হ্যালো, হেডকোয়ার্টার? আমি কর্নেল গুলজার। বিডিআর জোয়ানরা বিদ্রোহ করেছে ! ডিজি স্যারকে গ্রেফতার করেছে। অফিসারদের হত্যা করছে। আমাদেরকে বাঁচান। আল্লাহর দোহাই লাগে এখনই ফোর্স পাঠানোর ব্যবস্থা করুন।
হেডকোয়ার্টারঃ আপনি শান্ত হোন। আমরা এখনই ফোর্স পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রয়ারী বিডিআর বিদ্রোহের দিনে কর্নেল গুলজার ঠিক এভাবেই বাঁচার আকুতি করেছিলেন।কিন্তু হেডকোয়ার্টার থেকে সাহায্য আসছে বলে যে আশ্বাস দেয়া হয়েছিলো ,সেই সাহায্য আর আসেনি। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পায়নি ।
এই সেই কর্ণেল গুলজার, যিনি ছিলেন সারাদেশে বোমা মেরে আতংক ছড়ানো জেএমবির কাছে এক মূর্তিমান আতঙ্ক। বাংলাদেশের জঙ্গী সেনসেশন জেএমবি নেতা শায়খ আব্দুর রহমানকে গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করতে নিজের জীবন বিপন্ন করে টিয়ার শেল আর বুদ্ধির খেলায় যিনি “অপারেশন সূর্যদীঘল বাড়ি” সফলভাবে পরিচালনা করেছিলেন ।
এই যে জঙ্গী রাকিব পালালো , ধরা পড়লো তারপর পয়েন্ট ব্লাংক শুটে মারা গেলো , তার উপর একটা গুলিও না চালিয়ে প্রথম তাকে গ্রেফতার করেছিলেন কর্ণেল গুলজার। সামরিক কমান্ডার সানি সহ জেএমবির তুখোড় দুধর্ষ জঙ্গীরা একে একে যে ধরা পড়লো তার সবটুকুর সাথে ছিলেন কর্ণেল গুলজার। কখনো নিজে ফ্রন্টে গিয়ে , কখনো ব্যাকআপ হিসেবে। র্যা ব এর তত্কালীন এই গোয়েন্দা প্রধান ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে চৌকস এবং বুদ্ধিদীপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের একজন।অথচ কর্ণেল গুলজারের লাশটা যখন নর্দমাতে পরে থাকা লাশের স্তুপ থেকে উদ্ধার করা হয়, তখন এটা কেউ সনাক্ত করতে পারেনি। চোখ দুটো উপরে ফেলা হয়েছিলো।চেহারা বিকৃত করা হয়েছিলো বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে। আর এত গুলি করা হয়েছিলো যে স্বজনেরা লাশ চিনতে পারে নি।ডিএনএ টেস্ট এর মাধ্যমে নিশ্চিত হতে হয় এটাই কর্ণেল গুলজার ,দেশের মানুষের নিরাপওা বিনস্টকারী জেএমবির কাছে যিনি ছিলেন এক মূর্তিমান আতঙ্ক।
কর্নেল গুলজারের মতো একেকজন সেনা অফিসার তৈরী হতে যেখানে যুগের পর যুগ লেগে যায়,সেখানে একদিনেই ৫৭ জন চৌকস সেনা কর্মকর্তা বর্বরতার শিকার হলেন। বিশ্বের ইতিহাসে কোন একটি ঘটনায় এতো সেনা কর্মকর্তার প্রাণ হারানোর দৃষ্টান্ত আর নেই।
