অপেক্ষা ব্যাপারটা সবসময়ই বিরক্তিকর। মাঝে মাঝে একটু ভিতিকরও বটে। কিছুটা বিমর্ষ মুখে ঠিক তখনি আশেক এসে ঢুকলো। চেহারা দেখে আর কোনো প্রশ্ন করলাম না আমরা কেউ। দোকানের মেয়েটি কিছু কাগজ এগিয়ে দিল আমাদের দিকে। নাম ঠিকানা পূরন করে একটা স্বীকারত্তি ফর্মে সই করতে হবে। জেনে বুঝে সজ্ঞানে সম্মতি দিয়েছি। সই করার সময় মাথাটাকে ভাবনার উর্ধে নিয়ে গেলাম। যাতে টেনশন কাজ না করে। যতই ভাবার চেষ্টা করছি টেনশনের কিছু নেই, ততই মনে হচ্ছে টেনশন জেকে বসছে। কাগজে সই করতে করতেই একটা গাড়ি এসে থামলো দোকানের সামনে। মেয়েটি বললো তোমাদের গাড়ি এসে গেছে গেট রেডি। গাড়ি থেকে খুবই ষন্ডা গুন্ডা মার্কা রাফ এন্ড টাফ কিছু লোক নামলো। তাদের দেখে কেমন যেন অস্থিরতা অনুভব করলাম। সব কিছু ঝেড়ে ফেলে গাড়ির পেছনে উঠে বসলাম। ছাদ বিহীন জিপের পেছনে খোলা আকাশ, এক পাশে অপরূপ প্রকৃতি আর হিমেল ঠান্ডা বাতাসের সাথে ঝড়ের বেগে গাড়ি চলতে শুরু করলো।
গাড়ি চলছে দুরন্ত গতিতে। পাহাড়ি রাস্তা ধরে। যতই এগিয়ে যাচ্ছি ততই সময় ঘনিয়ে আসছে। সেই মুহুর্তটি ভাবার চেষ্টা করছিলাম, কিন্ত ভাবনায় ঠিক ঠাক মতন আসছিল না। উলটো গাড়ির ড্রাইভারটা কি খায় সেটাই ভাবছিলাম আমরা। আকা বাকা রাস্তা ধরে এত দ্রুত গাড়ি চালাতে আর কাউকে দেখিনি। খুব কাছাকাছি গতিতে গাড়ি চালিয়েছিল বান্দরবনের রুমাবাজার থেকে ১১ কিলো রাস্তার জীপের ড্রাইভার। তবে এই বেটা ভয়াবহ। একটা শার্প ইউটার্নে সে গতিতে কোনো লাগাম দিলো না। একদিক থেকে এটাই ভালো ছিল। গাড়ির গতির টেনশনে এতক্ষন মাথায় ঘুরতে থাকা চিন্তাটা হারিয়ে গেল। পাহাড়ী রাস্তার দুই দিক জুড়ে অপরূপ সুন্দর প্রকৃতি। সবকিছু ভুলে ক্ষনিকের জন্য সেইদিকেই যেন ডুবে গেলাম। হুশ হলো হা করে প্রকৃতি দেখতে গিয়ে দ্রুত গতিতে চলা জিপে অসাবধানতার কারনে ধুম করে মাথায় একটা ধাক্কা খেয়ে। ঠান্ডার সময়, কিছুটা লাগলো। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতেই গাড়ি থামলো। ষন্ডা মার্কা লোকগুলো কোনো কথা না বলে ব্যাগ প্যাক নিয়ে হাটতে শুরু করলো। আমরাও দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। আমরা মানে আমি, ফুয়াদ, আশেক। হাত নেড়ে জিনু পিঙ্কিকে বিদায় দিলাম। চান্সে আশেক মাফও চেয়ে নিল যদি কিছু হয়ে যায়।
