সম্প্রতি বাংলাদেশী ফেইসবুকারদের নানা জনের নানা পেইজে নানা বিষয়ে অমুক তমুকের বিশাল উক্তি উদ্ধৃত হতে দেখছি, যার অধিকাংশই আসলে বানোয়াট।" দুঁদে " উক্তি কারকেরা সুবিধামতো নিজেরাই উক্তি বানিয়ে গুঁজে দিচ্ছেন, শেরে বাংলা, ভাষানী, মুজিব, জিয়া, নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, হুমায়ুন আহমেদ, সক্রেটিস, এরিস্টটল, আব্রাহাম লিংকন, ভলতেয়ার,হিটলারের মুখে। রচনার স্বার্থে তারা কখনো রাজনীতি,অর্থনীতি,ধর্ম,সাহিত্য,অধ্যবসায়, কখনো সময়, আবার কখনো মাতাপিতার প্রতি কর্তব্য নিয়েও জ্ঞানগর্ভ উক্তি দিচ্ছেন অনায়াসে। এমনকি মহানবী হযরত মুহাম্মদ [সা:] ও বাদ যাচ্ছেন না এসব উক্তি থেকে। এমন অনেক উক্তি আছে, এমন অনেক ব্যাবহৃত জিনিস আছে যা হযরত মুহাম্মদ [সা:] নামে চালানো হচ্ছে । হাজার হলেও নবীজির কথা। সওয়াবের আশায় সরল বিশ্বাসে অনেকেই তা শেয়ারও করছেন। জ্ঞান-বিজ্ঞান-সংশ্লিষ্টজনের কুকান্ড অন্য যে কারো কুকান্ডের চেয়ে ভয়াবহ রকমের বেশি কুফলদায়ক! কুবুদ্ধিতে মগজ ঠাঁসা এরকম বিদ্বৎজন বাংলাদেশে আছে ,তা জানা ছিলনা!
উপরে সন্নিহিত ছবিটি দেখুন,বেচারা এরিস্টটল, সেই ৩২২ শতকে মারা গেছেন। ইন্টারনেট (১৯৫০ শতক ) সম্পর্কে তার বিজ্ঞ জ্ঞান দেয়ার কোন সুযোগই হয়নি। কিন্তু তাতে কি ডরে বীর?
আরো দু‘টি নমুনা দিচ্ছি। আব্রাহাম লিংকন নাকি তাঁর ছেলের শিক্ষককে একটি চিঠি লিখেছিলেন। লিংকনের নামে বানানো এই ডাহা মিথ্যা চিঠিটির হাজারে হাজার অনলাইন পোষ্ট আছে। এর টাইপরাইটার ভার্শন, হস্তলিখন ভার্শন সবই সহিহ ফেইক! ফটোশপড! বিশ্বসেরা লিংকন গবেষক রজার নর্টন এসব দেখেশুনে অনুরোধ-উপরোধ পেয়ে বহু খোঁজাখুঁজি করেও লিংকনের লেখা এমন কিছুর সন্ধান না পেয়ে বলেছেন—“ I have been asked about this letter before, particularly from folks in India where the letter seems to have the widest circulation. There is no source for it. It is bogus. I have over 280 Abraham Lincoln books, including ‘The Collected Works of Abraham Lincoln,’ and this letter is in none of them. It’s a thoughtful letter but it wasn’t really Lincoln who wrote it.” অথচ ফেইসবুকেই লাখো লাইক-শেয়া্র দেখে কোটি কোটি মানুষের বদ্ধমূল বিশ্বাস এটি লিংকনেরই লেখা। কপি-পেস্ট-শেয়ারের জামানায় এটির এতই প্রচার হয়েছে যে, ভারতের এক প্রদেশ দু’কদম এগিয়ে লেখাটিকে স্কুল পাঠ্যসূচির অন্তর্ভূক্ত করে বসেছে। হায়. সেলুকাস!
লিঙ্ক: Click This Link
http://rogerjnorton.com/Lincoln56.html
তেমনি না জেনে টমাস আলভা এডিসনের গল্পটি যে কত জনকে পোস্ট করতে/শেয়ার দিতে দেখেছি!!
