বড় রাস্তা ধরে কিছুদূর এগিয়ে গেলেই বিশাল লম্বা চওড়া বিল্ডিং গুলো চোখ এড়ায় না কোনো ভাবেই। তবে তার চেয়ে বেশি চোখে পড়ে বোধহয় সকাল সাতটায় দল বেঁধে ঐ বিল্ডিং গুলোর দিকে নাসরিনদের সারিবদ্ধ যাত্রা। কিশোরী,তরুনী,যুবতী সেই মেয়েদের দলের কারো চোখে তখনো একরাশ ঘুম, কারো চোখে ক্লান্তির ছাপ,কেউবা নিত্যদিনের অভ্যস্ততায় বিরক্তে ভ্রু কুঁচকে আছে। যারা নতুন তারা মাস শেষে মাইনের চকচকে নোটের স্বপ্নে বিভোর হয়ে আড্ডায় মত্ত।ঠিক একি দৃশ্য, বিপরীত গন্তব্যে, সময়কাল সন্ধ্যা সাতটা। এর মাঝে নগর জীবনের ব্যস্ততার সাথে বাস্তবতার যাতাকল। মেশিনের চাকার সাথে সময়ের কাঁটা,দুটো যেন প্রতিযোগীতায় মেতেছে। ক্ষনে ক্ষনে ঘেমে উঠে নাকের ডগা, আর প্রতিটা কপাল চুইয়ে পড়া ঘামের বাষ্পে বাতাসের নোনতা ভ্যাপসা গন্ধের পেছনের কাহিনী সবসময়ের মতন পেছনেই রয়ে যায়।
আজ একটু আগেই বের হয়ে গেছে নাসরিন। বহুদিনের পাওনা হাফ ছুটিটা ঠিক সময় মতন কাজে লাগাতে পেরে বেশ ফুরফুরা লাগছে তার। দলছুট হয়ে একা একা বাড়ি ফিরছে সে। বৃষ্টি থামার পর বয়ে যাওয়া মৃদুমন্দ হিম হিম ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটাটা খুব ভালো লাগছে। টিং টিং বেল বাজিয়ে পাশ কাটিয়ে হুশ হুশ করে চলে গেল একটা রিক্সা। কাকভেজা রিক্সাওয়ালার মনেও বোধহয় প্রথম বৃষ্টির আস্বাদনের আনন্দ। শুধু বেল বাজিয়ে ক্ষান্ত না হয়ে ‘হুররররররররররর সাইডে আরেকটু সাইডে, পঙ্খীরাজ আইতাছেরে’বলে চিৎকার করতে করতে হারিয়ে যায় দিগন্ত পানে। প্রতিদিনের পরিচিত কিন্ত একেবারেই অপরিচিত এই শহরের নোংরা সরু গলি দিয়ে প্রথম বার হেঁটে যাবার দৃশ্যটা আজ আর পুরোপুরি মনে করতে পারে না নাসরিন। তবে আজকের প্রতিটি পদক্ষেপের মতন এত আত্নবিশ্বাসী ছিল না সেদিনের হেঁটে যাওয়া। ‘ঐ শালার ভাই, রাস্তা কি তর বাপের? নাকি চউক কান্দে নিয়া গাড়ি চালাস? গায়ের উপ্রে গাড়ি তুইলা দেস।হারামীর দল কুনহানকার।’ ‘আরে আফা, এই বৃষ্টি বাদলার মইধ্যে এত চেতেন কেন?’ আরো কি কি যেন বিড় বিড় করে, বোঝা যায় না, শুধু টিং টিং বেলের শব্দ শোনা যায়, ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়।
