'ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাবো'
এই একটা লাইন-ই যথেষ্ট একজন কবি , একজন মানুষকে অমর করে রাখার জন্য! এই একটি কবিতা গোটা একটা জাতির আশাভঙ্গের, জাতীয় আকাঙ্ক্ষার সাথে বেইমানির স্থায়ী প্রতীক হিসেবে ভাষার ইতিহাসে ঠাঁই করে নিয়েছে।
কবি‘র কবিতায় উল্লেখ করা "হারামজাদারা" গলি থেকে উঠে এসে রাজপ্রাসাদ গড়েছেন।"হারামজাদা"-দের চিকিৎসা হয় বিদেশের হাসপাতালে; আর একজন কবি ও মুক্তিযোদ্ধার চিকিৎসা হয় কিনা বিনা পয়সার হাসপাতালে!!
বাংলা কবিতার অন্যতম দিকপাল কবি রফিক আজাদ গত জানুয়ারি মাস থেকেই অসুস্থ ছিলেন। কবি'র উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হবে, এমন নানা টালবাহানা শেষে রাষ্ট্রই কবিকে সোজা মৃত্যুর পথ দেখিয়ে দিলেন। দলীয় প্রমাণ না হলে সেই কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের জন্য এই রাষ্ট্র এখন বধির! রাষ্ট্র কাঠামো এখন এমন এক জঘন্য দুরারোগে আক্রান্ত যে তার কোনো টীকা বা বটিকা নাই!
কবিতা লেখার কাফ্ফারা হিসাবে ৬১ পাতার সাফাই লিখে তখন খালাস পেয়েছিলেন। এবং পরবর্তীতে ব্যক্তিগত ক্ষতি থেকে বাচতে কবিতাটা মিথ্যে প্রণোদনাজাত বলে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করেছেন।কিন্তু তবুও তার শেষ রক্ষা হয়নি,তার কপালে সুচিকিৎসা জুটেনি।বরং কোন এক পুরস্কার গ্রহণের সময়ে তাঁকে শ্লেষবাক্যটা শুনতে হয়েছে, ভাত খেতে পাচ্ছেন তো! কবিতাটাকে মিথ্যে প্রণোদনাজাত বললেও কবিতাটার সত্যকে কখনো অস্বীকার করেননি, এটাই কি ছিল তার অপরাধ!?
১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি যখন ভাষা অন্দোলনে উত্তাল দেশ, রফিক আজাদ তখন মাত্র তৃতীয় শ্রেনীর ছাত্র। ভাষা শহীদদের স্বরণে বাবা-মায়ের কঠিন শাসন উপেক্ষা করে খালি পায়ে মিছিলে নেমেছিলেন এই দ্রোহের কবি। ভাষার প্রতি সেই ভালবাসা, একদিন তাকে নির্মান করে প্রকৃত কবি হিসেবে। হয়ে যান মানুষের কবি।গারো সমাজের প্রতি তীব্র আকর্ষণ বোধ করতেন তিনি। তাঁর পূর্বপুরুষে মান্দি রক্ত মিশে আছে, এমন কথা বহুবার বলেছেন। চোখ কিংবা গোঁফে, চেহারায় তার স্থায়ী ছাপ নিয়েও গর্বিত ছিলেন।
আকাশের মত বিশাল এক হৃদয় ছিল তার। প্রয়াত নাট্যজন সেলিম আল দীন প্রায়ই বলতেন তাঁর সাহিত্যিক অঙ্কুরোদগমের কালে রফিক আজাদের প্রশ্রয় ও পরামর্শের কথা। নাটক রচনায় তাঁর অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ স্বীকার করে এই কবিকে সম্ভ্রমে সম্বোধন করতেন ‘পিতৃপ্রতিম রফিক আজাদ’ হিসেবে।নাট্যজন সেলিম আল দীনের মত অনেক কবি সাহিত্যিকের কাছেই তিনি ছিলেন পিতৃসম।
পাখি উড়ে চ’লে গেলে পাখির পালক প’ড়ে থাকে। ‘প্রতীক্ষা’ কবিতায় কবি রফিক আজাদ লিখেছিলেন, এক শনিবার রাতে খুব ক্যাজুয়ালি/ কোনো বন্ধু ঘোরের মধ্যে গোঙানির মতো/ উচ্চারণ করেছিলো, ‘বাড়ি থেকো/ ভোরবেলা তোমাকে তুলে নেবো।’-ঠিক ঠিক শনিবার ভোরের পর কবি চলে গেছেন কবিতার এক দেশ ছেড়ে অন্য এক কবিতার দেশে।
সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি। সত্যিকারের কবির সংখ্যা আরো কমিয়ে দিয়ে চলে গেলেন কবি রফিক আজাদ। কিন্তু কবি হিসেবে যাদের রেখে গেলেন তারা প্রায় সবাই স্বার্থপর আত্নকথিত স্বরলিপির অসম্পুর্ন 'ব্যজ্ঞনবর্ন'। এখন ভাতের অভাবে তাদের কেউ আর মানচিত্র চিবিয়ে খেতে চায়না। তারা জানে দালালিতে অন্ন আছে! তাই দালালের সংখ্যা দিন দিন যত বাড়ছে,বাংলাদেশ দিন দিন তত কবিশুন্য হয়ে যাচ্ছে!!
'ভাত দে হারামজাদা নইলে মানচিত্র খাবো' এমন দুঃসাহসী উচ্চারণের জন্য কবি রফিক আজাদ হাজার বছর বাঙালির হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন। কবি রফিক আজাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি ।
সোমবার ,১৪ মার্চ ২০১৬
লণ্ডন, ইংল্যান্ড