এক বালক স্কুল হতে ফিরে তার মা’কে লেখা শিক্ষকের চিঠিটি দিল। মা সশব্দে পড়লেন—আপনার পুত্র এমনই জ্ঞানী ও প্রতিভাবান যে তাকে শিক্ষাদানের মত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক আমাদের স্কুলে নাই। শুধু আপনিই হ’তে পারেন তার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। মা বালকটিকে ঘরে শিক্ষাদান করতে লাগলেন। সে ছেলেই জগত কাঁপানো বিজ্ঞানী হল। টমাস আলভা এডিসন। বিজ্ঞানী হয়ে এডিসন একদিন সেই চিঠিটি পেয়ে গেল। চিঠিতে লেখা—আপনার ছেলে এতটাই গবেট যে ওকে দিয়ে পড়াশোনা হবেনা; স্কুলে রাখাও সম্ভব নয়।
অনেকেই এটিকে ঐতিহাসিক সত্য ঘটনা হিসেবে জানেন। দুঃখের কথা গল্পটি বানোয়াট। এক দুঁদে গল্পকারের মনের মাধুরি মেশানো কল্পনার রং-রাংতার ফিকশনালাইজেশন। শিক্ষক স্কুল রিপোর্টে শুধু “addled” অর্থাৎ ‘বিভ্রান্তিপ্রবণ’ লিখেছিলেন। এতে মা রেগেমেগে কাঁই হয়ে স্কুলে ছুটে গিয়ে হৈ হল্লা বাঁধিয়ে শিক্ষককে ক্ষমা চাইতে বাধ্যও করেন। বালক এডিসন রিপোর্ট হাতে নিয়ে “addled” লেখাটি দেখেছে। পড়েছে “appled” বা “abbled”। এডিসনের ডিস্লেক্সিয়া বা দর্শনবিভ্রাট ছিল। dকে b বা p, uকে n, wকে M ইত্যাকার দেখা ও বুঝায় ভুল করত। রোগটি তখনো আবিস্কার হয়নি বলে শিক্ষকতো বটেই ডাক্তার হলেও addledই লিখত, এবং তা মোটেই অসম্মান, বিরাগ বা বিরক্তিবশত লিখতনা।
লিঙ্ক: Click This Link
সত্যটা হলো, মা-ই জেদাজেদি করে স্কুলের সঙ্গে অভিমান করে এডিসনকে ঘরে পড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। এডিসন অবশ্য মায়ের জেদ এবং তার প্রতি বিশ্বাসে অভিভুত হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মায়ের মুখ রক্ষা করবেন। তার জীবনীকারদের সকলেই এই এক বিষয়ে একমত, এবং এ বিষয়ে এডিসনের দেয়া অনেকগুলো নির্ভরযোগ্য মুখনিঃসৃত বক্তব্যও আছে।
তবে গল্পটির বাণী হৃদয়গ্রাহী। গল্পের অনুপ্রেরণা নির্দোষ। মা-তো মা-ই; শিক্ষকেরও শিক্ষক ইত্যাদি নানাবিধ অনুভুতিতে ভক্তি-শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়ে আসার মত অবশ্যই! সমস্যা হচ্ছে অতিভক্তিমূলক নৈতিকতাবাদী গল্পগুলো শ্রোতার কমন্সেন্স ও বোধ-বিবেচনা নষ্ট করে দেয়। সমস্যা আরো বাড়ে যখন অনেকেই অতিশ্রুত ও অতিজনপ্রিয় কল্পগল্পগুলোকে ইতিহাস ভেবে বসেন!
ফেইসবুক-অনলাইন আজেবাজে অপজ্ঞানে ভর্তি। শুধুমাত্র ইন্টারনেটে ফেইসবুকে এসেছে বলে, ছাপার হরফে দেখা যাচ্ছে বলে বিশ্বাস করতেই হবে এমন কোন কথা নেই।দয়া করে পোস্ট করার আগে কিংবা শেয়ার দেয়ার আগে শতভাগ নিশ্চিত হয়ে নিন আপনি অপজ্ঞান ছড়াচ্ছেন কিনা!
পুনশ্চ : বাংলাদেশে ফেব্রুয়ারী মাস মানেই ভাষার মাস এবং বই মেলার মাস। সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র এ দেশেই বিশাল সময়ের ব্যপ্তি নিয়ে এই বই মেলার আয়োজন করা হয়।তাই বেশি করে বই কিনুন,বই পড়ুন। মনে রাখবেন বইয়ের বিকল্প ফেইসবুক, টুইটার কিংবা অন্য কোন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নয়।
সোমবার ,১৫ ফেব্রুয়ারী ২০১৬
লণ্ডন, ইংল্যাণ্ড।