মোড়ের দোকানে বখাটেদের দৈনন্দিন আড্ডাটা জমে উঠেছে। বিকেলের আগে আগেই জমে যায় এই আড্ডা। আড্ডা চলে রাত পর্যন্ত। হিন্দী গানের সাথে সিগারেট আর চায়ের ঝড় তুলে বিকেল থেকে এরা অপেক্ষা করে। ক্লান্ত শ্রান্ত মেয়েগুলো কাজ শেষে এই রাস্তা ধরেই ফিরে যায় তাদের ঠিকানায়। লোভী চোখগুলো একটা ভয়ঙ্কর কায়িক শ্রমের মধ্যে দিয়ে যায় এই সময়টাতে। সারি সারি মেয়েদের শরীরের ভাঁজের খোজে উন্মত্ত মাতাল চোখ। ওদের দেখলে বোঝা দায়, এদের লোভটা আসলে চোখের নয়। সেই শুরুর দিকের দিনগুলোতে এই মোড়টা পার হতে ভয়ে অস্থির হয়ে থাকতো নাসরিন। আটঁসাট হয়ে এক কোনায় লুকিয়ে ভিড়ের মাঝে মিশে গিয়েও ওর মনে হতো এরা ওকেই দেখছে। শরীরে একটা ঘেন্না অনুভূত হত। মুখ তুলে একবার তাকাতেই সুলতানের চেহারাটা চোখে পড়ল। সাথে সাথে মুখটাই তেতো হয়ে গেল। মুখভর্তি একদলা থুথু ফেলল সে রাস্তার ধারেই। সুলতানের চেহারার সাথে এই রাস্তার নেড়ি কুত্তাটার বেশ মিল আছে। কুত্তাটার শরীরে কয়টা লোম আছে গুনা যাবে। সারাদিন রাস্তায় বসে কুঁই কুঁই করে, আর ডাস্টবিনে খাবার খোঁজে। সুলতান বারমাসই ভাদ্রমাসের নেড়ি কুত্তা হয়ে এইখানে বসে থাকে। বেশ কিছুদিন নাসরিনের পেছনে ঘুর ঘুর করেছিল এই সুলতান। কয়েকজনকে দিয়ে কুপ্রস্তাব করেছিল। দুয়েকবার রাস্তাও আটকে ছিল। প্রতিবার নাজমা আপারা সুলতানের হাত থেকে ওকে বাঁচিয়ে দেয়। ঠিক একি ভাবে সে এখন আগলে রাখে সুফিয়াকে।
এসব ভাবতে ভাবতে মুদির দোকানের সামনে এসে পড়ে। মুখের তিতকুটে ভাবটা এখনো রয়ে গেছে। সে বুঝতে পারে এটা পুরোপুরি তার মানসিক সমস্যা। তাও আবারো থু থু ফেলল নাসরিন, অন্তত মনের স্বস্তির জন্য।‘ঐ দোকানের সামনে থু থু ফেললি কুন আক্কেলে? ’ ‘দোকান কিনছস বইলা কি সরকারের রাস্তাও কিন্না ফালাইছস নিহি? আমার জিনিষ গুলান দে।’দোকানী চোখে মুখে একরাশ বিরক্ত নিয়ে মনে মনে গালি দিতে দিতে একটা ব্যাগ ধরিয়ে দেয়। ‘ঘি, দুধ, চিনি, চাইল, পান সব দিছস?’ ‘হ।’‘মোমবাতি? আর কয়েল?’ ‘হ দিছি।’ ঘরের কাছাকাছি আসতেই একটু আনমনা হয়ে যায় নাসরিন। হাটার গতি কমে আসে। সে ঠিক করেছিল আজকে কারো সাথে এক্টুও মেজাজ খারাপ করবে না। আজকে তার অনেক মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। আজকে তার জন্য একটা বিশেষ দিন।
