করবেন ,অবহেলা করবেন ,ভুলে ভরা ইতিহাস রচনা করে তাকে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করার চেস্টা করবেন ,তাদের কাছে মৃত ভাসানী- জীবিত ভাসানীর চেয়ে অধিক শক্তিশালী হয়ে বার বার ফিরে আসবেন আর “খামোশ“ বলে তাদের বানানো ইতিহাস তছনছ করে সেই ইতিহাসের উপর বেগুনের টাল করবেন। “খামোশ“!!
পাকিস্তানকে প্রথম আসসালামু আলাইকুম বলা, বাংলাদেশের মহান স্বপ্নদ্রষ্টা ,এই মজলুম জননেতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি ৷
শুক্রবার ২২ জানুয়ারী ২০১৬
লণ্ডন, ইংল্যাণ্ড।