ভারতের ব্যাটিং লাইন আপ নিয়ে ভাবছিলাম। সবসময় ব্যাটসম্যানদের স্বর্গ ভারত। শচীন দ্রাবিড়রা ব্যাটনটা যেখানে ছেড়ে গিয়েছিল সেখান থেকেই যেন শুরু করেছে কোহলি রায়নারা। আর অপেক্ষায় আছে সঞ্জু স্যামসন কিংবা মনিশ পান্ডেরা। বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত অপরাজিত। কেউ না কেউ দাঁড়িয়ে গেছে প্রতিদিন। আর সবদিন পুরো দল আগলে রাখা ধোনি তো আছেই। তারপরে একটু ভালো করে ভেবে দেখলাম। এই বিশ্বকাপে এই ভারতের ব্যাটিং লাইন আপ কি সেরা? সেই আলোচনায় আজকে যাব না। বরং একটু দেখার চেষ্টা করি ভারতের ব্যাটিং লাইন আপের ব্যবচ্ছেদের।
রোহিত শর্মাকে দিয়ে শুরু করি। রোহিতের ব্যাটিং এ একটা অলস ব্যাপার আছে। ব্যাকফুটে খুব ভালো পুল হুক খেলতে পারে এই অলস ব্যাপারটার কারনেই। সোজা ব্যাটে খেলে এটা একটা বিশাল প্লাস পয়েন্ট। দারুন আক্রমন করতে পারে বোলিং কে। ওর দুর্বলতার মধ্যে আমার সবচেয়ে বেশি চোখে পড়েছে তার অলস ব্যাপারটার কারনে সেট হতে সময় নেয়া এবং এই সময় একটু নড়বড়ে থাকা। ঠিক এই সময়টাতে গতিতে তাকে পরাস্ত করা খুব সম্ভব। ১৪০ কিঃমিঃ গতির বল আর সাথে খানিকটা ইনসুইং স্টাম্পে রেখে টানা কিছু বল করতে পারলেই শুরুতেই রোহিতকে চাপে রাখা যাবে বলে আমার ধারনা। আর ব্যাকফুটে পুল হুক ভালো করলেও কাট শটে কিছুটা ব্যালেন্সের অভাব আছে। তাই অফ স্টাম্পের সামান্য বাইরে মিডিয়াম শর্ট অফ লেন্থের স্লো বলে পয়েন্টে বা থার্ড ম্যানে ক্যাচ দেয়ার সুযোগ রোহিত দেবেই। স্পিন সে ভালো খেলে তবে স্টাম্পের উপরে কুইকার আর্মড বলে রোহিতকে ভালো ঝামেলায় ফেলার সুযোগ আছে।
শেখর ধাওয়ান, এই ভারতীয় টিমে টেকনিক্যালি সবচেয়ে দুর্বল কিন্ত ভয়ঙ্কর ব্যাটসম্যান। অন সাইডে খুবই শক্তিশালী, গায়ে প্রচন্ড শক্তি থাকায় টাইমিং করেই বল গ্যালারীতে পাঠানোতে সিদ্ধহস্ত। তবে ঐ যে বললাম ট্যাকনিক্যালি ভালো ব্যাটসম্যান না। ফুটওয়ার্ক, ডিফেন্স তেমন ভালো না। অফ স্টাম্পের ঠিক বাইরে সুইং করে বের হয়ে যাওয়া বলে দুর্বল। আর যেহেতু ওর সোজা ব্যাটে খেলার প্রবনতা কম তাই অফ স্টাম্পের ঠিক বাইরে থেকে ভেতরে ঢোকা বলেও সমান ভাবে দুর্বল। অতএব বাংলাদেশের ডানহাতি পেসাররা ওকে ওভার দ্যা উইকেওট বল করলে সুইং করে বল ভেতরে ঢোকাবে (অনেকটা মাশরাফি শেবাগকে যেই বলে হর হামেশা বোল্ড করত) আর রাউন্ড দ্যা উইকেট থেকে বল করলে গুড লেংথ বল সুইং করে বেরিয়ে যাবে। কোনো ভাবেই স্টাম্পের উপরে শর্ট পিচ বল দেয়া যাবে না। লেগ স্টাম্পের উপরে ভুলেও কোনো ধরনের বল দেয়া যাবে না। যদি ও পেস বলে টিকে যায় তাহলে কথা বার্তা ছাড়াই ডান হাতি অফ স্পিনার নিয়ে আসতে হবে। আর অফ স্টামের উপরে টানা গুড লেংথ বল করে যেতে হবে। নাসির মাহমুদুল্লাহ যথেষ্ট ওর জন্য।