একটু বৃষ্টিতেই রাস্তায় কাদা জমে গেছে। পাড়ার ছেলেদের দল মনে হয় আজ একসাথে স্কুল ফাঁকি দিয়েছে। ছোট্ট একটা খোলা জায়গায় দল বেঁধে খেলতে নেমেছে। মাঠের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতেই কিছু কাঁদা ছিটকে এসে নাসরিনের জামায় পড়ল। ঠিক যেন সেদিকে মনোযোগ নেই তার। নির্বিকার ভাবে হাঁটতে থাকে নাসরিন। কিছু সময় আগের কাঠিন্যতা এখন আর নেই। একরাশ চাপা অস্বস্তির নিচে জমাট বেধে গেছে। ঐ যে তার রুমের বন্ধ জানালাটা দেখা যায়। ঝড়-বৃষ্টি-রোদে ঝলসে যাওয়া, ক্ষয়ে গিয়ে উইপোকার বাসা বনে যাওয়া জানালাটা একটি সাধারন দিনমান গল্পের সাক্ষী হয়ে আজ দিনব্যাপী চার দেয়ালের ঘরটিতে রুদ্ধ করবে আলোর চলাচল।
স্যাঁতস্যাতে ঘরটার চেহারাটা পালটে দিয়েছে সে অল্প সময়ের মধ্যেই। ঠিক যেটা যেখানে থাকা দরকার সেটা সেখানেই। চকচকে গোলাপী রঙের চাদরে এক নতুন ঔজ্জ্বলতা। আলোক স্বল্পতায় দুষ্ট মিটিমিটি আলোক বতিটার বিচ্ছুরিত দুর্বল আলোটা যেন রোমান্টিসিজমের বার্তাবাহক। চট করে পরনের কাপড়টা বদলে ফেলে নাসরিন। নীল তার প্রিয় রঙ। নিস্তব্দতার মাঝে কাঁচের চুড়ির রিনরিন শব্দে যেন মায়াবী মাদকতা জাগে। আয়নার দিকে অনেক্ষন তাকিয়ে থাকে নাসরিন। আজকে আয়নার ভেঙে যাওয়া কোনাটা একেবারেই চোখে পড়ে না। পুরো সপ্তাহ জুড়ে ঘামে বিদগ্ধ হয়ে বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে থাকা মেয়েটিকে আজ বেশ দেখাচ্ছে। এপাশ ওপাশ ঘুরে কিছুক্ষন দেখে সে নিজেকে। আয়নায় লাগানো নীল টিপটা তুলে নিয়ে কপালের ঠিক মাঝখানে লাগায় খুব সাবধানে। আরো অনেক মায়াবতী লাগছে তাকে। প্রতিদিনের অগোছালো চলাচলের নিজেকে দেখে আজ নিজেই অভিভূত নাসরিন।
নাসরিন দেখতে ভালো। এই কথাটি খুব ভালো করেই জানে সে। অনেকবার অনেকের কাছ থেকে অনেক ভাবেই শুনেছে কথাটি। আর সে নিজেও বুঝতে পারে,গায়ের রঙ একটু শ্যামলা হলেও সব মিলিয়ে শরীরটা তার বেশ ভালোই লোভনীয়। এই জন্য কম ভুগতে হয়নি তার। সেই ছোট বেলায় বাবার বন্ধু নামক পিশাচ থেকে শুরু করে, এই কাটখোট্টা শহরে কিছু বুঝে উঠার আগেই দিনে দুপুরে রাস্তায় তার বুকে খামচি মেরে পালিয়ে যাওয়া হারামীটার চেহারাটা পর্যন্ত দেখতে পায়নি সে। সহকর্মী থেকে মুদী দোকানদার। রক্তের আস্বাদনে উন্মত্ত লোভী চোখগুলো প্রায়ই তার চোখের সামনে ভাসে। একটা সংসারের স্বপ্ন দেখার সুযোগ কেউ দেয়নি তাকে। কেউ ভালোবেসে এই হাতদুটো ধরে মায়াময় দুটো কথা বলেনি। ভালোবেসে কেউ বুকে টেনে নেয়নি। চোখদুটো ঝাপসা হয়ে আসে বুকভরা অভিমানে। তবে কি শরীরটাই সব? নারীত্বের স্বাদ পেতে তারও ইচ্ছে করে। একটা ছোট্ট সুন্দর