পাহাড় থেকে লাফ দেয়া। চাট্টি খানি কথা না। ছোট খাট পাহাড় নয় মোটেও। নেপালের বিখ্যাত বিশাল উঁচু উঁচু সব পাহাড়। খেলাটার নাম প্যারাগ্লাইডিং। রঙ বেরঙ্গের ঘুড়ির মতন রঙ বেরঙ্গের প্যারাস্যুট, একজন পাইলটও থাকে সাথে। তারপরেও ১০০ ডলার খরচ করে আপনি উঁচু পাহাড় থেকে লাফ দেবেন, অপরিচিত কিছু যন্ত্রপাতি নিয়ে, তার চেয়ে সামান্য বেশি (পাচ মিনিট) পরিচিত একজন মানুষের সাথে। মানুষগুলো দেখতেও কেমন যেন। মনে হয় একটার বেশি দুটো প্রশ্ন করলেই ধাক্কা মেরে ফেলে দেবে। টেক অফ প্লেসে এসে দেখি মানুষের মেলা। একদল মানুষ অপেক্ষা করছে যেকোনো মুহুর্তে লাফ দেওয়ার। আর ঠিক সামনেই আকাশ জুড়ে উড়ে বেড়ানো মানুষের মেলা। দেখতেই মন ভালো হয়ে যায়। আর ঠিক উলটো পাশেই প্রকৃতির অভাবনীয় রূপ। এখান থেকে হিমালয়টা দেখা যায় সবচেয়ে ভালো মতন। একদম খোলা, টান টান দাঁড়িয়ে আছে, মাথা উঁচু করে। কি ভীষন ভয়ানক সুন্দর। ক্ষনিকের জন্য হারিয়ে গেলাম।
আমার পাইলটের নাম ইসকা। ফুয়াদের জনের নাম রাম, আর আশেক আছে ডিলানের সাথে। যন্ত্রপাতির সাথে পরিচিত হচ্ছি আমরা। আমাদের কি করনীয় আছে, এবং কোন কাজ কোনো ভাবেই করা যাবে না সেটা শুনছি খুব মনোযোগ দিয়ে। ইসকা যখন থামলো সব কিছু বলে, আমি প্রশ্ন করলাম, যদি আমি পড়ে যাই সেক্ষেত্রে ব্যাকআপ প্ল্যান কি?
সে খুব নির্বিকার ভঙিতে বললো “ব্যাকআপ তোমার সাথে নেই। ব্যাকআপ আমার সাথে।”
তখন আমি পালটা জিজ্ঞস করলাম “তার মানে তোমার আর আমার ইন্সট্রুমেন্টের যেই কানেকশন আছে সেটা সহজে খুলে যাবার তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই।”
“যদিনা তুমি এই বাটনে চাপ দাও। এছাড়া তোমার কপাল খারাপ না হলে এরকম কিছু হবার কথা না।”
আমি বুঝলাম অন্য সব কিছু ঠিক আছে, আমার সবচেয়ে ভালো ভাবে চিনে রাখতে হবে এই বাটনটাকে।
টেক অফ প্লেসে একটু সিরিয়াল আছে। আমরা অপেক্ষা করছি আমাদের সিরিয়াল আসার। তাকিয়ে দেখি আশেক আর ফুয়াদেরও একি অবস্থা। দূর থেকে আমরা একে অপরকে সাহশ দেয়ার চেষ্টা করতে থাকলাম। টেক অফ প্লেসে দাঁড়িয়ে পাহাড়ের নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলে হার্টবিট বেড়ে না যাওয়াটাই অস্বাভাবিক।
আমার পাইলট ইসকা দারুন। ফুয়াদের রাম খুবই প্রফেশনাল। আর আশেকের ডিলান বদ্ধ উন্মাদ। টেক অফ প্লেসে দাঁড়িয়ে আমাদের টেনসড চেহারা দেখে হয়তো রসিকতার ছলে হুট করেই সে শুরু করে দিল লুঙ্গি ড্যান্স। সেই লুঙ্গি ড্যান্স আর থামেই না। একবার মনে হলো শালাকে ধাক্কা মেরে পাহাড় থেকে ফেলে দিই। আশেককে দেখলাম করুন মুখ করে ওর দিকে তাকের আছে। হয়তো মনে মনে ভাবছে এই শালা আকাশে উঠে