বিরাট কোহলি সব দিক বিবেচনায় ভারতেরতো বটেই সমসাময়িক ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়। ওর কোনো দুর্বল দিক খুজে বের করা আমার সস্তা ক্রিকেটীয় মস্তিষ্কের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে একটা বিষয় আমার চোখে পড়েছে। শচীনের মতন কোহলি কিন্ত একেবারে সোজা ব্যাটে খেলে না। বরং উইকেটের চারপাশেই ব্যাটকে একটু তলোয়াড় বানিয়ে ক্রস খেলার একটা প্রবণতা আছে ওর মধ্যে। ডান হাতি পেসারদের ভেতরে ঢোকা বলকে সে মিড অনের পাশ দিয়ে বাউন্ডারী বানানোর চেষ্টা করবে। অন সাইডে ভয়াবহ স্ট্রং। নিতান্তই যদি দেখা যায় ও একেবারেই নড়বড়ে নয় তাহলে রাউন্ড দ্যা উইকেট থেকে রুবেলকে দিয়ে ট্রাই করে দেখা যেতে পারে। বলটাকে লেগ স্টাম্পের উপরে পিচ করিয়ে অফ স্টাম্প ঘেষে কোমর উচ্চতায় বেরিয়ে যাবে। এই বল গুলোতে সে না পারবে তার প্রিয় ড্রাইভ খেলতে, না পারবে অন সাইডে ফ্লিক করতে। পুল হুকের লেংথ না হওয়ায় কাট করার চেষ্টাটাই করবে। ওইটাই যেন আমরা তাকে করতে বাধ্য করি। তবে সব কিছু নির্ভর করছে পিচের উপরে। পিচ কেমন আচরণ করে। আর স্পিনে সে দারুন ওস্তাদ। তবে আমি নিশ্চিত, সাকিবকে সে সমীহ করেই খেলার চেষ্টা করবে। কাভারের উপর দিয়ে স্পিন বল উড়িয়ে মারতে সে দারুন আনন্দ পায়। তাই একটা মুভিং ফিল্ডার স্ট্র্যাটাজি নিতে পারে বাংলাদেশ। সাকিব একটু টসড আপ বল করে ওকে ডাউন দ্যা ট্র্যাক নিয়ে আসবে, আর অফ সাইডের ফিল্ডারটা বল শুরু করার সাথে সাথে খানিকটা মুভ করে ডিপ কাভারের দিকে চলে আসবে। তবে ডাউন দ্যা ট্র্যাকে সে বল পায়ের নিচে পেলে সেটা বোলারের মাথার উপর দিয়ে বাইরে চলে যাবে নিশ্চিত।
আজিঙ্কা রাহানে সম্ভবত কোহলির পরে ট্যাকনিক্যালি ভারতের সবচেয়ে বিশুদ্ধ ব্যাটসম্যান। পেস স্পিনে সমান ভাবে স্বচ্ছন্দ। একটু ছোট খাট হওয়াতে ও মুলত টাইমিং এর উপরেই নির্ভর করে। কোমর উচ্চতার বলে ওভার দ্যা টপ কাট শট খেলতে চায়। একটু এঙ্গেল বলে এই কাট শট খেললেই সেটা থার্ড ম্যানে ফিল্ডারের হাতে যাওয়ার চান্স থাকবেই। আর এই কাজটা করতে হবে ও ক্রিজে আসার সাথে সাথেই। তবে মনে রাখতে হবে রাউন্ড দ্যা উইকেট থেকে ডান হাতি বোলারের বল করতে খুব ভালো কন্ট্রোল লাগে। নইলে লাইন এলোমেলো হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে ওর জন্য ওভার দ্যা উইকেটেই এটা চেষ্টা করা যেতে পারে। তাসকিন এটা করতে পারবে। ১৪০ এ বল করলেই হবে। কোমর উচ্চতায় অফ স্টাম্পের সামান্য বাইরে যাতে কাট করতে গেলে স্নিক হবার চান্স থাকে আর চাইলেই ডিফেন্স করতে না পারে। ওর ইনিংস এর শুরুতেই ওকে স্পিন দেয়ার পক্ষপাতি নই আমি। কারন ও স্পিনে অনেক দ্রুত সেট হয়ে যায়। পেসাররা ক্লান্ত থাকলে সৌম্যকে ব্যবহার করতে হবে। আরেকটা ব্যাপার রাহানে টাইমিং নির্ভর হওয়ার ভালো স্লোয়ার ডেলিভারিতে ওর খাবি খাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ও সিঙ্গেলস নিয়ে ইনিংস বিল্ড করতে চায়। ঐ সময় জেন্টেল ড্রাইভ করে সিঙ্গেলস নেয়ার বল গুলাতে যদি একটু স্লোয়ার বিষ দেয়া যায় কট এন্ড বোল্ড এর চান্স আসবে।