বিডিআরের ডিজি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য চেয়েছিলেন। তারা আশা করেছিলেন সাহায্য আসবে। শেষ নিঃশ্বাসটুকু তারা ফেলেছিলেন এই আশা নিয়ে যে এক্ষুণি সাহায্য আসবে। প্রধানমন্ত্রীর জীবনে গৌরব ও সম্মানের মূল্য কতটুকু জানি না। কিন্তু তাদের জীবনে ও দুটোই ছিল সব। তারা প্রতিজ্ঞা করেছিল এ দেশের সঙ্গে, টিল ডেথ ডু আস পার্ট। তারা তাদের প্রতিজ্ঞার মূল্য দিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী দেননি। তিনি সাহায্য পাঠাননি।অন্যায় ও অনিষ্টের দমন করার জন্য যেখানে শক্তির প্রয়োজন সেখানে তিনি অন্যায়ের সঙ্গে আপোস করেছেন, লড়াই করেননি।যে কারনে সেই মর্মান্তিক ঘটনার ৭ বছর পার হয়ে গেলেও,ঘটনার সাথে তাকে জড়িয়ে আজও নানা কথা শুনা যাচ্ছে।
তার অনন্য ‘বিচক্ষণতার‘ সুযোগে হত্যাকারীরা হত্যা, লুণ্ঠন ও নির্যাতনের যথেষ্ট সময় পায় এবং তারপর পালিয়েও যায়। সৈনিক কখনো হতাহতের সম্ভাবনা বুঝে লড়াই করে না। করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, ন্যায়ের পক্ষে। একবার ভাবুন তো, আজ যদি তার ওপর কেউ গুলি চালায় এই সৈনিকেরা কি প্রবাবিলিটির গণিত কষে এগিয়ে আসবে? আক্রমণকারীকে পাল্টা গুলি চালাতে গিয়ে যদি মারা যায় কোনো নিরপরাধ সাধারণ মানুষ – একবারও কি প্রশ্নও করা হবে? তাকে রক্ষা করতে সৈনিকেরা তাদের বুক পেতে দেবে । হিসাব করবে না তারা নিজের জীবনের। তাদেরও প্রয়োজন হয়েছিল- একবার তার সাহায্যের। কিন্তু তিনি হাত গুটিয়ে নিয়েছেন। যে কারনে আমাদের মাথা হেট হয়ে আসে।আমরা সেই অযোগ্য জাতি যারা তাদের বীরদের সাহায্য করার চেষ্টাটুকু করেনি।জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান দেশপ্রেমিক সেনারা ছিলেন আমাদের গর্ব, অহঙ্কার আর সার্বভৌমত্বের প্রতীক। ১৬ কোটি মানুষের চরম আস্থা, বিশ্বাস, সংহতি আর নিরাপত্তার প্রতীক। অথচ তাদেরকেই আমরা নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছি!
উপরন্তু কারা এর পরিকল্পনাকারী, কারা ষড়যন্ত্রকারী, আর কারাই বা উসকানি বা মদদদাতা, এত দিনেও আমরা তাদেরকে খুঁজে বের করতে পারিনি।কোনোরকম পূর্বপরিকল্পনা বা ষড়যন্ত্র ছাড়াই কী করে বিডিআরের সাধারণ সৈনিকেরা আচমকা তাদের সাধারণ কিছু পেশাগত দাবি-দাওয়ার কারণে এভাবে বেছে বেছে সেনাসদস্য ও তাদের পরিবারের লোকজনকে নিমর্মভাবে হত্যা করতে যাবে? এটা কি বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে? পারেনা। কারন এটা কোন বিদ্রোহ নয় এটা স্রেফ বর্বরতা।নিরস্ত্র অফিসারদের এরা খুন করেছে নির্ধিধায়। এরা সৈনিক ছিল না, ছিল কাপুরুষ কিলিং মেশিন। সৈনিক যুদ্ধ করে সভ্য নিয়ম মেনে, শত্রুর মর্যাদা রক্ষা করে, কিলিং মেশিনের সেটা দরকার নেই।
সব সত্য এখনো বের হয়নি, একদিন হবে ইনশাআল্লাহ। সেই সময় হয়তো খুব বেশী দূরে নয়। বাংলাদেশের সার্বোভৌমত্ব প্রশ্নের মূখে ফেলে দিয়েছে যারা, ইতিহাস তাদের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে হিসেব নিবে। ক্ষমা করবেনা।
বৃহস্পতিবার ,২৫ ফেব্রুয়ারী ২০১৬
লণ্ডন, ইংল্যাণ্ড।