যদি লুঙ্গি ড্যান্স দেয়া শুরু করে ওর কি হবে? ওর থেকে মনোযোগ সরিয়ে যারা লাফ দিচ্ছে ওদের কে দেখে সাহস সঞ্চয় করার চেষ্টা করতে থাকলাম। ভারতীয় এক ভদ্রলোক, স্বাস্থ্য বেশ ভালো। তার পাইলট বরং তার চেয়ে অনেক ছোট খাট পড়ে গেছে। টেক অফের অন্যতম প্রধান রুল ছিল যখনি বলা হবে দৌড় কিছুতেই বসে পড়া কিংবা দাঁড়িয়ে থাকা চলবে না, দৌড়াতে হবে। স্বাস্থ্য ভালো ভারতীয় ভদ্রলোককে দৌড়াতে বলার সাথে সাথেই সে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে গেল। পাইলট পেছন থেকে জোরে একটা ধাক্কা দিল তাকে। ঘটনা যা ঘটল সেটা লিখে বোঝানোর ক্ষমতা আমার নেই। বিশাল বড় সড় দেহের ভদ্রলোক পুরো এলোমেলো হয়ে উলটে গেল। আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। আমাদের মনে হচ্ছিল এখনি সে ছিটকে পড়ে যাবে। কিন্ত আমাদেরকে ভুল প্রমান করে দিয়ে ধীরে ধীরে ওরা উড়ে চলে গেল। আমাদের মনে হলো, এর চেয়ে খারাপ কিছু করা আমাদের পক্ষে খুব কঠিন। মনে একটু সাহস পেলাম। তাকিয়ে দেখি আশেক উড়ে গেল, ক্ষানিক বাদেই ফুয়াদ।
ইসকা বললো “ইউ রেডি”।
আমি বললাম “ইয়েস”।
“ওকে দ্যান। রান”
হাল্কা একটু দৌড় দিয়ে একটা ছোট লাফ দিতেই দেখি আমি আকাশে ভাসছি।
ইসকাকে জিজ্ঞেস করলাম “হাও ওয়াজ দ্যাট?”
“ইট ওয়াজ অলমোস্ট পারফেক্ট। ওয়েলডান।”
আকাশে উড়ে বেড়ানোর আনন্দে আর নতুনত্বের ছোয়ার ক্ষানিকটা অস্বস্তি নিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছি। ইসকা বললো “ফিল লাইক ইউ আর সিটিং এট ইউর হোম এন্ড ওয়াচিং মুভিজ সিটিং ইন আ কফোর্ট্যাবল চেয়ার।” আমিও হাত পা ছেড়ে দিয়ে আয়েস করে বসলাম, কারন ওর উপর ভরসা রেখে এই দারুন ভ্রমন উপভোগ না করে টেনশন করাটা সব কিছুরই অপচয় হবে। একটা ছোট ডিভাইস থেকে বিপ বিপ শব্দ আসছিল। যতক্ষন বিপ বিপ শব্দ হবে ধরে নিতে হবে আমরা উপরে উঠছি। আমি শব্দ ফলো না করে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম যেখান থেকে লাফ দিয়েছি সেটাকে ফেলে কত উপরে উঠে গেছি। চর্তুদিক ঘুরে ঘুরে উপড়ে উঠছি। ইসকা আমাকে চারদিকের পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। যদিও ইতিমধ্যে জেনে গেছই অন্নপূর্ণা – ফিসটেলদের পরিচয়। ইসকা এবার এমন জায়গা থেকে এদেরকে পরিচয় করিয়ে দিল যেখান থেকে হিমালয় দেখা স্বপ্নের মতন ব্যাপার। আমি বাতাসে ভাসছি, মাটি থেকে না জানি কত উপরে, সামনে চারদিক খোলা, শুধু হিমালয় রত্ন ভান্ডার। ইসকার সাথে অনেক কথোপকথন হয়েছে, কিন্ত ঐ সময়ের মিনিট পাচেক আমি কোনো কথা বলিনি। বাতাসের শো শো শব্দ তখন হারিয়ে গেছে। ঠান্ডা বাতসে কেপে উঠেছি কিনা সেটাও মনে করতে পারছি না। শুধু মনে আছে যখন টার্ন নেয়ার জন্য হিমালয়কে পেছনে ফেলে ঘুরে আসতে হতো, অটোমেটিক্যালি আমার ঘাড় ঘুরে যেত।