সংসার, ফুটফুটে দুটো বাচ্চা ঘর ময় দৌড়ে বেড়াবে। সে খাবারের বাটি নিয়ে বাচ্চাদের পেছন পেছন ছুটবে। ক্লান্তিময় দিন শেষে একবুক গভীর ভালোবাসা নিয়ে ভালোবাসার মানুষটার অপেক্ষা। একটা দীর্ঘশ্বাস নেমে আসে, আর প্রতিধ্বনিত হয় একটা সুন্দর স্বপ্নের অপমৃত্যু। চোখের কোনা বেয়ে টুপ করে গড়িয়ে পড়া এক ফোঁটা চোখের জল কাউকে দেখতে দেয় না নাসরিন।
সিদ্ধান্তটা নিতে তার অনেক কষ্ট হয়েছে তার। একদিন দুইদিনে নেয়া কোনো সিদ্ধান্ত নয়। এই দীর্ঘ সময়ে ঘড়ির কাটার শব্দে তার ঘুম হয়নি বহু রাত। ভবিতব্য আর মানবিকতা, ব্যাকুলতা আর দুর্বলতা, চাহিদা আর প্রাপ্তি, আকাংখা আর বিবেকবোধ, একটা ঘোরের মধ্যে বন্দী সময়। নিজের সাথে নিজের চুড়ান্ত লড়াই। এত শক্ত মনের অধিকারী সে ছিল না কোনোদিন। ছেলেটাকে তার বেশ ভালোই লাগে। ছেলেটার হাত ধরলেই মনে হয় সারাজীবন ধরে রাখি। ছেলেটার ঘামের গন্ধ তাকে জাগিয়ে তোলে এক ভিন্ন আঙ্গিকে। আবার সে এটাও বুঝতে পারে ছেলেটার মধ্যে তার জন্য ভালোবাসা নেই। ওর রক্তপ্রবাহে লোভী স্ফুলিং টের পায় । স্পর্শেই সে বুঝতে পারে তার কামনা বাসনা। তবে ছেলেটি অন্য সব পুরুষের চেয়ে একটু আলাদা। নিষ্পাপ, নির্লোভ চাহনী তার। মায়াময় চোখ দুটোতে লোভী শিকারীকে খুঁজে পাওয়া যায় না। এটা অভিনয় নয়। নাসরিন জানে, শরীরের লোভ আড়াল হয়ে আছে এক অজানা ভয়ে। বয়সে হয়তো ছেলেটা কিছুটা ছোটই হবে তার চেয়ে। তাই ভয়ের সাথে যোগ হয়েছে অযাচিত ভক্তি। ভয়, ভক্তি, লোভ। স্বপ্নপূরণের যাত্রাপথে এই তিনটাই নাসরিনের হাতিয়ার। একটু কাছে টেনে পারফিউমের গন্ধে মাতাল করে মাথাটা বুকে চেপে ধরে নিমিষেই তাকে অন্যভুবনে নিয়ে যাওয়া কয়েক মুহুর্তের ব্যাপার মাত্র। শরীরে আস্বাদনে পাগল করে পরিতৃপ্ত ছেলেটার কাছ থেকে ভয় আর ভক্তির মিশেল ভালোবাসা আদায় করে নেয়ার আনন্দ উদযাপনের দাওয়াত ইতিমধ্যে দেয়া আছে পাড়া প্রতিবেশীদের। বিবেকবোধকে চাপা দিয়ে উন্মাদনা জাগে নাসরিনের মনে। আজ রাতে, অমাবশ্যার অন্ধকারে ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে চার দেয়ালের ঘরে অবশেষে তারও একটা সংসার হবে। অন্ধকার সময় দিয়েই হয়তো শুরু, তবে ভালোবেসে ঠিকই আলো জ্বালাবে এই স্বপ্নে যখন নাসরিন বিভোর, হঠাৎই দরজা ঠক ঠক শব্দ।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই এপ্রিল, ২০১০ দুপুর ২:০৯