ধোনির সবচেয়ে প্লাস পয়েন্ট ওর খেলা ধরনটাই আন কনভেনশনাল। ওর ব্যাটিং দেখে, দাড়ানো দেখে আপনার মনে হতে পারে ওর ডিফেন্স দুর্বল। কিন্ত আসলে ওর নিজস্ব ডিফেন্সিভ ম্যাকানিজম আছে যেটা খুবই শক্তিশালি। খুব ঠান্ডা মাথার। কোনো পরিস্থিতিই যেন ওকে স্পর্শ করে না। আমার মাথায় ওর কোনো দুর্বলতা আসছে না। তবে গত কিছুদিনে ওর ব্যাটিং দেখে আমার মনে হয়েছে ইদানিং ও একটা শট একেবারেই না পারতে খেলে। সেটা হচ্ছে ড্রাইভ। পেসাররা তাকে অফ স্টাম্পের বাইরে একটু গুড লেংথএ ড্রাইভে আমন্ত্রন জানাতে পারে। যেটা সে এক্সট্রা কাভারের উপর দিয়ে মারার চেষ্টা করবে। শুধু এই বলটা করতে হবে স্লোয়ার। রফিক কিংবা রাজ্জাকের কথা খুব মনে পড়ছে। ওদের আর্মড বলটা আমি খুব মিস করি। টানা অফ স্টাম্পের উপরে নির্বিষ বাম হাতি টিপিক্যাল স্পিন করে যেটাতে ব্যাটসম্যান ব্যাক ফুটে গিয়ে ডিফেন্স অথবা কাট করে সেই বলের পরে একটা স্টাম্পে আর্মড বল হয়তোবা ধোনিকে এল বি ডাব্লিউ র ফাদে ফেলতে পারে। সাকিব এটা করতে পারবে কিনা আমি ঠিক নিশ্চিত না। আর ধোনি ব্যাটিং এ আসার সময় যদি স্পিন এটাক চলতে থাকে তাহলে আন কনভেনশনাল ফিল্ড সেটিং করে দেখা যাতে পারে। নাসির বা মাহমুদুল্লাহ বল করলে অফ স্পিনে ধোনি সাধারনত চার ধরনের শট খেলে। ব্যাক ফুটে কাট, ডাউন দ্যা উইকেট, শর্ট বলে পুল আর অভার পিচে ড্রাইব অথবা ফ্লিক। সুইপ সে সাধারনত করে না। তাই ড্রাইভিং জোন আর ফ্লিক জোনে একটু ক্লোজ ফিল্ডার রেখে ধোনি কে শুরুতে একটু ভড়কে দেয়া যাইতে পারে। যাতে সে ঐ শট গুলা খেলতে একটু চিন্তা করে। সাকিবের ক্ষেত্রে আমি বলবো ধোনির বিরুদ্ধে প্রথম ওভারে একটা স্লিপও নিতে। পেসারদের মধ্যে মাশরাফি ধোনির বিপরীতে সবচেয়ে কার্যকর হবার কথা। ভেতরে ঢোকানো বল যেটাতে ধোনিকে ব্যাকফুটে গিয়ে ডিফেন্স করতে হবে সেই বলটাই করে যেতে হবে টানা। তাহলে সে উদ্ভাবনী শট খেলার চেষ্টা করবে।
রায়না দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিত রান করে যাওয়া ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের মধ্যে একজন। অন সাইডই রায়নার সব। অফ সাইডে তুলনামূলক অনেক কম শট খেলে। স্পিন বল উড়িয়ে মারতে পারে। তবে স্পিনের বিপরীতে মারতে গিয়ে আউট হবার প্রবনতা আছে ওর। ও যেই সময় ব্যাট করতে আসবে তখন ম্যাচের পরিস্থিতির উপরে অনেক কিছু নির্ভর করবে। তারপরেও আমার মনে হয় ওর ইনিংস এর শুরু থেকেই ওকে ডান হাতি অফ স্পিনারের সামনে ছেড়ে দেয়া উচিত। ও সিঙ্গেলস বের করার ব্যাপারে ধোনি কিংবা রাহানের মতন সিদ্বহস্ত না। তাই গুড লেংথে টানা ডান হাতি অফ স্পিনার বল করে গেলে ও শট খেলার চেষ্টা করবে। অফ স্টাম্পের বাইরের বল অন সাইডে মারতে গেলে আউট হয়ে যাবে। আর আরেকটা কাজ সে করতে পারে ডাউন