অনেকক্ষন হলো আমরা উপরেই উঠছি শুধু, এক সময় দেখলাম অন্য সবাইকে পেছনে ফেলে সবার উপরে আমরা। এখান থেকেই ধীরে ধীরে নামার কথা আমাদের। কিন্ত বাতাসের গতি চক্রের সাথে মিলিয়ে নামতে হয় নিচের দিকে। সেই গতি চক্র মিলছিল না। তাই উপরেই চক্কর কাটতে থাকলাম আমরা। এখানেও আমাদের অপেক্ষা। ইসকা বললো আমি নাকি লাকি। গতি চক্র পেলে আরো আগেই নিচে নামা শুরু করে দিত সে। এখন একটু বেশি সময় উড়ে বেড়ানো হবে আমাদের। আমিও একটুক্ষন চোখ বন্ধ করে অনুভূতি নেয়ার চেষ্টা করলাম। নিচে তাকিয়ে দেখি আমার মতন শ দেড়েক মানব পাখিরা উড়ে বেড়াচ্ছে। উড়ে বেড়ানোর অনুভূতির কোনো বর্ণনা হয় না। এটা শুধু অনুভব করার মতন ব্যাপার। অনেকের কাছে এটা নেশার মতন। গ্রাফিক ডিজাইনার ইসকা, একসময় তার পার্ট টাইম পেশা ছিল প্যারাগ্লাইডিং। আর এখন ঠিক উলটো। প্যারাগ্লাডিং ওর প্রধান পেশা আর গ্রাফিক ডিজাইনিং পার্ট টাইম পেশা। প্রতিদিন তিনবার করে লাফ দেয় সে। পোখারার প্যারাগ্লাইডিং পৃথিবীর অন্যতম সেরা শুধু মাত্র এর বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের কারনে। এই কারনে স্পেনের অধিবাসী ইসকা দুই বছর ধরে পোখারায় থাকে। কি এক অদ্ভুত প্রফেশন আর নেশা। আকাশে উড়ে বেড়ানো, বাতাসের সাথে গতির খেলা। আহা!! সে এক মধুর অনুভূতি। ইতিমধ্যে গতি চক্র পেয়ে গেল ইসকা। ধীরে ধীরে নিচে নামতে শুরু করলাম আমরা।
ল্যান্ডিং এর ঠিক আগে আগে ইসকা ক্ষানিকটা এক্রোব্যাটিক শো দেখালো আমাকে। আমরা বাতাসে দুটো ডিগবাজী দিলাম। তারপর আস্তে আস্তে ফেওয়া লেকের ধারে ল্যান্ডিং স্পটের কাছে চলে এলাম। এখানের রুল একদম সহজ। ল্যান্ডিং এর আগে পা সোজা করে রাখতে হয়, আর স্টপ বললেই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যেতে হয়। একদম স্মুথ ছিল। এবার আর অলমোস্ট পারফেক্ট না, পুরোপুরি পারফেক্ট। এন্ড অফ আ ভেরি এক্সাইটিং গেইম অফ ফ্লাইং।
ছবি দেখার জন্য যেতে হবে নিচের লিঙ্কে। যদি দেখার ইচ্ছা হয় আর কি । আর ছবি দেখা না গেলে সেটা জানাতে হবে, যদি এর পরেও দেখার ইচ্ছা থাকে আর কি।
ছবি
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১:০৪