দ্যা উইকেট এসে এক্সট্রা কাভারের উপর দিয়ে। এটা ওর প্রিয় শট। অতএব এক্সট্রা কাভারটা কাভার করতে হবে ফিল্ডার দিয়ে। হুট করে শর্ট বল পরে গেলে সে কাট করবে। সেটা মাথায় রাখতে হবে। আর আমি বলবো ওর ইনিংস এর শুরুতে একটা স্লিপ নিয়ে বল করতে। আর পেসাররা ওকে ওভার দ্যা উইকেট বল করলে গায়ের ভেতরে ঢোকা শর্ট বল করতে বলবো আমি। যেহেতু আমাদের সব পেসাররা ডান হাতি তাই ওর জন্য ওভার দ্যা উইকেটে বল করলে এমনিতেই একটা এঙ্গেল পাওয়া যাবে। রুবেল কিংবা তাসকিন ওদের পেসেই যদি গায়ের ভেতরে ঢোকানো বল করতে পারে তাহলে ও টপ এইজ করবে নিশ্চিত। ও বাম হাতি স্পিনার ভালো ডিল করে। তাই সাকিব কে সতর্ক থাকতে হবে।
রবীন্দ্র জাদেজা হয়তো ভালো শট খেলার ক্ষমতা রাখে তবে সেটা নিয়ে খুব ভাবিত হবার কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না। রুবেল যেই দুই বলে ব্রড আর এন্ডারসনকে আউট করছে ঐ দুই বলের একটাই যথেষ্ট। ওর ব্যাট আর প্যাডের মাঝে অনেক গ্যাপ থাকে। ওর সময় বাম হাতি স্পিনার এভোয়েড করা ভালো। আর পেসাররা রুম কম দিয়ে বল করলেই হবে। ওর হাতে শট খুব লিমিটেড। ও জায়গা না বানিয়ে তেমন শট খেলতে পারে না।
টাইগারদের জন্য একটি অক্রিকেটিয় টোটকা প্রয়াস
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
৫টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আলোচিত ব্লগ
বিচারের জায়গা না পেলে মানুষ প্রেত হয়ে ওঠে
(সামাজিক অবিচার, রাষ্ট্রীয় অনুপস্থিতি এবং আন্ডারওয়ার্ল্ড কাঠামোর মধ্যে সাধারণ মানুষ কীভাবে হারিয়ে যায়।)
মানুষ যখন বারবার অবিচারের শিকার হয়,... ...বাকিটুকু পড়ুন
=একদিন এসো সন্ধ্যে ফুরোলেই=
ভালোবাসা ছড়ানো পাতায় পাতায়, সবুজাভ স্নিগ্ধ প্রহর আমার
এখানে উঁকি দিলেই মুগ্ধতারা চুয়ে পড়ে টুপটাপ;
ধূসর রঙ প্রজাপতিরাও এখানে রঙিন ডানায় উড়ে,
কেবল অনুভূতির দোর দিতে হয় খুলে, চোখগুলো রাখতে হয়... ...বাকিটুকু পড়ুন
চীনের জে-১০ যুদ্ধবিমান কোনো চকচকে ল্যাব বা বিলাসবহুল ফ্যাক্টরিতে জন্মায়নি
১: গবেষণা ও উন্নয়ন (R&D) দলের অক্লান্ত পরিশ্রম।
২: বাইসাইকেলে চেপে কাজে যাচ্ছেন প্রধান প্রকৌশলী সু চিশৌ।
৩: প্রথম উড্ডয়নের পর কেঁদে... ...বাকিটুকু পড়ুন
Bangladesh bans ousted PM's Awami League under terrorism law
হায়রে এরেই বলে কর্মফল। ১৭ টা বছর গুম , খুনের মাধ্যমে এক ভয়ের রাজ্য তৈরী করে কেড়ে নেয়া হয়েছিল মানুষের বাকশক্তি। চোখ, কান, মুখ থাকতেও... ...বাকিটুকু পড়ুন
দিন গেলে আর দিন আসে না ভাটা যদি লয় যৌবন
এমন কোনো ইস্যু আছে, যা নিয়ে জাতি পুরোপুরি একমত? ৫০%ও একমত এমন কোনো বিষয় চোখে পড়ে না। একপক্ষ রবীন্দ্রনাথের গান জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মনেপ্রাণে ধারণ করে, আরেক পক্ষ বদলাতে চায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন